ইনসাইড বাংলাদেশ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সমাধি হল পাকিস্তানে


প্রকাশ: 13/02/2024


Thumbnail

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে বিতর্কিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। যেখানে ৯০ দিনের জন্য গঠিত একটি সরকার দুই বছরের মতো সময় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিল জাতির ওপর। এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আনুষ্ঠানিক সমাধি ঘোষিত হল পাকিস্তানে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন ব্যবস্থা হতে পারে না, তা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হল পাকিস্তানে। 

বাংলাদেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকা একটি দল নির্বাচনে কারচুপি করে, পক্ষপাতিত্ব করে এবং যে কোন প্রকারে কারসাজি করে নির্বাচনে জয়যুক্ত হতে চায়—এ রকম একটি ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল সামরিক স্বৈরশাসনের প্রেক্ষাপটে। সামরিক শাসকরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে তাদের ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিত এবং সেই নির্বাচনে প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে জয়ী হওয়াটা ছিল তাদের বাধ্যতামূলক। কারণ এই জয়ের মাধ্যমে তারা জাতীয় সংসদে তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড গুলোকে বৈধতা দিতে হবে। 

জিয়াউর রহমান তথাকথিত গণভোটের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতির যে রেকর্ড করেছিল সেই রেকর্ড এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। একই ব্যবস্থা করেছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনিও গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমান উর্দি পরে নির্বাচনী প্রচারণা করেছিলেন। নজিরবিহীন কায়দায় একজন সরকারি কর্মকর্তা একটি দলকে জিতিয়ে আনার জন্য সামরিক গোয়েন্দা সহ বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করেছিলেন। আর একই পথে এরশাদ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। ’৮৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনও করা হয়েছিল এক একই প্রক্রিয়ায়। এ কারণেই আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোদাবি করেছিল যে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর এই প্রেক্ষাপটে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আর সেই আন্দোলনের মুখে শেষপর্যন্ত পতন ঘটে এরশাদের এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার আসে।

গণতান্ত্রিক বিশ্বে নির্বাচন হয় দলীয় সরকারের অধীনে। নির্বাচনকালীন সময়ে দলীয় সরকারের ক্ষমতা শিথিল করা হয়। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আপনাআপনি বেড়ে যায় এবং রুটিন কাজের বাইরে ক্ষমতাসীন দল বা সরকার কোন কাজ করে না। ব্রিটেনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশেও এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বে এটি স্বীকৃত ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর জয়ী বিএনপি গুরুত্বহীন মাগুরা, মিরপুর উপনির্বাচনে কারচুপির আশ্রয়। ফলে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আসছে এবং ছিয়ানব্বই সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। এ ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে একটি স্থায়ী রূপ পায়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সবচেয়ে ত্রুটি ধরা পড়ে যখন দেখা যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যে দল সদ্য ক্ষমতা ছিল, সেই দলের পরাজয় অবধারিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথাকথিত নিরপেক্ষতার জন্য ক্ষমতাসীন দলটিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালায়, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ফলে জনগণের মধ্যে একটা বড় নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট হয়ে যায়। এই কারণে দেখা যায় যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যতগুলো তত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে নির্বাচন করেছে, সেখানে ক্ষমতার হাতবদল হচ্ছে। অর্থাৎ যে দলটি ক্ষমতায় ছিল তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে পরবর্তীতে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষতটি আরও উন্মুক্ত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে একটি অনির্বাচিত সরকারের চিরকালীন ক্ষমতায় থাকার পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। যে কারণে এক-এগারোর সময় তত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয় গোটা বেশ এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। বেগম খালেদা জিয়া সহ বিএনপি নেতৃবৃন্দ, আওয়ামী লীগ সকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে অনির্বাচিত শাসনব্যবস্থা কায়েমের যে সুযোগ তা বন্ধ করার দাবি জানান।

আশার কথা হলো এর মধ্যেই বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। যে রায়ে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষণা করে। এর ফলে বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে সেনা শাসনে জর্জরিত সেনা নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি গণতন্ত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিকৃত ভাবে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর ইচ্ছায় ক্ষমতার হাত বদলের একটি পাকাপোক্তা ব্যবস্থা কায়েম করার সুযোগ সৃষ্টি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যিনি প্রধান হবেন তিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রক হবেন এবং সেনাবাহিনী যাকে চাইবে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে ক্ষমতায় আনার জন্য কাজ করবে। পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচন তা প্রমাণ করেছে। কিন্তু পিটিআই এর সভাপতি ক্রিকেটার ইমরান খান এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কারচুপি করেও তাকে শেষ পর্যন্ত কোণঠাসা করতে পারেনি। তবে এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ক্ষত দগগদে ঘা ইত্যাদি তাকে মৃত্যু শয্যায় নিয়ে গেছে। পাকিস্তানের ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সারাবিশ্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কবর রচনা করেছে। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল আইসিইউতে, আর পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলে এটি গেছে কবরে। এখন বাংলাদেশে যদি কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি মতলববাজ, অগণতান্ত্রিক এবং অনির্বাচিত সরকারের একজন দালাল।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭