ইনসাইড বাংলাদেশ

কক্সবাজারে ডুবোচর নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন বাসিন্দারা


প্রকাশ: 15/03/2024


Thumbnail

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে জেগে উঠেছে বিশাল এক ডুবোচর। ডুবোচরটি ভাটার সময় পানির উপর ভেসে ওঠে। তখন নৌকা নিয়ে কুতুবদিয়ার লোকজন ওই চরে গিয়ে খেলাধুলা করেন। এমনকি এই চরটি পানিতে তলিয়ে যায় যদি জোয়ার আসে।

এই ডুবোচরটি নিয়ে এলাকার মানুষের কৌতূহল রয়েছে ব্যপক। চরটিকে ঘিরে স্বপ্নও দেখছেন তারা।

এলাকাবাসির ধারণা, চরটিকে ঠিকমতো সংরক্ষণ করা গেলে কুতুবদিয়া হয়ে উঠবে পর্যটনের নতুন কেন্দ্র। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। গত তিন দশকে সমুদ্রের ভাঙনে বসতবাড়ি হারানো ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে।

তবে, এই ডুবোচরটি নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার।

তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়ার অনেক অংশ সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। একটা সময় তিনি খুদিয়ারটেক এলাকায় কয়েক হাজার বসতঘর ও লবণ মাঠ দেখেছেন। অথচ এখন কিছুই নেই। পলি জমে দ্বীপের পশ্চিমে যে বিশাল ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে, তা আগামী কয়েক বছরে পানির ওপরে (সব সময় দৃশ্যমান) চলে আসবে। তখন জোয়ারের পানিতেও চরটি আর ডুববে না। চরটি সাগরে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও নেই’।  

ডুবোচরটির পরীক্ষামূলক ভাবে বনায়ন করলে দেখা যায়,  কুতুবদিয়ার চারপাশে ৪০ কিলোমিটারের বেড়িবাঁধের ভেতরে বর্তমানে বসতি রয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার মানুষের। আগে কুতুবদিয়া উপজেলার আয়তন ছিল ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটি বিলীন হচ্ছে। এখন এর আয়তন প্রায় ৪৫ বর্গকিলোমিটারে। দ্বীপের নয়টি মৌজা ছিল। এর মধ্যে ২০-২৫ বছর আগে খুদিয়ারটেক ও রাজাখালী নামে দুটি মৌজা সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। সাত হাজার একর আয়তনের ওই দুটি মৌজার অন্তত ৪০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। পরে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায়।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, ‘পলি জমে দ্বীপের পশ্চিমে যে বিশাল ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে, তা আগামী কয়েক বছরে পানির ওপরে (সব সময় দৃশ্যমান) চলে আসতে পারে । তখন জোয়ারের পানিতেও চরটি আর ডুববে না। চরটি সাগরে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও নেই’।

২ মার্চ দ্বীপের পশ্চিমে বড়ঘোপ সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, নৌকা নিয়ে লোকজন অর্ধকিলোমিটার দূরে পশ্চিমে ডুবোচরে যাচ্ছেন। তখন সাগরে ভাটা। ডুবোচরের বেশির ভাগ অংশ পানির ওপরে দৃশ্যমান। কয়েকজন কিশোর-তরুণ নরম বালুচরে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠেছেন। কেউ সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরছেন। কেউ শামুক-ঝিনুক কুড়াচ্ছেন। চরের পশ্চিম ও উত্তর দিকের সাগরে মাছ ধরছে কয়েকটি ট্রলার।

জানা যায়, চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভাটার সময় উপকূলীয় বন বিভাগের কুতুবদিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ২৩ সদস্যের একটি দল ডুবোচরে গিয়ে প্রায় ৩০০টি বাইনগাছের চারা রোপণ করেন।

এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ডুবোচরটি ভাটার সময় ভেসে ওঠে, জোয়ারের সময় ডুবে যায়। তাই নরম বালুচরে পরীক্ষামূলকভাবে বাইনগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এই চারা পানিতে ডুবে গেলেও বাঁচতে পারে। গাছগুলো রক্ষা পেলে ডুবোচরে আরও গাছ লাগানো হবে’।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘ডুবোচর নিয়ে কুতুবদিয়ার মানুষের আগ্রহ ও চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকে চরটি ঘুরে এসেছেন। চরে ফুটবল ম্যাচও হয়েছে। দ্বীপের মানুষ পূর্বপুরুষের হারিয়ে যাওয়া ভূসম্পদ ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন’।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা ডুবোচর মানুষের মনে নতুন আশার জন্ম দিচ্ছে। অনেক আগের কুতুবদিয়ার হারিয়ে যাওয়া ভূমি (পলি) জমে জমে ভরাট হয়ে ডুবচরটির সৃষ্টি হচ্ছে। চরটিকে কাজে লাগাতে হলে চারদিকে বোল্ডার পাথরের উঁচু বাঁধ দিয়ে ভরাট করতে হবে, যেন জোয়ারের পানি না ঢোকে। তাহলে বিদেশি অর্থায়ন কিংবা বিনিয়োগে বিদেশি পর্যটকদের জন্য এখানে ‘বিশেষ পর্যটনপল্লি’ গড়ে তোলা সম্ভব হবে’।  

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বৈলেন, ‘চরটিকে কাজে লাগাতে হলে চারদিকে বোল্ডার পাথরের উঁচু বাঁধ দিয়ে ভরাট করতে হবে, যেন জোয়ারের পানি না ঢোকে। তাহলে বিদেশি অর্থায়ন কিংবা বিনিয়োগে বিদেশি পর্যটকদের জন্য এখানে ‘বিশেষ পর্যটনপল্লি’ গড়ে তোলা সম্ভব হবে’।

কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের হাজি মফজল মিয়া পাড়ার বাসিন্দা আবদুল ওয়াহেদ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাঁর ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। বাড়ির পশ্চিম পাশেই সমুদ্রসৈকত। ৮৫ বছরের এই জীবনে ৫০টির বেশি ঘূর্ণিঝড়, ২০০টির বেশি নিম্নচাপ-লঘুচাপ দেখেছেন তিনি।

সৈকতে দাঁড়িয়ে আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ‘সমুদ্রের তিন কিলোমিটার দূরে তাঁর বাড়ি ছিল। ছিল ৩০টির বেশি নারকেল গাছ। এখন সেখানে বড় বড় জাহাজ নোঙর ফেলে। সেখানে ডুবে গেছে ঐতিহাসিক বাতিঘরসহ হাজারো ঘরবাড়ি। যে ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তাঁদের হারানো ভূসম্পদের অংশ হতে পারে’।

জেগে ওঠা ডুবোচরের কাছে ৪০ বছর আগে পৈতৃক নিবাস ছিল বলে দাবি করেন বড়ঘোপ ইউনিয়নের লবণচাষি মোহাম্মদ মুছা। তিনি বলেন, ৬০ দশকের দিকে ঘূর্ণিঝড়ে তাঁদের ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ওই সময়ে বসতভিটাসহ জমি হারান ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ।

বড়ঘোপ ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, ১৯৬০ ও ১৯৯১ সালের বড় দুটি ঘূর্ণিঝড় হয়। এতে কুতুবদিয়ার ৩০-৪০ শতাংশ ভূখণ্ড সাগরে বিলীন হয়েছিল। তখন গৃহহীন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ কক্সবাজার শহরসহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭