ইনসাইড বাংলাদেশ

বিষ ও ভেজাল খাদ্য নীরব গণহত্যা:পরিজা


প্রকাশ: 08/03/2024


Thumbnail

বর্তমানে দেশে বিষ ও ভেজাল খাদ্যের আধিক্য এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে এক নীরব গণহত্যার সৃষ্টি হয়েছে। এমন কোন পরিবার নেই  যেখানে আজ ভেজাল খাদ্য দ্বারা আক্রান্ত-ভুক্তভোগী মানুষ নেই। জাতি এই ভেজাল ও বিষ থেকে মুক্তি চায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা)। 

শুক্রবার (৮ মার্চ) সকাল ১১টায় পুরান ঢাকার চকবাজার শাহী জামে মসজিদের সামনে ইফতারসহ সকল খাধ্য বিষ ও ভেজালমুক্ত চাই এই দাবিতে এক মানববন্ধনে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। 

পরিজার সভাপতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হাসানের পরিচালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পরিজার সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল, সহ-সভাপতি ও লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী তানইয়া নাহার, মানবাধিকার কর্মি অপূর্ব কুমার দাশ, পরিজার নির্বাহী কমিটির সদস্য মো: সেলিম, সাংবাদিক কাজল আব্দুলাহ, গবেষক স্বপর্যা আকাশলীননা মৌনী, পুরান ঢাকার সুবন্ধন সামাজিক কল্যাণ সংগঠনের শওকত হোসনে বান্টী, বাংলাদেশ নদী বাচাঁও আন্দোলনের শাকিল রহমান, সচেতন নগরবাসীর জিএম রুস্তম খান প্রমূখ নেতৃবৃন্দ। মানববন্ধনে পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ১০টি সংগঠন সংহতি জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, পবিত্র রমজান মাসে বিভিন্ন খাদ্যপণ্য বিশেষ করে ইফতারিতে যেসমস্ত খাদ্যপণ্য বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর আমদানি, উৎপাদন, মজুতকরণ, বাজারজাতকরণ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে চলছে। অসাধু শিল্পপতি, উৎপাদনকারী, কৃষক, ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, মজুতদার, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা অধিক মুনাফার লোভে এসব খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভেজালের মিশ্রণ করে থাকে। যা আমাদেরকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং আগামী প্রজন্ম বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বড় হচ্ছে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিষ ও ভেজালমুক্ত এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রকে আমরা এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে দেখছি না। আর আমরা বঞ্চিত হচ্ছি বিষ ও ভোজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে। এমন কোন খাদ্যদ্রব্য নেই যাতে নীরব ঘাতক বিষাক্ত বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশানো হয় না। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি রয়েছে। ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিকের সহজপ্রাপ্যতা এবং আইন প্রয়োগ ও যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে।

মানববন্ধনে বক্তারা আরও বলেন, শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ- মাংস, দুধ, মিষ্টি, প্যাকেটজাত খাদ্য ও পানীয়সহ প্রায় সব ধরনের খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো  হয়। ফল ও তরিতরকারি দ্রæত বৃদ্ধির জন্য অৎঃরভরপধষ ঐড়ৎসড়হব এৎড়ঃিয, কীট পতঙ্গ প্রতিরোধে নিষিদ্ধ বিষাক্ত কীটনাশক এবং তাজা ও সতেজ, অপচনশীল, পোকা মাকড়মুক্ত রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল কৃত্তিম উপায়ে পাঁকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশন প্রয়োগ করা হয়। মাছে ফরমালিন, মুড়িতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত বোতল ও প্যাকেটজাত খাদ্য যেমন শরবত, ফলের রস, জ্যাম-জেলীতে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিতে কৃত্রিম চিনি, কাপড়ের রং প্রয়োগ করা হয়।

রমজান মাসে ইফতারিতে যেসব খাদ্যপণ্যের সবচেয়ে বেশী চাহিদা সেগুলো হলো শরবত, খেজুর, ছোলা, মুড়ি, বেসন, ডাল, তৈল, চিনি, দুধ, সেমাই, মুরগী, মাছ, দেশী-বিদেশী ফল, শসা, টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, আটা, ময়দা, ইত্যাদি। রমজানের বাজার ধরার লক্ষ্যে এসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও মজুত করতে বিষাক্ত কেমিক্যাল, অৎঃরভরপধষ ঐড়ৎসড়হব এৎড়ঃিয, ফরমালিন ও মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এন্টিবায়োটিক ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তৈল ও মবিল মিশ্রিত তৈল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তৈল বার বার ব্যবহার করার ফলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তৈল তৈরী করা হয়। সেমাইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই উৎপাদন এবং তাতে রাসাযনিক দ্রব্য মিশানো হচ্ছে। খেজুরে মিশানো হচ্ছে ফরমালিন। এছাড়াও পঁচা-বাসীসহ বিভিন্নভাবে ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতা বেড়ে যায়।

জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের ২০১৯ সালের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে থেকে সংগৃহীত খাদ্য নমুনার ৫২ শতাংশ দূষিত। বিআইডিএস গবেষণা তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। দূষিত খাবারের প্রভাবে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল। দীর্ঘদিন বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে গর্ভবতী মা ও তার পেটের ভ্রæনের ক্ষতি হয়, সন্তানও ক্যান্সার, কিডনীসহ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। গর্ভবতী নারীরা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু, গর্ভস্থ শিশু স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকাও থাকে। এক তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশের  ১৬ -২২ ভাগ মানুষ কিডনী রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি বছর প্রতি ১০ লাখে ২০০-২৫০ জন মানুষ কিডনী অকৃতকার্যতার শেষ পর্যায়ে পৌছায়। প্রতিমাসে ক্যান্সার, কিডনী ও লিভার রোগী দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলেই কিডনী রোগ হচ্ছে।

বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও রয়েছে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় সংসদ কর্তৃক সুনিদিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার যথাযথ উদ্যোগ ও অঙ্গীকারের অভাব, বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনুধাবনে ব্যর্থতার ফলে আমরা জনগণ এর কোন সুফল পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ধীরে ধীরে আমরা পংঙ্গু জাতিতে পরিণত হব।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭