ইনসাইড থট

‘ড. ইউনূসের বিষয়গুলো স্বচ্ছতায় আনতে হবে’


প্রকাশ: 17/02/2024


Thumbnail

শান্তিতে নোবেল প্রাইজ বিজয়ী ড. ইউনুস বিশ্বে খুবই পরিচিত এবং অধিকাংশ লোকের কাছে শুধু সম্মানিত না একজন প্রিয় ব্যক্তিও বটে। অথচ তিনি বাংলাদেশের সিটিজেন হলেও আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে চলেছেন। যেহেতু তিনি বাংলাদেশের এখনও একজন সিটিজেন, এই কারণে তাকে বাংলাদেশের আইনে যেকোনো বিষয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে, কোনও বিচারের আশা করলে বাংলাদেশের কোর্টে যাওয়া উচিত। তিনি অবশ্য তার যে কোনও প্রয়োজন থাকলে বাংলাদেশের কোর্টে যান। যেমন সরকার যখন তাকে একটি সরকারি ব্যাংকের এমডির পদে বয়স পার হয়ে যাওয়ায় তাকে সরিয়ে দেন, তিনিও আইনের আশ্রয় নেন। এদেশের কোর্ট তাকে চেয়ারম্যান থাকতে আর এমডি থাকতে পারেন না বলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন। সুতরাং, তিনি তখন থেকে আর গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নাই। কিন্তু গ্রামে একটি কথা আছে, গ্রামের গরিবের সুন্দরী বউ সবার ভাউস। অর্থাৎ ওই সুন্দরী যেহেতু গরীবের বউ সবার নজর তার উপরে পড়ে। এজন্যই বাংলাদেশকে এখনও পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে যে, এই রাজ্যে গরিবের বউয়ের মতো। এদের দিকে যে কেউ তাকাতে পারে। যে কেউ যা খুশি তাই করতে পারে। কিন্তু, বাংলাদেশ এখন আর সেই পর্যায়ে নাই এটা তারা ভুলে যায়। এবং, ভুলে যাবার জন্য ইচ্ছা করে হোক অনিচ্ছায় হোক বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব ইউনূসের ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনও আইন খাটবে না, এটাই হচ্ছে তাদের মূল বিষয়। এবং ড. ইউনূস ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে তারা একের পর এক চাপে রাখতে চায়। যদিও এই চাপে পরিশেষে বাংলাদেশের কিছুই হবে না। কারণ বিশ্বের যত দেশেই এই পশ্চিমা বিশ্ব চাপে রেখেছে, উল্টা পশ্চিমা বিশ্ব আরও নীচের দিকে চলে যাচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম অর্থনৈতিক অবস্থা যাচ্ছে যে, আমরা যদি সঠিকভাবে আমাদের অর্থনীতিকে চালাতে পারি, ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অনেক লোক বাংলাদেশে চাকরি করতে আসবে, এটা হলো বাস্তবতা। এই বাস্তবতার মধ্যেই যে ড. ইউনূস কি অন্যায় কাজ করেছেন? তা আমাদের দেশে অনেকেই জানে না। না জেনে তারা মনে করে যে সরকার বোধ হয় ড. ইউনূসকে দেখতে পারে না এবং তাকে একটু টাইট দিতে চায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। আমি বিশদভাবে যাব না কারণ অনেকেই জানেন এবং বিশদভাবে যেতে হলে একটা বই লিখতে হয়। সেটা না করে আমি শুধু পাঠকের সুবিধার জন্য অল্প কয়েকটি বিষয়ে বলতে চাই।

আইনের প্রতি তোয়াক্কা ড. ইউনুস প্রথম থেকেই করেন না। যার জন্যে যখন গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেবের আমলে একটি বৈধ এবং স্বতন্ত্র ব্যাংক হিসাবেই। এবং, এই ব্যাংকের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে ড. ইউনূসকে নিয়োগ দেওয়া হয়। একজন এমডির বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের যে সব ক্ষমতা, পাওনা দেনা, সেসব ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু, উনি তার ওই ব্যবস্থাপনা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তখনই তিনি বেআইনি পথে যাত্রা শুরু করেন, নিজের অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য। উদাহরণ হিসেবে বলি, গ্রামীণ ব্যাংক যখন ১৯৮৩ সালে শুরু হয় তখন মাত্র ৩ কোটি টাকা মূলধন দিয়ে শুরু হয়। এর ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছিল সরকারের এবং ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ছিল ঋণগ্রহীতার। এখানে ড. ইউনূসের কোন ব্যক্তিগত টাকা-পয়সা নাই। অবশ্য এমডির কোন টাকা পয়সা লাগবে, উনি ব্যাংকের আইন নিয়েও কোন কন্ডিশন নাই, সুতরাং ঠিকই আছে। কিন্তু, এমডি সাহেব চাকরি করছেন। তাতে কিন্তু তিনি যখনই এমডি হলেন এবং দেখলেন যে, তাহলে তো আমি শুধুমাত্র একটি ব্যাংকের এমডি থাকার জন্য তো আমার যে উদ্দেশ্য তা সফল হবে না। তখন তিনি প্রচলিত আইনকে বিভিন্ন পথে ঘোরানো শুরু করলেন। উদাহরণ হিসেবে বলি, এই গ্রামীণ ব্যাংকে ব্যবহার করেই তিনি সরকার এবং ঋণগ্রস্ত জনগণের টাকাকে তিনি নিজের টাকায় রূপান্তরের পন্থা অবলম্বন করলেন। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় ড. ইউনূস গড়ে তুললেন ২৮টি প্রতিষ্ঠান। এবং এতে কোন অসুবিধা হলো নাই। কিন্তু তিনি ২৮ টি প্রতিষ্ঠান করতে যেয়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক বা সরকারের ১ হাজার কোটি টাকা নিজের টাকায় পরিবর্তন করলেন। কিভাবে করলেন? যখন প্রতিষ্ঠার পর দাতাগোষ্ঠী অনুদান বা ঋণ দিল গ্রামীণ ব্যাংকে তখন ড. ইউনূস দেখলেন যে, তাতে তার লাভ কি? এতো গ্রামীন ব্যাংক পাচ্ছে। তাই তিনি প্রথমে এই দাতাদের অনুদানের অর্থ দিয়ে গঠন করলেন সোশাল ভেনচার ক্যাপিটাল ফান্ড (SVCF)। ১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর ওই ফান্ড দিয়ে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৪ সালে গ্রামীণ ফান্ড নামে একটি লিমিডেট কোম্পানি গঠন করা হয়। তাতে আগের যে ফান্ড উল্লেখ করা আছে তার ৪৯.১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়।

এখন এই গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়ে বিভিন্নভাবে টাকা আসা শুরু হয়। কিন্তু আসলেও ওই বোর্ডে ছিল ড. ইউনূস সাহেবের সব ইয়েস ম্যান। তাদেরকে দিয়ে উনি নিজের সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন। উদাহরণ হিসেবে ১৯৯৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের ৩৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, দাতাগোষ্ঠীর অনুদানের অর্থ এবং ঋণ দিয়ে সোশাল অ্যাডভান্সমেন্ট (SSF) গঠন করা হয়। কিন্তু দাতারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এভাবে অর্থ সরিয়ে ফেলায় আপত্তি জানায়। দাতাদের আপত্তির কারণে ড. ইউনূস তার কৌশল বদল করে ২৫ এপ্রিল ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভায় গ্রামীণ কল্যাণ গঠনের প্রস্তাব আনেন। এবং, এই প্রস্তাবে বলা হয় যে, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য কর্মীদের কল্যাণে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ এর আওতায় গ্রামীণ কল্যাণের নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এটা করা হলো। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড সভায় প্রস্তাব অনুমোদন করা হলো এবং এটা গ্রামীণ ব্যাংকেরই একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান।

গ্রামীণ কল্যাণ যে গ্রামীণ ব্যাংকেরই একটি শাখা প্রতিষ্ঠান তা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এর মূলধন গঠন প্রক্রিয়ায়। কেননা গ্রামীণ কল্যাণ এই গ্রামীণ ব্যাংকের সোশাল অ্যাডভান্সমেন্ট ফান্ড (SSF) থেকে ৬৯ কোটি টাকা প্রদান করে। গ্রামীণ কল্যাণের মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। মেমোরেন্ডাম আর্টিকেল অনুযায়ী, গ্রামীণ কল্যাণের ৯ সদস্যের পরিচালনা কমিটি পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের দুইজন হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের মনোনিত। ড. ইউনূস সাহেব নিজেই তার লোকজনদের মাধ্যমে তিনি তার প্রতিনিধি করলেন এবং নিজেই চেয়ারম্যান হলেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর এক কথায় বলা চলে গ্রামীণ কল্যাণ ড. ইউনূস সাহেবের সোনার ডিম পারা রাজহাঁসে পরিণত হলো। কারণ, এই গ্রামীণ কল্যাণের মাধ্যমে তিনি গ্রামীণ টেলিফোন, গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন, গ্রামীণ শিক্ষা ইত্যাদি গঠন করলেন। এর আদলে তিনি গ্রামীন ক্যাপিটাল ফান্ডসহ অনেক কিছু গড়ে তুললেন। এগুলো গড়ে তুলতে তো কোন অসুবিধা নাই। কিন্তু, এগুলোর মালিক তো গ্রামীণ ব্যাংক। এটা তিনি স্বীকার করতে রাজি নন। এজন্যই এইসব প্রতিষ্ঠান যে সব গ্রামীণ ব্যাংকের তা তিনি স্বীকার করতে রাজি নন। ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ফান্ড এবং গ্রামীণ কল্যাণের পরিচালনা পরিষদে তিনি থাকলেও ২০২১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠান দুটিতে তার কোন প্রতিনিধি নাই। এমন হওয়ার কারণ, ড. ইউনূসের ইশারা। এখন তো এই সব প্রতিষ্ঠানে ড. ইউনূসের ক্ষমতা থাকে না। এই বেআইনিভাবে তিনি চেয়ারম্যান পদে থেকে গেলেন।

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তিনি এখন এর চেয়ারম্যান কিভাবে? এইসব ব্যাপারগুলো নিয়েই এখন গ্রামীণ ব্যাংক যারা চালাচ্ছেন তারা তাদের যে সংগঠনগুলো যেগুলো উল্লেখ আছে যেমন গ্রামীণ আইটি পার্ক, গ্রামীণ ক্যাপিটাল ফান্ড এইসবগুলি তারাই নিতে চায় এবং তারাই এগুলিকে এখন আইন মাফিক গ্রামীণ ব্যাংকের অংশ করতে চায়। এইখানেই ড. ইউনূসের বিরাট আপত্তি। এবং এই আপত্তির কারণেই তিনি বিভিন্ন সময় কোর্টে যান, হেরে যান এবং তখন তিনি পশ্চিমাদের সাথে কথা বলেন।

একটা কারণ হতে পারে বলে আমার মনে হয় যে, এইসব টাকাও পশ্চিমা বিশ্বে চলে যাচ্ছে। ব্যাংক ডাকাতি যারা করে, এদেশ থেকে যারা বিদেশে টাকা নিচ্ছে তাদের মধ্যে ড. ইউনূস একজন। পার্থক্য হচ্ছে, ইনি নোবেল লরেট, শিক্ষিত। আর অন্য যারা নিচ্ছেন তারা ততটা শিক্ষিত নন। তারা ততটা নামকরা ব্যক্তি নন। এখন কথা হলো, একই দেশে নামকরা হলে একরকম আইন আর নামকরা না হলে আলাদা আইন; এটাতো হতে পারে না। সুতরাং, আমি মনে করি, যেহেতু প্রথম থেকেই যারা টাকা দিয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের টাকা এবং সরকারের। সুতরাং, এটা খুব কঠিনভাবে দেখতে হবে। কারণ, ড. ইউনূসের যে তিনটি ব্যাংক একাউন্ট আছে তার ভেতরে যেটা জানতে পেরেছি, তা হলো- সাউথইস্ট ব্যাংক একাউন্ট, স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংক একাউন্ট এবং রূপালি ব্যাংক। এই তিনটি ব্যাংক একাউন্টের মধ্যে ২০০০ সালে খোলা সাইথইস্ট ব্যাংকের একাউন্ট তার মূল ব্যাক্তিগত ব্যাংক একাউন্ট হিসেবেই প্রতীয়মান হয়েছে। এই একাউন্টে ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১১৮ কোটি ২৭ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৮ টাকা রেমিটেন্স এসেছে। এই রেমিটেন্সের বেশিরভাগ টাকা এসেছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এইটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। অর্থাৎ, তখনই তো এগুলো ড. ইউনূসের ছিল, উনি দলও করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য এখন যখন তার ট্যাক্স ফাইল থেকে শুরু করে সব কিছুতে দেখা যাচ্ছে যারা বাংলাদেশে থেকে টাকা সরিয়ে নিচ্ছে তাদের সাথে মূলত ড. ইউনূসের কোন পার্থক্য নাই। সুতরাং, সরকারের কর ফাঁকি থেকে শুরু করে বিদেশে টাকা নেওয়া প্রত্যেকটা জিনিস এক এক করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিৎ। এবং, বাংলাদেশের আইন যে সকলের জন্য সমান সেই হিসেবে বিচার করা উচিৎ। কে কোন স্টেটমেন্ট দিল তার জন্য সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলি পশ্চিমাদের পেসারে যদি আমাদের না খেয়েও থাকতে হয় তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এদেশ স্বাধীন করেছি সেই হিসেবে আমার দাবি যে, অন্য বিষয়গুলো আমরা যেমন সত্যের মধ্যে আনতে চাই, ড. ইউনূসের বিষয়গুলোও স্বচ্ছতায় আনতে হবে। এবং, আর যারা এখন আছেন গ্রামীণ ব্যাংকে তারা যত অবৈধ পথে সংগঠন চালিয়েছেন সেগুলোর প্রত্যেকটা তাদের দখল করে নিতে হবে। তাহলেই এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭