ইনসাইড থট

খোকা থেকে জাতির পিতা


প্রকাশ: 17/03/2024


Thumbnail

১৯৬১ সালে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি ইন্টারমিডিয়েটে সাইন্সে। তখন আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। তারা দুজনই আত্মীয়। এদের মধ্যে শহীদুল হক মুন্সি আমার খুব ঘনিষ্ট ভাগনা ছিলেন। সেই হিসেবে আব্দুর রাজ্জাকও আমাকে মামা বলতেন। নিউ এলিফ্যান্ট রোড়ে আমাদের বাসায় সবাই আসতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে আ স ম আব্দুর রব থেকে শুরু করে সবাই আসতেন। এভাবেই সমস্ত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। 

আমি যখন ঢাকা কলেজে তখন শহীদুল হক মুন্সি আমাকে বললেন তুমি এখানে ছাত্রলীগ কর। এখনকার মতো সে সময় এতো সহজ ছিল না। সেজন্য আমরা স্থানীয় ভাবে কমিটি গঠন করেছিলাম এবং নাম দিয়েছিলাম ছাত্রফ্রন্ট। তবে কমিটি করলেও আমি কোন পোস্ট নিতে পারি নাই। এরপর একদিন আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি আমাকে আরামবাগে শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার পর যে ব্যক্তিকে আমি সবচেয়ে বেশি সম্মান করি তিনি হলেন এই শেখ মনি। আমি উনার বাসায় যাওয়ার পর সামাল করি। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ি কোথায়? আমি বলি গোপালগঞ্জ। কোথায় ভর্তি হয়েছিস? ঢাকা কলেজে। কিসে? আমি বলি সাইন্সে। উনি আমাকে বলেন, সাইন্স অনেক কঠিন। খুব ভালো ভাবে লেখাপড়া করবি। কারণ তোর ব্যাকগ্রাউন্ড আমি রাজ্জাকের কাছ থেকে শুনেছি। লেখাপড়াই তোর একমাত্র মূলধন। সেদিন আমি খুব অবাক হয়ে যাই যে, সবাই যেখানে রাজনীতির ওপরই বেশি গুরুত্ব দেন, রাজনীতির কথাই বেশি বলেন সেখানে মনি ভাই আমাকে লেখাপড়ার প্রতি জোর দিতে বলেছেন। পরে আমরা উনার বাসায় খাওয়া দাওয়া করি। আসার সময় আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সিকে উনি বলেন যে, তাকে তোমরা মামার (বঙ্গবন্ধু) কাছে নিয়ে যাইস। 

এরপর একদিন আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি আমাকে ৩২ নম্বরে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে ছিলেন মুজিব ভাই। আমি যাওয়াতে বঙ্গবন্ধু খুব খুশি হয়েছিলেন। সম্ভবত, রাজ্জাক আমার সম্পর্কে উনাকে আগে থেকে বলেছিলেন। আমি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পায়ে সামাল করি। তিনিও জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ি কি গোপালগঞ্জ? আমি হ্যাঁ বলি। কোথায় ভর্তি হইছস? ঢাকা কলেজে। কিসে? সাইন্সে। সাইন্সে? এটা তো কঠিন সাবজেক্ট। তোমার ইচ্ছা কি? আমি বললাম আমার ইচ্ছা হল আমি ডাক্তার হব। তোর ইচ্ছার কথা মনে রাখবি আর এটা মনে রেখে পড়াশুনা করবি। বঙ্গবন্ধুর সেই কথা আমার ব্রেনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। এরপর লেখাপড়ায় মনোযোগী হলাম। বঙ্গবন্ধুও সেদিন রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না। তখন থেকেই আমার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু। তিনিই যেন আমার সবকিছু, আমার আদর্শ।যেহেতু আমরা জুনিয়র ছিলাম সেজন্য আমরা খুব একটা সুযোগ পেতাম না। যদিও বঙ্গবন্ধুর কাছে কোন সিনিয়র জুনিয়র ছিলেন না। কিন্তু তারপরও নিজের মধ্যে একটা দ্বিধা কাজ করতো। আব্দুর রাজ্জাক, শহীদুল হক মুন্সি তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে সন্তান মতোই ছিলেন। 

আমি ঢাকা কলেজে থাকতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। ভর্তি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন আবার জেলে থেকে বের হলেন একদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসলেন ছোট একটা গাড়িতে করে। তখন আমি মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে। তখন থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ডাক্তার হয়ে গেলাম। তিনি বলতেন, কিরে ডাক্তার কেমন আছিস? উনি যেহেতু রোগী দেখতে যেতেন ঢাকা মেডিকেলে আমরা উনার পেছনে পেছনে ঘুরতাম। উনার সাথে থাকতাম। উনি আমাদের যে আদর করতেন তাতে মনে এখনকার মানুষের মধ্যে সেই আদর নাই। বঙ্গবন্ধু আদর আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। আমার একটা স্মৃতি ভালো ভাবে মনে আছে আমি একবার গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিয়েছিলাম উনাকে। উনি তখন বললেন, আমি তো সামনে বসি। এরপর তো বঙ্গবন্ধু জেলেই বেশি থাকতেন, মনি ভাইও জেলে থাকতেন। আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি তারাও অনেক দিন জেলে ছিলেন। তখন জেলে থেকে চাদর সোয়েটার সহ অনেক কিছু দিত। আমাকে শহীদুল হক মুন্সি একটি চাদর দিয়েছিলেন। সেটা আমি অনেকদিন পড়েছি। এইভাবে তাদের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর ছিল। এদের সাথে ছাত্রলীগ করতাম। তখন ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের অবস্থান দ্বিতীয় ছিল। প্রথম সংগঠন ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তখনকার মতিয়া আপার বক্তৃতা না শুনলে বুঝা যাবে না কেন মতিয়া আপাকে অগ্নিকন্যা বলা হয়। তার ঢং, তার বক্তব্য, কন্টেন্ট আর সময় সবকিছু মিলিয়ে যেভাবে কানে বাজত এখন সে ভাবে কানে বাজবে না। অগ্নিকন্যা বলা হলেও মনে হত অনেক কম বলা হচ্ছে। 

মুজিব ভাইয়ের মেয়ে শেখ হাসিনা তখন আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়ত। একদিন শেখ হাসিনা একটি মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসলেন। সে সময় একজন আমাকে বলল যে, উনি হলেন মুজিব ভাইয়ের মেয়ে। তখন থেকে আমি উনাকে জানি। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে উনি ভিপি নির্বাচন করলে আমি একজন কর্মী হিসেবে কাজ করি। আমি যতটা না কাজ করেছি তার দশগুন বেশি করে উনি বলতেন এবং ১০০ বার বলতেন। এজন্য আমি উনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ।

এক সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি হলাম। তখন ঢাকা কলেজ থেকে তারা সভাপতি করতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌশলে আমিই সভাপতি হয়েছি। কেন্দ্রীয় কমিটিরও ভাইস প্রেসিডেন্টও হলাম। সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ উনিও তখন ময়মনসিংহের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। 

এরই মধ্যে আগরতলা মামলার ঘটনা ঘটে। তখন খুব কঠিন সময় ছিল। একের পর এক সমস্ত নেতারা গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে খুব কঠিন সময় যায়। এ সময় বঙ্গমাতার সাথে পরিচয় হয়। সে সময় লিফলেট ছাপার জন্য আমাদের কাছে টাকা পয়সা ছিল না। কার পরামর্শে যেন আমি একবার বঙ্গমাতার কাছে গিয়েছিলাম আমার মনে নেই। কিন্তু আমি বঙ্গমাতার কাছে গিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম আমরা লিফলেট ছাপব কিন্তু টাকা পয়সা পাচ্ছি না। পরে উনি আমাকে বললেন, তুমি বস। কিছুক্ষণ পরে উনি আমাকে একশ টাকা দিলেন। অনেক পরে আমি জেনেছি যে, ওই টাকা ছিল উনার গহনা বিক্রি করার টাকা। আগেও এরকম টাকা দেওয়ার জন্য তিনি গহনা বিক্রি করেছিলন। ওই টাকা থেকে আমাকেও দেন। এভাবে প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে।

আমরা সবাই মিলে আগরতলা মামলার জন্য যতটা না করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি একা করেছেন বঙ্গমাতা। যেমন, জেলে থাকতে বঙ্গবন্ধুকে গোলটেবিলে নিয়ে যেতে অনেকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা যেতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, আগে ছেড়ে দিতে হবে পরে যেতে হবে। সুতরাং বঙ্গমাতা আর বঙ্গবন্ধুকে আলাদা ভাবে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলন সেই ৫২ এর আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আন্দোলন সমস্ত, এমনকি কিছু ৭ মার্চের ভাষণ সব জাগয়ার অবদান রয়েছে বঙ্গমাতার। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ মুজিব থেকে খোকা, খোকা থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু সব ক্ষেত্রে বঙ্গমাতারও সমান অবদান রয়েছে। এবং বঙ্গমাতার সহযোগিতার কারণেই বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হয়েছেন। এদেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। আজ বঙ্গবন্ধু জন্মদিনে আমার এরকম হাজারো স্মৃতি কথা মনে পড়ছে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭