ইনসাইড বাংলাদেশ

দেশে দেশে ভাষা আন্দোলন


প্রকাশ: 09/02/2024


Thumbnail

বাঙালির ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার পশ্চিম পাকিস্তানি জুলুমের প্রতিবাদ এবং মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত দিন ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দিন ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন রফিক-সালাম-বরকতরা। তাদের ত্যাগের বিনিময়েই ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি (৪ ফাল্গুন, ১৩৬২ সাল) উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করতে বাধ্য হয় তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার।

পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ফলে এখন পৃথিবীজুড়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

‘ভাষার জন্য আন্দোলন’ কিংবা ‘আন্দোলনের অন্যতম উপলক্ষ ভাষা’ –এমনভাবে অধিকার আদায়ের আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হয়েছে। কোথাও অহিংস আবার কোথাও সহিংস।  আবার স্বাধীন দেশে বিভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার লড়াই হয়েছে, এখনো চলছে।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লাটভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা স্থানে ভাষার দাবিতে সংগ্রাম হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে নানা সময় বিভিন্ন রাজ্যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি উঠেছে। ভাষার দাবিতে ভারতে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয় ১৯৬৫ সালে, যখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করা হয়। ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, দলে দলে মানুষ রাজপথে নেমে আসে। প্রায় দুইমাস ধরে সহিংসতা চলে দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষ করে মাদ্রাজে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

বর্তমানে ভারতে ২২টি ভাষা সরকারের তালিকাভুক্ত এবং ৪টি ভাষাকে ঐতিহ্যবাহী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যদিও দেশটিতে মোট ভাষার সংখ্যা শ’খানেক। কেন্দ্রীয়ভাবে দাপ্তরিক ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি।

এছাড়া আসামে ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬১ সালে। তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার কেবল অহমীয় ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিলে আন্দোলনটি হয়। পরে অবশ্য বাঙলাকেও স্বীকৃতি দেয় প্রাদেশিক সরকার।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ভাষা আন্দোলন করেছিল স্কুলছাত্ররা। ১৯৭৬ সালের জুন ১৬ স্কুলের কিশোররা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। যুক্তরাষ্ট্রে নেটিভ আমেরিকানরা বারবার তাদের ভাষা রক্ষার আন্দোলন করেছে। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় এই  আন্দোলন গতি পায়। কানাডাতে, বিশেষত কানাডার পূর্ব অংশের অঙ্গরাজ্য কুইবেকে ভাষার স্বাধীনতা চেয়ে আন্দোলন হয়েছে বেশ কয়েকবার। লাটভিয়াতে গণভোটে লাটভিয়ানরা কয়েকশ বছরের প্রধান ভাষা রুশকে সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

ভারত:

দক্ষিণ ভারতে ভাষার জন্য প্রথম রাজনৈতিক প্রতিবাদ হয় ১৯৩৭ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সরকারস্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে এ আন্দোলন শুরু হয়। তিন বছরব্যাপী এ আন্দোলন অনশন, সভা-সমাবেশ, পদযাত্রা, পিকেটিং ও সহিংস প্রতিবাদ পর্যন্ত গড়ায়। কঠোরহস্তে আন্দোলন দমনের কৌশল নেয় সরকার। এতে প্রায় দুইজন প্রাণ হারায় এবং নারী-শিশুসহ ১ হাজার ১৯৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস সরকার পদত্যাগের পর ১৯৪০ সালে  তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষার আইন প্রত্যাহার করা হয়। এতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার নাখোশ হলেও স্থানীয় আন্দোলন শেষ হয়।

ভারতের মাদ্রাজে হিন্দিবিরোধী বিক্ষোভ:

এর চেয়ে বড় আন্দোলন হয় ১৯৬৫ সালে, যখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করা হয়। সে বছর, ২৬ জানুয়ারি এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে দলে দলে। প্রায় দুইমাস যাবত দাঙ্গা হয় দক্ষিণে, বিশেষ করে মাদ্রাজে। শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। সারা দক্ষিণ ভারত বিশেষভাবে তামিলনাড়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদে আত্মাহুতির ঘটনাও ঘটে। ১৯৬৭ তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে আন্দোলনের পক্ষাবলম্বনকারী রাজনৈতিক দলগুলো বিজয়ী হয়। এর ফলে তামিলনাড়ুতে ডিএমকে ক্ষমতায় আসে এবং কংগ্রেস প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়- এমনটিই ধারণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পঁয়ষট্টির আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল তামিলনাড়ু রাজ্যের মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই)। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষকরে মাদ্রাজ এবং আন্নামালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ভাষাভিত্তিক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐহিত্যের গর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও কম নয়। এর মধ্যে ওডিশা, কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্র অন্যতম। কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দি চাপানোর স্পষ্ট প্রতিবাদ হিসেবে মহারাষ্ট্র সরকার স্থানীয় বিভিন্ন ভাষাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা:

দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল স্কুল পর্যায়ের ছাত্ররা। গাউটাংয়ের (তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশ) জোহানেসবার্গ শহরের সোয়েটোতে সংঘটিত আন্দোলনটি হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন । অঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ আফ্রিকানার ভাষায় (দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণ) শিক্ষাদান স্কুলে বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয়। এ ঘটনাকে বলা হয় সুয়েটো অভ্যুত্থান। আর ট্র্যাজেডির দিনটিকে বলা হয় ‘ডে অব চাইল্ড’।

ভাষার দাবিতে আফ্রিকার শিশুদের আত্মবলিদান:

তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে যাওয়া ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে। শতাধিক মানুষ নিহত হয় এর বেশিরভাগই ছিল শিশু-কিশোর। দক্ষিণ আফ্রিকায় দিনটিকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র:

যুক্তরাষ্ট্রে অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে। গত শতকের ষাট-সত্তুরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় এই নেটিভ আমেরিকান ভাষা রক্ষার দাবিও সামনে চলে আসে। মূল প্রস্তাবনার দীর্ঘ ২০ বছর আন্দোলন এবং আলোচনার পর ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নেটিভ/আদি/স্থানীয় ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য একটি আইন পাস হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক অঙ্গরাজ্যে ইংরেজির আধিপত্য কমেছে।  ক্রমেই সংখ্যালঘুদের ভাষায় পরিণত হচ্ছে এটি। সে স্থলে উঠে আসছে স্প্যানিশ বা অন্য কোনো ভাষা।

কানাডা:

কানাডাতে, বিশেষত কানাডার পূর্ব অংশের অঙ্গরাজ্য কুইবেকের রাজনীতিতে ভাষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই অঞ্চল এক সময় সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রশ্নে স্বাধীনতা চেয়েছিল। অবশ্য সে আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমেই ক্ষয়ে গেছে।

লাটভিয়া:

ভাষার প্রশ্নে চরম জাতীয়তাবাদের স্বরূপ দেখিয়েছে লাটভিয়ানরা। রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা করার প্রশ্নে ২০১২ সালে এদেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে স্পষ্ট ব্যবধানে রুশ ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেন লাটভিয়ানরা। যদিও রুশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকাকালে কয়েকশ বছর ধরে রুশ ভাষাই ছিল লাটভিয়ার প্রধান ভাষা।

অন্য দেশে ভাষার দাবি:

প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও নানা অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অন্যতম নিমিত্ত হয়ে উঠেছে ভাষা। বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ, ইউরোপের বলকান অঞ্চল, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চল; উনিশ শতকে গোটা মধ্যপ্রাচ্য আরবি-ফারসি-তুর্কি কিংবা তৎকালীন মেক্সিকোর উত্তরাংশে স্প্যানিশ-ইংরেজি; সপ্তদশ-অষ্টদশ শতকে চীনে ম্যান্ডারিন-মাঞ্চুরিয়ান বিরোধ ইত্যাদি নানাভাবে নানা রূপে জাতিয়তাবাদী স্বাধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছে ভাষা।

সবশেষ কথা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহমিকায় আমরা যেন আমাদের ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীগুলোর কথা ভুলে না যাই। তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ভাষা রক্ষার দায়িত্বও সংখ্যাগরিষ্ঠের এটি যেন আমরা ভুলে না যাই।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭