ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

এরদোয়ান ভূমিকম্পের এক বছর পরে পুনঃনির্মাণে কতটা সফল


প্রকাশ: 19/02/2024


Thumbnail

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩ যে বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল তুরস্কে সেই ধ্বংসযজ্ঞের এক বছর পেরিয়ে গেছে। ভয়াবহ সেই ভূমিকম্পের ক্ষত বছরের পর বছর ধরে বয়ে বেড়াতে হবে দেশটিকে। পর পর আঘাত হানা একজোড়া শক্তিশালী ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫৩,৫৩৭ জন মানুষ, গৃহহীন হয়েছিলেন আরও ৩০ লাখ বাসিন্দা। ভূমিকম্পে তুরস্কের ৩টি শহর প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। বিধ্বস্ত হয় হাজার হাজার গ্রাম, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও ১১টি শহর ও ১২৪ টি জেলা। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের পর স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল তুরস্কসহ গোটা বিশ্ব। তুরস্ক তার সবটুকু দিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ তুরস্কের সহায়তায় এগিয়ে আসে। ভূমিকম্পের পরেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট দেশের মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি দেশের সবকিছু দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের চেষ্টা করবেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি সবকিছু করবেন। ভূমিকম্পের এক বছর পর তুরস্ক সেই ক্ষতি কতটুকু কাটিয়ে উঠতে পেরেছে এবং পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কীভাবে চলছে তা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার গণমাধ্যম আইওএল-এ নিবন্ধ লিখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত তুরস্কেররাষ্ট্রদূত আয়েশাগুল কান্দাস।
 
ভূমিকম্পের ঠিক পরেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা শুরু করে আমাদের সরকার। ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা এবং তার মধ্য থেকে মৃতদেহ ও বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে উদ্ধার করে আনা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। উদ্ধারকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর বেঁচে থাকা মানুষদের খাবার, চিকিৎসা ও প্রাথমিক চাহিদাগুলো সরবরাহ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে আমাদের সরকার। আন্তর্জাতিক সহায়তা পাই আমরা, দেশের মধ্য থেকেও সব ধরনের ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে তুর্কি জনগণ।

সেদিন কী ঘটেছিল এবং আমাদের জীবন ও স্বপ্নগুলো কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল তা আজ একবছর পরেও এক মুহূর্তের জন্য আমরা ভুলিনি। ভবিষ্যতেও কখনো আমরা এই দিনগুলো ভুলতে পারব না। সেই বিপর্যয়ের ঠিক পরে ভূমিকম্প অঞ্চল থেকে নেওয়া ড্রোন ফুটেজগুলোর দিকে তাকালে আমাদের মাথা নত হয়ে আসে।

ভূমিকম্পের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের সকলকে নত করেছে। সেই ধ্বংসলীলা এতটাই বিশাল ছিল যা কল্পনাও করা যায় না। ভেবে দেখুনতো, জার্মানির বার্লিন থেকে পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহর পর্যন্ত ৫শ কিলোমিটারেরও বেশি জুড়ে শুধু বিধ্বস্ত ভবনগুলো পড়ে আছে। ভূমিকম্পে ৯ লাখ আবাসন যুক্ত ৩,১৩০০০ বিল্ডিং ধ্বসে পড়ে। ১০০ মিলিয়ন ঘনমিটার ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে যা দিয়ে পুরো ম্যানহাটন শহরকে প্রায় ৭ ফুট উঁচু কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ঢেকে দেওয়া যথেষ্ট।

ভয়াবহ সেই ধ্বংসযজ্ঞের পর অঞ্চলগুলোর পুনঃনির্মাণে আমাদের সরকার দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি টেলিভিশন পত্রিকায় এলাকাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের আবাসন প্রদানের প্রক্রিয়া কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা দেখানো হয়। ২০২৩ সাল ছিল আমাদের প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। আর সে বছরেই আসা মারাত্মক এই আঘাতকে আমাদের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ‘শতাব্দীর বিপর্যয়’ হিসাবে সঙ্গায়িত করেছেন।

তুরস্ক যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে- কোনো দেশের জন্যই তা নিজস্বভাবে প্রশমিত করার ক্ষমতার নাগালের বাইরে। সৌভাগ্যক্রমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে অনেক নির্ভরযোগ্য বন্ধু রয়েছে আমাদের। তাদের কাছ থেকে আমরা যথাসম্ভব সহযোগিতা পেয়েছি।

ভূমিকম্পের ঠিক পরে একটি পুরো জাতি যেভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল আমরা তার থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি। আমরা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমরা এখন পুনঃগঠন ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা এখন নিজেদের দিকে তাকালে স্বস্তি পাই, আমরা হেরে যাইনি।

ভূমিকম্পে স্কুল, হাসপাতাল এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাগুরেঅ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। বিশেষ করে শিশু এবং মহিলারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চিকিৎসা পরিষেবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় ২ লাখ গর্ভবতী নারী যাদের মাতৃস্বাস্থ্য পরিষেবার প্রয়োজন ছিল তারা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ৭টি পারিবারিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র একটি (সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে) কার্যকর ছিল।

মানবিক প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে সরকারের নেতৃত্বাধীন সংস্থাগুলো। ভূমিকম্পের পরপরই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন দলকে নিয়োগ করা হয়। এধরনের বিপর্যয় যাতে আবারও না ঘটে সেজন্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের ভবনগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয় সেগুলো যথেষ্ট টেকসই কি না। প্রয়োজনে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয়৷ ভূমিকম্প অঞ্চলের পুনর্গঠন এবং ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমরা আমাদের রাষ্ট্র ও জাতির সমস্ত কিছুকে একত্রিত করেছি। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দলগুলো এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করছেন এবং পুনর্গঠন কাজ তত্ত্বাবধায়ন করছেন।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর পুনর্গঠনের জন্য বিপুল সম্পদ উৎসর্গ করেছে সরকার। ২০২৩ সালে জিডিপির প্রায় ৩.৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে। তার পরেও এসব অঞ্চলের মানুষের স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসা এখনও অনেক দূরের কল্পনা।

কমপক্ষে ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ শীতকাল অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে কাটিয়েছে। ৪১৪টি ইমার্জেন্সি ‘কন্টেইনার শহর’ নির্মাণ করে মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার পরেও বহু মানুষ এখনও ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি বা তাঁবুতে বসবাস করছেন। স্যানিটেশন এবং অন্যান্য জরুরি পরিষেবারও ঘাটতি রয়েছে।

অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলেন পঁয়ত্রিশ হাজার উদ্ধারকর্মী। প্রায় ১২ হাজার বিদেশি উদ্ধারকর্মীও কাজ করেছেন। এটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম অনুসন্ধান, উদ্ধার এবং পুনরুদ্ধার অভিযান। ধ্বংসাবশেষ অপসারণ এবং পুনর্গঠন কাজের দ্রুততম উদাহরণও এটি।

ভূমিকম্পে ধসে পড়া বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৮৩,০০০ ভবনের ৯৫% ধ্বংসাবশেষ সফলভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আবাসন ও কর্মক্ষেত্র নির্মাণ প্রকল্পগুলো এখনও চলমান। তুর্কি সরকারের গৃহীত প্রকল্পের আওতায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর পুনরুজ্জীবিত ও সংস্কার অব্যাহত থাকবে। যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া বাড়িগুলো তাদের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে ভূমিকম্প অঞ্চলজুড়ে ৭৫ হাজার ফ্ল্যাট বিতরণ সম্পন্ন করা হবে এবং চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাসস্থান সরবরাহের পরিমাণ হবে ২ লাখ।

আমরা আমাদের ক্ষত সারাতে শুরু করেছি এবং মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে আসছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমাদের নাগরিকরা সরকারের ওপর আস্থা রাখে। সর্বোপরি আমরা আমাদের মনোবল উচ্চ রাখছি এবং আমরা একটি ভালো ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী। একটি জাতি হিসাবে আমরা এই কষ্টগুলো কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭