এডিটর’স মাইন্ড

প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে আমলাতন্ত্রের বাঁধা


প্রকাশ: 08/03/2024


Thumbnail

একটা জরুরি কাজে সচিবালয়ে গেছি। কাজ শেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলাম, স্বাস্থ্য সচিব মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে দেখা করতে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় দেখলাম অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এলোমেলো হাটাহাটি করছেন। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের সভাপতি। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ৮২ বছর বয়সী এক প্রবীণ নাগরিক। সচিবালয়ের বারান্দায় তার বিভ্রান্ত হাটাহাটি দেখে একটু অবাক হলাম। কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে এরকম উদভ্রান্ত লাগছে কেন? সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর চোখে মুখে হতাশা, বিরক্তি এবং ক্ষোভ। বললেন, কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) নেই গত চার মাস। কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হবার উপক্রম। সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু কেউ কিছু করছেনা। এরপর তিনি যা বললেন, তা রীতিমতো উদ্বেগের। 

কমিউনিটি ক্লিনিককে আরও সচল এবং কার্যকর করতে প্রধানমন্ত্রী কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট আইন করেন ২০১৮ সালে। এই আইন অনুযায়ী ট্রাস্টের একজন চেয়ারম্যান থাকবেন। থাকবেন একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ই ট্রাস্টের মূল ব্যক্তি। তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম। আইন অনুযায়ী ট্রাস্টের ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ হবেন একজন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার আমলা। কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ট্রাস্টের সার্বক্ষণিক মুখ্য নির্বাহী হবেন। কিন্তু ট্রাস্ট গঠনের পর দেখা গেল ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ আমলাদের কাছে একটি অগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি প্রথম থেকেই হয়ে উঠলো একটি ‘ডাম্পিং পোস্ট’। কোন অতিরিক্ত সচিবই এই পদে যেতে আগ্রহী হননা। এটা যেন একটি শাস্তিমূলক পদায়ন। প্রথম থেকেই এই পদে নিয়োগ দেয়া নিয়ে শুরু হয় চোর পুলিশ খেলা। চাকরী জীবনে হতাশ, ম্লান, ম্রিয়মানদের বাছাই করে কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পাঠানো শুরু হয়। কে নিজেকে অযোগ্য বলতে চায়? তাই কেউই এই পদের জন্য কেউই আগ্রহী হন না। সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদোন্নতি পেয়ে চলে গেছেন গত নভেম্বরে। তারপর এই পদের পদায়ন নিয়ে চলছে রহস্যময় তৎপরতা। একজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব দায়িত্ব পালন করছেন। 

প্রথমত, তাকে আর্থিক ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কোন চেকে তিনি স্বাক্ষর করতে পারেন না। ফলে, অতিরিক্ত দায়িত্ব এমনিতেই অকার্যকর হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে একজন অতিরিক্ত সচিবের অনেক ব্যস্ততা থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি একটি পূর্ণকালীন, সার্বক্ষণিক দায়িত্ব। এরকম একজন ব্যস্ত ব্যক্তিকে এই অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে আমলাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন কমিউনিটি ক্লিনিক তাদের কাছে কত অবহেলিত এবং উপেক্ষিত। এরপর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান একজন সার্বক্ষণিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জন্য আমলাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেন। অবশেষে আমলা কর্তাদের সুমতি হয়। তারা বেছে বেছে একজন ভবিষ্যত হীন, পরিত্যক্ত অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু সেই অতিরিক্ত সচিবের চাকরীর মেয়াদ আছে মাত্র পাঁচ মাস। এই সময়ে তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন। এজন্য জনপ্রশাসন তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বদলী করলেও গত আড়াই মাসে তিনি সেখানে যোগদান করেননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও তাকে যোগ দেয়ার জন্য চাপ দেয়নি। ফলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়াই কমিউনিটি ক্লিনিক চলছে মাসের পর মাস। এ যেন ড্রাইভার ছাড়াই গাড়ী চলার মতো। 

একজন আমলাকে কোথাও বদলী করলে তিনি যদি সেখানে না যান তাহলে স্ট্যান্ড রিলিজ করার নিয়ম আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাও করা হয়নি। আমলাদের এতো উপেক্ষা কেন কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যাপারে? ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ প্রধানমন্ত্রীর ১০ টি উদ্যোগের একটি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে সব কারণে বিশ্বে আজ প্রশংসিত হচ্ছে, তার মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক অন্যতম। এই তো কিছুদিন আগে কমিউনিটি ক্লিনিক জাতিসংঘে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিসিয়েটিভ’ হিসেবে অনন্য স্বীকৃতি পেলো। এসডিজি অর্জনে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার সাফল্যে দেশের কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোর অবদান সর্বজন স্বীকৃত। বিশ্বের বিভিন্ন  দেশে জাতির পিতার চিন্তা প্রসূত শেখ হাসিনার উদ্ভাবিত এই মডেলের অনুকরণ হচ্ছে। বিদেশীরা এই মডেল নিয়ে আগ্রহী। শুধু আমলাদের কাছে এটি এক অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান। কথা ছিলো, ট্রাস্ট গঠিত হবার পর এর মাধ্যমেই কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ট্রাস্টকে কার্যকর করার কোন উদ্যোগ কারো নেই। টাকা পয়সা ট্রাস্টে দেয়া হয় যৎ সামান্য। কমিউনিটি ক্লিনিকের আসল চাবি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্তারা কমিউনিটি ক্লিনিককে মনে করেন অনাহুত প্রতিষ্ঠান হিসেবে। গত বছর অপারেশন প্ল্যানে কমিউনিটি ক্লিনিককে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হত্যা করেছিল। প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য প্রতিষ্ঠানটি অকার্যকর করার জন্য অপারেশন প্ল্যান থেকেই কমিউনিটি ক্লিনিককে বাদ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অপারেশন প্লানে কমিউনিটি ক্লিনিককে শেষ মুহুর্তে ওপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দুই দফা চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি কয়টি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছেন? প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিটি বক্তৃতায় কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা বলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তার কমিউনিটি ক্লিনিকের নাম উচ্চারণ করতেই যেন লজ্জা পান। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা বোঝা যায়, ট্রাস্ট গঠন কাঠামো দেখলেই। একজন সভাপতি ও সহ-সভাপতি ছাড়াও বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে আছেন, সচিব স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, সচিব স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ, সচিব অর্থ বিভাগ বা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিরা। কিন্তু এই আমলারা কিংবা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিরা কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতি কতটা সংবেদনশীল। কতটা সময় দেন? 

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল। বন্ধ করা হয়েছিল কমিউনিটি ক্লিনিকের অর্থায়ন। কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন গুলোতে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়াত। রাতে হতো নেশার আসর। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর বিএনপি নেতারা স্বীকার করেছিল কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। বিএনপি তাদের ভুল বুঝতে পারলেও, বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নের মহান দায়িত্ব দেন কাঁধে তুলে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা আমলারা। তিল তিল করে কমিউনিটি ক্লিনিককে অকার্যকর করার নীল নকশার বাস্তবায়ন চলছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক না দেয়া, অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া, ট্রাস্টের হাতে ক্ষমতা না দেয়ার মাধ্যমে আমলারা প্রমাণ করেছেন যে তারা প্রধানমন্ত্রীর এই অসামান্য উদ্যোগকে ব্যর্থ করতে চান। কমিউনিটি ক্লিনিককে হত্যা করতে চান। আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এটা জানেন যে, আমলা বা চিকিৎসা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা গরীব মানুষের প্রতিষ্ঠানকে বিকশিত হতে বাধা দেবে। কমিউনিটি ক্লিনিক কেবল একটি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান নয়, জনগণের ক্ষমতায়নের প্রতীক। রাষ্ট্র এবং জনগণের যৌথ উদ্যোগের এক অনন্য নজির। সাধারণ জনগণ এখনে জমি দেন, সরকার ভবন বানিয়ে দেন, স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করেন। কমিউনিটি গ্রুপ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে। এটি শুধু স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নয় রাষ্ট্র কাঠামোতে জন অংশীদারত্বের এক অনন্য উদহারণ। এটি আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষমতায়নের একটি মডেলও বটে। এই উদ্যোগ আমলারা বাঁধা দেবেই। এটা উপলব্ধি করেই প্রধানমন্ত্রী কমিউনিটি ক্লিনিকের চেয়ারম্যান হিসেবে এ দায়িত্ব দিয়েছেন এমন এক ব্যক্তিত্বকে যিনি নিবেদিত প্রাণ, সাহসী, উদ্যমী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদর্শের প্রতি যার অবস্থান পরীক্ষিত। 

২০০৭ সালের এক-এগারোর সময় যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবিচারের বিরুদ্ধে একাই হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদের প্রতীক। এরকম একজন উদ্যমী মানুষকে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান না করা হলে এতোদিনে  হয়তো এই অসাধারণ প্রতিষ্ঠানটি মৃত্যুর মুখে পতিত হতো। কিন্তু ৮২ বছর বয়সেও মোদাচ্ছের আলী ছুটে বেড়াচ্ছেন সচিবালয় থেকে রংপুর, চট্রগ্রাম থেকে দিনাজপুর। কমিউনিটি ক্লিনিককে বাঁচানোর এই যুদ্ধে কি হেরে যাবেন এই প্রবীণ মানুষটি? আমলাদের মধ্যে যারা প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা বের করেন। তেল আর স্তুতি ছাড়া কোন বক্তব্য শুরু করেন না, তারা নীরবে শুধু কমিউনিটি ক্লিনিকের ক্ষতি করছে না, প্রধানমন্ত্রীর সব উদ্যোগের বিরুদ্ধে আমলারা তৎপর। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ মুখ থুবড়ে পড়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প করার দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকলেও এমন নিম্নমানের বাড়ি বানানো হয়েছে যে এসব নিয়ে দু এক বছর পরেই সমালোচনা হবে। এখন আমলাদের এ নিয়ে আগ্রহ নেই। প্রধানমন্ত্রী প্রান্তিক জনগোষ্টীর জন্য যতো কর্মসূচী নিয়েছেন সব গুলোকে ব্যর্থ প্রমাণে আমলাতন্ত্র যেন বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে। জনগণের ক্ষমতায়ন হলে আমলারা চাকর-বাকরে পরিণত হবেন। এজন্যই কি প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে তাদের বাঁধা? 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭