ইনসাইড পলিটিক্স

ঘুরে দাঁড়াতে সাংগঠনিক পদক্ষেপ শুরু বিএনপির


প্রকাশ: 02/03/2024


Thumbnail

সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে দল পুনর্গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আংশিক কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করল দলটি।

রাজপথের আন্দোলন সফলে ছাত্রদলের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল থাকায় বিগত আন্দোলনে রাজপথে ছাত্রদল বিশেষ করে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বের ‘হতাশাজনক’ পারফরম্যান্সে খুবই ক্ষুব্ধ ছিল বিএনপির হাইকমান্ড। তাই আন্দোলনের দুই মাসের মধ্যেই ভেঙে দেওয়া হলো ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামীর আন্দোলন ঘুরে দাঁড়াতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দলসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। এ ক্ষেত্রে পুরো নেতৃত্ব বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সংগঠনগুলোর।

এসব সংগঠনে আগামীতে কাদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনা যায় এবং কমিটির বর্তমান শীর্ষ নেতাদের কোথায় পদায়ন করা হবে, সেগুলো নিয়ে এখন কাজ চলছে দলের মধ্যে। এই বিষয়গুলো চূড়ান্ত হলেই পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কমিটিই বিলুপ্ত করে নতুন নেতৃত্বে অঙ্গসংগঠনগুলো সাজানো হবে। দীর্ঘ সময় ধরে চলবে এই প্রক্রিয়া।

সূত্রের দাবি, বিএনপির অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ হলে মূল দল পুনর্গঠনে হাত দেওয়া হতে পারে। নতুন লোক দিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে। স্থায়ী কমিটিতে পাঁচটিসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রায় ১৩০টি পদ এখন শূন্য। তবে অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠনের মধ্যেও এই প্রক্রিয়া চলতে পারে।

জানা গেছে, সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির দুটি শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় দলের কয়েকটি বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও পরিবর্তন আনা হতে পারে।

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে বিএনপি বছরের অধিক সময় ধরে রাজপথে আন্দোলন করলেও চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। বিএনপির বর্জন ও আন্দোলনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় নির্বাচনের পরই আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে নামে বিএনপির হাইকমান্ড।

দলটির মূল্যায়নে উঠে আসে, ছাত্রদলসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি। এমন মূল্যায়নের ভিত্তিতে আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে নিষ্ক্রিয় সংগঠনগুলো পুনর্গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় হাইকমান্ড।

এরই মধ্যে এ পুনর্গঠনের রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর অংশ হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনে ব্যর্থতায় বিএনপির সাংগঠনিক অ্যাকশন শুরু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

ছাত্রদলের নতুন কমিটি: গতকাল শুক্রবার (১ মার্চ) ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিয়ে রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি ও নাসির উদ্দীন নাসিরকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭ সদস্যের আংশিক কমিটি অনুমোদন দিয়েছে বিএনপি। বিকেলে দলীয় প্যাডে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের নেতৃত্বাধীন ছাত্রদলের বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদের ৭ সদস্যের নতুন আংশিক কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে। নবগঠিত কমিটিতে আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে সিনিয়র সহসভাপতি, শ্যামল মালুমকে সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আমান উল্লাহ আমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক, মোহা. জাহাঙ্গীর আলমকে দফতর সম্পাদক এবং শরীফ প্রধান শুভকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।

একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিও ভেঙে দিয়ে গণেশ চন্দ্র রায় সাহসকে সভাপতি ও নাহিদুজ্জামান শিপনকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের আংশিক কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মাসুম বিল্লাহ সিনিয়র সহসভাপতি, আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক সহসভাপতি, নাসির উদ্দীন শাওন সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শামীম আখতার শুভ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং নুর আলম ভূঁইয়া ইমন সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের নতুন কমিটি অনুমোদন দেয় বিএনপি।

জানা গেছে, ছাত্রদলের নতুন কমিটির নেতারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। কেউ কেউ এখনো মাস্টার্সে (বিশেষ) অধ্যয়নরত। এর মধ্যে সভাপতি রাকিব ও সিনিয়র সহসভাপতি আফসান ২০০৬-২০০৭, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির ২০০৭-০৮, সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান ও যুগ্ম সম্পাদক শরীফ ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী।

ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের মতে, ত্যাগী ও যোগ্যদের সমন্বয়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়া হয়েছে। মাঠের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, বিগত সময়ের বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত ভালো কমিটি হয়েছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ও ঢাবি কমিটির শীর্ষ পদপ্রত্যাশী কয়েকজন নেতা তাদের অবমূল্যায়নেরও অভিযোগ তুলেছেন। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের দাবি, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে নিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা উচিত।

ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব কালবেলাকে বলেন, আমরা মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে মাঠে আছি। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত মাঠে থাকব। একই সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করব। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির বলেন, দেশের হারানো গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার এবং খালেদা জিয়াকে মুক্তির লক্ষ্যে একদফার আন্দোলনে ছাত্রদল সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায়।

ছাত্রদলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃতির মাধ্যমে সংগঠনকে আরও সম্প্রসারিত করা হবে। চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রদলের নতুন নেতারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন।

জানা গেছে, বিগত আন্দোলনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির পারফরম্যান্সেও অসন্তুষ্ট হাইকমান্ড। দলের দায়িত্বশীল অনেক নেতা মনে করেন, রাজধানী ঢাকার রাজপথে এই দুটি সংগঠন প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দেখাতে না পারায় ২০১৪ সালের মতো এবারের আন্দোলনও চূড়ান্ত সফলতা পায়নি। একই মূল্যায়ন দলেরও। তবে এটা সত্য, পুরো আন্দোলনজুড়ে মূল নেতৃত্বকে পায়নি উত্তর বিএনপি। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান গত ১০ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। আমান কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়।

এরপর বিএনপির আন্দোলনের মধ্যে গত ২ নভেম্বর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হককে গুলশান-২ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার বিরুদ্ধে একে একে ১২টি মামলা দায়ের করা হয়। নির্বাচনের পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি।

নেতাকর্মীরা মনে করেন, মহানগর উত্তর বিএনপির মূল নেতৃত্ব কারাগারে থাকায় ফরহাদ হালিম ডোনার হঠাৎ নেতৃত্বে এসে আন্দোলনে ঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারেননি। আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে তার চোখে কিছু অসামঞ্জস্যতা ধরা পড়ে, যেটা তিনি সম্প্রতি দলের হাইকমান্ডকে অবহিত করেছেন বলে জানা গেছে। তবে অনেকে মনে করেন, উত্তরের মূল নেতৃত্ব বাইরে থাকলে আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমন্বয়হীনতা, অসামঞ্জস্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এমন পরিস্থিতিতে আমিনুল কারামুক্ত হওয়ার পর মহানগরের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দেয় বলে উত্তর বিএনপিতে আলোচনা আছে। একপর্যায়ে ডোনার পদত্যাগও করতে চেয়েছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি।

এদিকে বিএনপির চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন শুরুর পর থেকে মহানগর দক্ষিণ বিশেষ করে আহ্বায়ক আব্দুস সালামের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আন্দোলনজুড়ে তিনি কোথায় ছিলেন, নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা তা জানেন না বলে সংগঠনে আলোচনা আছে। এমনকি নির্বাচনের পর এখনো তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ঘটনায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সালামের ব্যাপারে ব্যাপক অসন্তুষ্টি রয়েছে। তবে আন্দোলন চলাকালীন তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে মহানগর দক্ষিণ বিএনপি ও অধীন বিভিন্ন থানার সংশ্লিষ্ট নেতাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন বলে তার ঘনিষ্ঠদের দাবি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭