ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

ভারত মহাসাগরের সমীকরণ পাল্টে দেবে মালদ্বীপ?


প্রকাশ: 20/02/2024


Thumbnail

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে এখন ভারত-চীন-মালদ্বীপ সম্পর্ক। ভারত মহাসাগরের একেবারে কেন্দ্রে থাকা মালদ্বীপে দুই দেশের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বহু আগে থেকেই। দেশটিতে ক্ষমতায় কে থাকছেন, তার ওপর নির্ভর করে চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মালেতে নির্বাচনী ডামাডোল শুরুর পর থেকেই পুরো সময়টা নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের নজর ছিল; দেশটির নির্বাচনে কে আসছেন ক্ষমতায়? মালদ্বীপের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, এখানে বেশিরভাগ সময়ই ভারতপন্থি সরকার ছিল। চীনপন্থি সরকার ছিল মাত্র দুবার। এবারের নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন চীনপন্থি মুইজ্জু। আর মুইজ্জু আসা মাত্রই মালদ্বীপ ঘিরে দুই দেশের রাজনীতির পালে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।
কারণ, মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পরই মালদ্বীপের ‘বড় দাদা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের সঙ্গে চলছে সম্পর্কের টানাপোড়েন। আর এই সুযোগে মালের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে বেইজিং। ‘ইন্ডিয়া আউট, চাইনা ইন’- মালদ্বীপের সাম্প্রতিক এই রাজনৈতিক পরিবর্তনে চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে ভারত মহাসাগরের ভূরাজনৈতিক ইস্যু।  
 
বিশেষ করে, এই সাগর ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার দুই শক্তিশালী দেশ ভারত ও চীনের ভূরাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা, ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। যে কারণে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটি চীন-ভারত দুই দেশেরই আগ্রহের ক্ষেত্র। এমনকি বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রেরও।

মালদ্বীপের প্রতি চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের অন্যতম কারণ হলো ভারত মহাসাগরে এর ভূকৌশলগত অবস্থান। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রটি সমুদ্রপথের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপ আন্তর্জাতিক শিপিং লেন এবং সি লাইন অব কমিউনিকেশন এর গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে অবস্থিত। যার মাধ্যমে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ তেল এবং এর অর্ধেক কন্টেইনার পরিবহন করা হয়।  
 
‘সি লাইন অব কমিউনিকেশন’ বলতে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটগুলোকে বোঝায়। যেখান দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন হয়। ভারত মহাসাগরকে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান মহাসড়ক হিসেবে দেখা হয়। মালদ্বীপ ভৌগোলিকভাবে পশ্চিম ভারত মহাসাগরের এডেন উপসাগর ও হরমুজ প্রণালী এবং পূর্ব ভারত মহাসাগরের মালাক্কা প্রণালীর মধ্যে ‘টোল গেট’ হিসেবে কাজ করে। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের এই কৌশলগত সামুদ্রিক অবস্থানই দেশটিকে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
 
মালদ্বীপ এবং ভারতের স্বার্থ
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-মালদ্বীপ মিত্রদেশ হিসেবেই পরিচিত। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে মাত্র ৩০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মালদ্বীপ। আর ভারতের লাক্ষাদ্বীপ থেকে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে। ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।  
 
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতই প্রথম মালদ্বীপকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭২ সালে মালেতে দূতাবাস স্থাপন করে। মালদ্বীপ কৌশলগতভাবে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মালদ্বীপ যেহেতু পশ্চিম ভারত মহাসাগরের দুটি চোকপয়েন্ট এবং পূর্ব ভারত মহাসাগরের মালাক্কা প্রণালীর মধ্যে ‘টোল গেট’ হিসেবে কাজ করে, তাই গুরুত্বপূর্ণ এই সামুদ্রিক বাণিজ্য রুট দিয়ে ভারতের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ এবং জ্বালানি আমদানির ৮০ শতাংশ পরিবহন হয়ে থাকে।  

নির্বিঘ্নে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য মহাসাগরে নিরাপত্তা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্যই মালদ্বীপকে নিজের বলয়ে রেখে এই পথে নিশ্চিন্তে বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারছে ভারত। তাছাড়া, নিজেদের স্বার্থেই দেশটির সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারও করেছে নয়াদিল্লি। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত মহাসাগরে চীনা আধিপত্য ঠেকাতে মালদ্বীপকে ভারতের অন্যতম ‘হাতিয়ার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
 
মালদ্বীপ এবং চীনের স্বার্থ

নয়াদিল্লির মতো ভারত মহাসাগরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে জোর দিয়েছে বেইজিংও। চীনের জন্য ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব অনেক। জ্বালানি তেলের জন্য চীন ভারত মহাসাগরের সি লাইনস অব কমিউনিকেশনের ওপর নির্ভরশীল। জ্বালানি সম্পদ আমদানি নিশ্চিত করতে চীন দুটি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘মুক্তার মালা’ (String of Pearls) এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ হচ্ছে চীনের সেই পরিকল্পনার অংশ।  
 
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে কাজ করছে চীন। যে কারণে চীন তার মুক্তার মালায় মরিশাস, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে যুক্ত করছে। মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও তাই।
 
মালদ্বীপে চীনের উপস্থিতি প্রকাশ্যে আসে ২০০৯ সালের পর থেকে। এরপর ২০১১ সালে মালদ্বীপে দূতাবাস খোলে বেইজিং। সেসময় মালদ্বীপের রাজনীতিতে চলছিল অস্থিতিশীলতা। ২০১২ সালে গণবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ নাশিদ পদত্যাগ করলে ২০১৩ সালে মালদ্বীপে ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম ক্ষমতায় আসেন। এরপর নয়াদিল্লি ও মালের দূরত্ব তৈরি হয়। ঠিক সেই সুযোগটি কাজে লাগায় চীন। মালদ্বীপে চীনের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ বাড়তে থাকে।  
 
মহাপ্রাচীরের দেশটি যখন আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য বাড়াতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচি হাতে নেয়, তখন বেইজিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে মালদ্বীপ। মালদ্বীপের পাশ দিয়ে চীনের সঙ্গে ইউরোপ ও আফ্রিকার জাহাজ-যোগাযোগের প্রাচীন সমুদ্রপথটি তখন ‘গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।  

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে সাগরপথে চীন যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তার প্রায় ৬২ শতাংশ পরিবহন করা হয় মালদ্বীপের পাশ দিয়ে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে সঙ্গে  ভারত সাগর ও মালদ্বীপে ভারতের প্রভাব ঠেকাতে মালেকে কাছে টানা বেইজিংয়ের জন্যও গুরুত্বের। তাই, ইয়ামিন আব্দুলও মালের উন্নয়নে চীন থেকে কোটি কোটি ডলার অনুদান ও ঋণ পেতে শুরু করেন।  
 
২০১৬ সালে চীনের দেয়া ৮০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে মালদ্বীপের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করা হয়। রাজধানী মালের কাছে হুলহুমালে দ্বীপ কৃত্রিমভাবে সম্প্রসারিত করে সরকারি আবাসন প্রকল্পের অধীনে বহু অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করা হয়। আর সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠে ‘চীন-মালদ্বীপ মৈত্রী সেতু’। চীনের দেয়া প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় এই সেতু তৈরিতে। সম্প্রতি, মুইজ্জুর বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক সফলতা হিসেবেও দেখছেন অনেকে।
 
মালদ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এশিয়ার ছোট দেশটি ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মালদ্বীপের দূরত্ব প্রায় ৯ হাজার ৫৫৭ মাইল। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে মালদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থটা কী? সেই ভারত মহাসাগরই।  
 
ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান এবং দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এই দিয়েগো গার্সিয়া থেকে নৈকট্যের কারণে ক্ষুদ্র এই দেশটিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক কিছু। ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব ঠেকাতে মালদ্বীপকে হাতে রাখা প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রেরও।  
 
মালদ্বীপের কৌশলগত গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করে। এটা ছিল ভারতের বাইরে কোনো দেশের সঙ্গে মালদ্বীপের প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি। ২০২০ সালে মালদ্বীপ সফরে গিয়ে সেখানে মার্কিন দূতাবাস খেলার ঘোষণা দেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।  
 
মালদ্বীপ ইন্দো প্যাসিফিকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায় দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার জন্য আগ্রহের। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মুইজ্জুর ‘চীনপ্রীতি’ পাল্টে দিতে পারে এই অঞ্চলের সমীকরণ।





প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭