ইনসাইড গ্রাউন্ড

স্বপ্ন দেখাই যার কাছে ছিল বাড়াবাড়ি সেই ইয়ারজানই সেরা


প্রকাশ: 11/03/2024


Thumbnail

এইতো কিছুদিন আগের কথা। সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ ও ভারত। যে ফাইনাল খেলায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল নাটকীয়তা। আবারও যেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো আজ সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে। তবে অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে দুই ফাইনালিস্টই জয়ী হলেও অনূর্ধ্ব-১৬ তে তা হয়নি।

সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র ছিল। টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। রোববার বিকেল সোয়া ৩ টায় নেপালের কাঠমান্ডুতে ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। ম্যাচের নির্ধারত সময়ের খেলা শেষ হয় ১-১ সমতায়। ভারতের হয়ে গোল করেন আনুশকা। অপরদিকে দলের সমতাসূচক গোল করেন বাংলাদেশের মরিয়ম।

শেষ পর্যন্ত কোনো গোল না হওয়ায় ম্যাচের ভাগ্য গড়ায় টাইব্রেকারে। যেখানে পেনাল্টি শুট আউটে ভারতের দিভানি লিনদার শটে গোল হলে ফাইনাল গড়াতো সাডেনডেথে। নেপালের কাঠমান্ডুর আনফা কমপ্লেক্সে তখন পিনপতন নিরবতা। দিভানি পারেননি লক্ষ্যভেদ করতে। আর তাকে ব্যর্থ করেছেন বাংলাদেশের গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগম।

দিবানির শট ঠেকিয়েই হাত উঁচিয়ে দৌড় দিলেন ইয়ারজান। তখন পুরো বাংলাদেশ দলের লক্ষ্য গোলরক্ষককে ছোঁয়া। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উদযাপনের মধ্যমনি হয়ে গেলেন তিনি।

কেবল ফাইনালেই দক্ষতা দেখানটি বাংলাদেশের গোলরক্ষক। টুর্নামেন্টজুড়েই দুর্দান্ত খেলেছেন। পেয়েছেন সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার। পুরস্কার হাতে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন এই কিশোরী। টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক এবং ফাইনালের সেরা পারফরমার। কেমন লাগছে আপনার?

জবাবে গোলরক্ষক ইয়ারজান বলেন, ‘আমার অনেক ভালো লাগছে। প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেললাম। সেরা গোলরক্ষক হওয়ার অনুভূতি অনেক। আমার কোচকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে এ পর্যন্ত আনার জন্য। অনেক খুশি আজকে আমি। প্রথমবারের মতো ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলে সেরা হলাম।’

সেরা গোলরক্ষক হওয়ার পুরস্কারকে তিনি উৎসর্গ করেছেন তার বাবা ও গোলকিপার কোচ আরিফুর রহমান পান্নুকে। এই উৎসর্গ করার কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। আর প্রতিক্রিয়াই দিতে পারেননি।

বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উদযাপনের মধ্যমনি ইয়ারজান বেগমের গল্পটাও পরিচিত। এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা আর দশটা কিশোরীকে যেমন প্রচুর বাধাবিপত্তি পেরিয়ে খেলাধুলা করতে হয়, ইয়ারজানকেও পেরোতে হয়েছে তেমন বাধার দেয়াল। পঞ্চগড় থেকে উঠে এসে সেই ইয়ারজানই এখন আলোচনার মধ্যমণি। নেপালে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভারতের তিনটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ‘বীর’ যে সে-ই।

ফাইনালের পর তার খুব করেই মনে পড়ছে বাবার কথা। তিনি বেশ অসুস্থ। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। আগে সংসার তিনিই চালাতেন। কিন্তু এখন কাজ করতে পারেন না। দুই মেয়েকে আর স্বামীকে নিয়ে সংসার চালান ইয়ারজানের মা। তিনি এখানে–ওখানে কাজকর্ম করেন। দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতোই অবস্থা ইয়ারজানদের পরিবারের।

এমন অবস্থায় ফুটবলার হতে চাওয়াটা অনেক সাহসের। সেই সাহস অবশ্য ইয়ারজানকে দেখিয়েছেন তার বাবাই, ‘আমি স্কুলে ফুটবল খেলতাম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আমার অনেক ঝোঁক। বাবা আমাকে সাহায্য করেছেন সব সময়ই। তিনিও চেয়েছেন, আমি যেন ফুটবল খেলতে পারি, আমি যেন আমার শখ মেটাতে পারি।’

কিন্তু গ্রামে সেই শখ মেটাতে চাওয়াও অনেক কঠিন। মানুষজন নানা কথা বলত। বাড়ির মেয়ে ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকে, এ কেমন কথা! নানাজনের নানা বাজে কথায় ইয়ারজানের ফুটবল খেলাই বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। এই সময় ত্রাতা হয়ে আসেন স্থানীয় ফুটবল কোচ আবু তালেব। আবু তালেবের একটা একাডেমি আছে। সেখানে বাচ্চাদের ফুটবল শেখান তিনি। মেয়েদেরও শেখান। ইয়ারজান জানালেন কীভাবে তাকে ফুটবলে এনেছেন আবু তালেব, ‘আবু তালেব আমার কোচ, তিনিই বাবাকে বলে তাঁর একাডেমিতে নিয়ে যান। বাবাও মানা করেননি। তিনি তো চাইতেনই আমি ফুটবলার হই। এই আবু তালেবকে আমি স্যার বলি না, বলি “ভাইয়া”। তিনি আমার ভাই।’

আবু তালেবের কারণেই যে এই পর্যায়ে আসা ইয়ারজান, সেটি স্মরণ করল শ্রদ্ধার সঙ্গেই, ‘তিনি না থাকলে আমি এখানে আসতে পারতাম না। তিনি বলতেন, অনেকেই বাজে কথা বলবে, আমি যেন কান না দিই। ভাইয়া বলতেন, “আমি তোকে ঢাকায় খেলাব। তুই নিশ্চিন্তে খেলে যা”।’

আমি মাত্র শুরু করলাম। যেতে হবে বহুদূর। আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। রুপনা আপুর (রুপনা চাকমা মেয়েদের জাতীয় দলের এক নম্বর গোলকিপার) মতো খেলতে চাই।

বাড়ি থেকে আবু তালেবের একাডেমিটা ছিল একটু দূরেই। অনেক সময় নাকি আসা-যাওয়ার ভাড়াও থাকত না ইয়ারজানের কাছে, ‘আমার কাছে সব সময় টাকা থাকত না। বাবাও দিতে পারতেন না। আবু তালেব ভাইয়াই নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। আমাকে বুট থেকে শুরু করে অন্য সরঞ্জামাদি কিনে দিয়েছেন।’

অনেক বাধা পেরিয়ে এই জায়গায় এসে ইয়ারজানের স্বপ্নটা এখন আরও বিস্তৃত, ‘আমি মাত্র শুরু করলাম। যেতে হবে বহুদূর। আমি জাতীয় দলে খেলতে চাই। রুপনা আপুর (রুপনা চাকমা মেয়েদের জাতীয় দলের এক নম্বর গোলকিপার) মতো খেলতে চাই। আমি বড় ফুটবলার হতে চাই।’

স্বপ্ন দেখাই যার কাছে বাড়াবাড়ি ছিল, অনেক লড়াই করে সেই স্বপ্ন ছোঁয়া ইয়ারজানের আরও বহুদূর যাওয়াটা হয়তো সময়েরই ব্যাপার।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭