ইনসাইড বাংলাদেশ

বাঙালির জাতীয় চেতনা সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন


প্রকাশ: 19/02/2024


Thumbnail

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি হচ্ছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলন সুসংহত হয় এবং অগ্রগতি লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাই জনগণের মধ্যে পরবর্তীকালে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। বাঙালি জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষাকে হাজারগুণে বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন। তাই ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গণচেতনার সর্বপ্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই লিখেছেন বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং লেখক বদরুদ্দীন উমর।

‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামে এ বইতে বদরুদ্দীন উমর বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, সেসময় কীভাবে ছোট-বড় অনেক রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ছাত্র ও নাগরিক সংগঠন, আর শিক্ষক-অধ্যাপক-চিন্তাবিদরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও অধ্যাপক মিলে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন, যারা শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নানারকম সভা-সমিতি-আলোচনার আয়োজন করে। গঠিত হয়েছিল একটি ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও।’

এর নেতারা ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শিক্ষমন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে এক বৈঠক করে ডাকটিকিট-মুদ্রা ইত্যাদিতে বাংলা না থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ফজলুর রহমান তাদের আশ্বাস দেন যে এগুলো ঘটেছে ‘নিতান্ত ভুলবশত’।

ঢাকায় ১৯৪৭-এর ৫ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি ভবন) বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রস্তাব নেওয়া হয় যে, উর্দুকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করা হবে না। এ বৈঠকের সময় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ভবনের সামনে বিক্ষোভও করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা।

ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬-৭ মাস পর জিন্নাহ যখন ঢাকায় আসেন তখনই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রীতিমতো উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাবার্তা শুরু হওয়ার সঙ্গেই পূর্ববঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন যে, এটা বাঙালিদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে।

তারা বুঝলেন, এর ফলে পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি-বাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে উর্দু-জানা জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়বে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বাঙালি মুসলমানদের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশের স্বপ্ন সৃষ্টি হয়েছিল- তা চরমভাবে ব্যাহত হবে। অথচ পাকিস্তানের বাস্তবতা ছিল এই যে, সে দেশের পূর্বাংশে এবং গোটা দেশ মিলিয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই ছিল বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি লোকের ভাষা ছিল পাঞ্জাবি, আর মাত্র চার শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হয়েও বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে না এটা পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। তখন চাকরির সুযোগ বলতে সরকারি চাকরিই ছিল। কিন্তু উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে সরকারি চাকরি বা সেনাবাহিনীতে চাকরি পেতে বাঙালিদের উর্দু শিখতে হবে, উর্দুভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে- ফলে তাদের ডিসঅ্যাডভান্টেজ হয়ে যায়। ফলে ছাত্রদের জন্য এটা ছিল ভবিষ্যতের প্রশ্ন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে। পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, রাষ্ট্র ভাষা ছিল উর্দু হলে তাদের অস্তিত্বই একটা সময় বিপন্ন হতে পারে। আর তাই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাঙালির মধ্যে জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হয়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭