ইনসাইড থট

পদোন্নতি, নববর্ষ বা জন্মদিনে বসকে ফুল দেয়া কি ভুল?


প্রকাশ: 15/03/2024


Thumbnail

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ফুল সাম্রাজ্যের মধ্যে তোলা এক ছবি নিয়ে দেশ যেন আজ দু'ভাগে বিভক্ত। একদল বলছেন, উপাচার্য কাজটি ঠিক করেননি।  তাঁকে কেন এত ফুল দেয়া হয়েছে ? ফুল দাতাদের আসল উদ্দেশ্য কি ? নিয়েছেন ভাল কথা। তিনি কেন এমন ঘটা করে ছবি তুলেছেন ? ছবি তিনি তুলতে পারেন। কিন্তু তিনি কেন আবার সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেছেন? আরেকদল বলছেন, একজন শিক্ষকের জীবনে উপাচার্য হওয়াটা স্বপ্নের মতন। তিনি উপাচার্য হয়েছেন, সবাই ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সে স্মৃতিগুলো ধরে রাখার জন্য তিনি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। তাতে দোষের কি ? কেন সবাই পরশ্রীকাতর ?

পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নব নিযুক্ত উপাচার্য ফেসবুকে একটি ছবি ছেড়েছেন।  ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুরো অফিস কক্ষটি ফুলের তোড়ায় ভরা। মাঝে তিনি বসা। ছবিটি ভাইরাল হবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতির দু'ভাগে বিভক্ত হবার লক্ষণ সুস্পষ্ট।

ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটিতে এবার দেশে ছিলাম। দুপুরের দিকে হঠাৎ করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার অফিসে গেছি। সংস্থাটির বড় কর্তা আমার পূর্বপরিচিত, ঘনিষ্ট। ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।  হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় ছিল। ভাবলাম, সময়টা এখানে কাটিয়ে যাই। সাক্ষাতটি পূর্ব নির্ধারিত নয়।  তাই প্রথমেই নিরাপত্তা ও অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিরা আমাকে ভৎসনা করলেন। আগে থেকে সাক্ষাৎকারের সময় না নিয়ে কেন এসেছি ? এদিকে আমি সমানে চেষ্টা করছি কর্তা ব্যাক্তির মোবাইলে। কখনো দেশি নাম্বার থেকে, কখনো আমার বিদেশী নাম্বার থেকে। অপর দিক থেকে সাড়া মিলছে না। নিরাপত্তারক্ষীদের নিজ পরিচয় দেয়ার পর বড় কর্তার অফিসের সাথে যোগাযোগ করে একজন আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।  

বড় কর্তার সাথে দেখা। তিনি প্রথমে ফোন না ধরার কারণ ব্যাখ্যা দিলেন। আজ ইংরেজি বছরের প্রথম দিন। সকাল থেকে দলে দলে আসছেন অধস্তনরা। ফুল দিচ্ছেন। তিনি নিচ্ছেন। কেক কাটছেন। ততক্ষনে তিনি ক্লান্ত। বিকেল চারটে বাজে। তখনও তিনি দুপুরের খাবার খাননি। আমি বসে থাকাকালীন বেশ কটি দল এসেছে ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়ে। ফুলে ফুলে 'গদখালি' বনে যাওয়া বিশাল ওই কক্ষে বসে ভাবছিলাম দেড় দশক যাবত আমি প্রবাসী। প্রবাসের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা আমি। বিগত পনেরো বছরে কোন ইংরেজি বা আরবি বছরের প্রথম দিনে সেদেশে এমন আদিখ্যেতা কেন দেখিনি ? আসলে দিন দুটিতে এখানে সরকারি ছুটি থাকে। পরদিন ? না, সেদিনও কোন আদিখ্যেতা নেই। দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বলে "হ্যাপি নিউ ইয়ার"।
 
বাংলা নববর্ষে দেশে ছুটি থাকে। তাই দেশের অফিস আদালতে এ ধরণের  আদিখ্যেতা চলে না।  ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটি সরকারি ছুটি ঘোষণা করলে অফিসের কর্তা ব্যাক্তিরা ঠিক সময়ে 'মধ্যাহ্নভোজ' করতে পারতেন। এসব আদিখ্যেতা থেকে রেহাই পেতেন। বছরের প্রথম দিনটিতে উর্ধতন থেকে অধস্তন সবাই ফুল দেয়া নেয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কাজ কাম তেমন হয় বলে মনে হয় না। তাহলে দিনটি ছুটি থাকলেই বা ক্ষতি কি ?

এবার বলি, দেড় দশকের প্রবাস জীবনে অফিসে জন্মদিন পালনের অভিজ্ঞতার কথা। হাঁ, এখানেও অফিসে জন্মদিন পালন করা হয়। কেক কাটা হয়। খাওয়া দাওয়া হয়। তবে এসব চলে শুধুমাত্র অফিসে মধ্যাহ্ন বিরতির সময়। অফিসের কাজের ক্ষতি করে নয়। শুধু জন্ম দিন নয়, কখনো কখনো জন্ম মাসও পালন করা হয়।  এই যেমন রোজা শুরুর আগের দিন মার্চ মাসে যে সব সহকর্মীর জন্মদিন তাঁরা মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেছেন। যাঁদের জন্মদিন, তাঁরা সব ব্যায় করে। যার জন্মদিন তিনি যদি বড় কর্তা হন, তাতে কি ? তিনিই খাওয়াবেন। যারা খাবে, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে উদ্যোক্তাদেরকে 'শুভ জন্মদিন' বলে উইশ করা। বড় জোর খুদে বার্তায় 'শুভ জম্মদিন' লেখা। ব্যাস, এ পর্যন্তই। কোন ফুলের তোড়া নেই। উপহার নেই। কোন আদিখ্যেতা নেই।

দেশে দেখি উল্টাটা। বড় কর্তার জন্মদিন হলে তো কথাই নেই। বড় কর্তার অফিস কক্ষটি সেদিন ফুলে ফুলে 'গদখালি' হয়ে যায়। হরেক রকমের কেকের প্রদর্শনী কক্ষ হয়ে যায়। বড় কর্তার কোন খরচ নেই। সব খরচ অধস্তনদের, তেলবাজদের। তেলবাজরা সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে কবে বড় কর্তার জন্মদিন। কবে বাড়ির আমগাছ থেকে আঙ্গুর পেড়ে এনে বড় কর্তাকে খাওয়াবে ! কবে বাড়ির পুকুর থেকে ইলিশ মাছ ধরে এনে বড় কর্তাকে খাওয়াবে ! এসব সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। অনেক দেশে বাধ্যতামূলক ছুটির বিধান রয়েছে। জন্মদিনে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক ছুটির ব্যবস্থা করা যায়। তাতে অফিস আদালতে তেলবাজদের দৌরাত্ম থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

এবার আসি, ভাইরাল হওয়া ছবিটি ঘিরে দ্বিধা বিভক্তি নিয়ে। এখানে লক্ষণীয়, যাঁরা কারনে বা অকারণে ফুল দিতে বা নিতে অভ্যস্ত তাঁদের বেশিরভাগ উপাচার্যের ফুলের ছবি কাণ্ডের পক্ষে। ছবিটি নিয়ে ট্রলকে তাঁরা পরশ্রীকাতরতা মনে করেন। না পাওয়ার বেদনা থেকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মনে করেন। আসলে কি তাই ? পদোন্নতি, নববর্ষ বা জন্মদিন উপলক্ষে যারা একজন কৃত মানুষকে ফুলের সাগরে ভাসাতে পারে, স্বার্থসিদ্ধির পরে তারা এমন কর্তাকে অথৈ সাগরে ডুবাতেও পারে। যাদের চারপাশে এত বেশী চাটুকার, মানুষ হিসেবে তারা কতটুকু স্বচ্ছ তা পরীক্ষা নিরীক্ষার দাবি রাখে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। 

লেখকঃ প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭