ইনসাইড বাংলাদেশ

মোহাম্মদপুর ও আদাবরে সক্রিয় ১২ কিশোর গ্যাং


প্রকাশ: 18/03/2024


Thumbnail

কিশোর গ্যাং সদস্যদের সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর। দুই এলাকার সাধারণ মানুষ অন্তত ১২টি কিশোর গ্যাংয়ের কাছে জিম্মি। তাদের উৎপাত এতটাই বেড়েছে যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় একা চলতে ভয় পায়। সম্প্রতি এসব এলাকায় ছিনতাই ও হামলা আশঙ্কাজনক হারে  বেড়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়লেও তাদের দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা উল্লেখযোগ্য নয়।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগিরই এসব কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটবে।

অনুসন্ধান বলছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে আনোয়ার গ্রুপ, আর্মি আলমগীর ও  নবী গ্রুপ, ডাইল্লা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, লারা দে গ্রুপ, আকবর গ্রুপ, গাংচিল গ্রুপ, ল ঠেলা গ্রুপ, আশরাফ গ্রুপ, মিরাজ গ্রুপ, সুমন গ্রুপ ও ফর্মা সজীব গ্রুপ অন্যতম।

র্যাব-২-এর দেওয়া তথ্য মতে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় পাটালি গ্রুপটি সন্ত্রাসী সুজন মিয়া ওরফে ফর্মা সজীবের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। লেভেল হাই গ্রুপের প্রধান শরিফ ওরফে মোহন সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে জেলহাজতে আছেন। তাঁর এই গ্রুপ মোহাম্মদপুর, আদাবর, বেড়িবাঁধ ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করত।

এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা পথচারীদের একলা পেলে আকস্মিকভাবে ঘিরে ধরে চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যেত।

পাটালি গ্রুপের সুজন মিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদকদ্রব্য, ছিনতাই ও মারামারি সংক্রান্ত অন্তত ১১টি মামলা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শরিফ ওরফে মোহন (২১) ‘লেভেল হাই গ্রুপ’-এর মূল হোতা ও সন্ত্রাসী হায়াত ওরফে টাকলা হায়াত তাঁর অন্যতম প্রধান সহযোগী। তিনি মোহাম্মদপুর এলাকায় মাদকের ব্যবসা করতেন। হায়াত ওরফে টাকলা হায়াতের অন্যতম সহযোগী হিসেবে মোহাম্মদপুর ও তার আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি ও অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। শরিফের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক, ছিনতাই ও মারামারি সংক্রান্ত আটটির বেশি মামলা রয়েছে।

সাকিব ওরফে রিয়াম ‘চান গ্রুপের’ অন্যতম সহযোগী সদস্য। তিনি ২০১৮ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসবাস শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি করেছেন। ২০২১ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময় ‘চান গ্রুপ’ নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক, ছিনতাই ও মারামারির ঘটনায় তিনটির অধিক মামলা আছে।

ইমরান ‘মাউরা ইমরান গ্রুপের’ সদস্য। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ডিশ ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১৫ থেকে ২০ জনের একটি গ্রুপ তৈরি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক, ছিনতাই ও মারামারি সংক্রান্ত চারটির বেশি মামলা রয়েছে।

আদাবর বালুর মাঠ এলাকায় মজিদ বয়াতির ছেলে আনোয়ার হোসেন ‘আনোয়ার গ্রুপ’ নামের একটি কিশোর গ্যাং পরিচালনা করেন। বালুর মাঠ এলাকায় রাত গভীর হলেই নিজ বাহিনী নিয়ে তিনি মহড়া দেন। বরগুনা জেলার আমতলীর আব্দুল মালেকের ছেলে জনি ওরফে ‘রক্তচোষা জনি’ ঢাকা উদ্যানের তুরাগ হাউসিং ১ নম্বর রোডের মিরাজের রিকশা গ্যারেজের পাশে গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং। জনি ও মোহাম্মদ ইউনুস আনোয়ার হোসেনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

মোহাম্মদপুরে ‘আর্মি আলমগীর ও নবী গ্রুপ’ নামের কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেন ভোলার দৌলতখান থানার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের ছেলে জহিরুল ইসলাম ওরফে জহির ওরফে কালা জহির। তাঁর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন রায়েরবাজার এলাকার ডাইল্যা হৃদয়, পিঞ্জিরা রাব্বি ও পান খাওয়া আবির। ডাইল্যা হৃদয় রায়েরবাজার এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে এক ত্রাসের নাম।

অনুসন্ধান বলছে, রায়েরবাজার এলাকার আজিজ খান রোডের নাদির খানের বাড়ির ভাড়াটিয়া শরীয়তপুরের সুমনের ছেলে এলেক্স ইমন ‘এলেক্স গ্রুপ’-এর নেতৃত্ব দেন। তাঁর সহযোগী হিসেবে আছেন একই এলাকার নাহিদ ওরফে গলা কাটা নাহিদ, নাদিম মাহফুজ ও মোল্লা রাব্বি। তাঁরা রায়েরবাজার এলাকার চুরি, ছিনতাইসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে ভূমি দখলের সঙ্গে জড়িত থাকাসহ নানাবিধ অপরাধের অভিযোগ। বেশ কিছু মামলার আসামি তাঁরা।

মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী এলাকার একরাম শেখের ছেলে মোহাম্মদ তামিমুর রহমান মিম নেতৃত্ব দেন ‘লারা দে’ গ্রুপ নামের কিশোর গ্যাংয়ের। তাঁর সহযোগী হিসেবে আছেন বাঁশবাড়ী এলাকার ইউসুফ সেলিমের ছেলে শুকুরুল ইসলাম, সাতমসজিদ রোড এলাকার নূর মোহাম্মদের ছেলে জিসান আহমেদ, রাজিয়া সুলতানা রোডের মোস্তাক আলীর ছেলে নেশার উদ্দিন আলিনুর ও রিয়েল এস্টেট এলাকার মোতালেব হোসেনের ছেলে স্থানীয় রাফি ওরফে ডিকে সানি।

সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় তোফাজ্জল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে এই গ্রুপের সদস্যরা। এ ঘটনায় থানায় একটি অভিযোগ করেন তিনি।

মোহাম্মদপুরের শেরশাহ শুরি রোড এলাকার মজিবুর রহমানের ছেলে আসিফ আকবর গড়ে তুলেছেন ‘আকবর গ্রুপ’ নামের আরেকটি কিশোর গ্যাং। এই চক্রের সদস্য হিসেবে সক্রিয় চাঁদ উদ্যান এলাকার ৮ নম্বর রোডের নুরুল ইসলামের ছেলে মিজানুর রহমান, হারুন অর রশিদ গোমস্তার ছেলে সাইদুল ইসলাম, লাউতলা অলি আহমেদের ছেলে মনির হোসেন এবং কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের ছেলে আমিন হোসেন ওরফে কালা ওরফে শাওন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকার গাংচিল গ্রুপের নেতৃত্ব দেন চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডের মানিক ওরফে বোমা মানিক। তাঁর সঙ্গে সহযোগী হিসেবে নবীনগর হাউজিংয়ের ১১ নম্বর রোডের ফরহাদ, ঢাকা উদ্যান লোহার গেট এলাকার মইনুদ্দিন, চন্দ্রিমা হাউজিংয়ের রনি, ঢাকা উদ্যান বি ব্লকের ২ নম্বর রোডের শাফায়েত, নবোদয় হাউজিং এলাকার আহমদ মল্লিকের ছেলে মোহাম্মদ কোবির হোসেন ওরফে কোবির মল্লিক ওরফে ‘জলদস্যু কোবির’। এ ছাড়া এই গ্রুপের সঙ্গে রয়েছে কেরানীগঞ্জের আটিবাজার এলাকার মৃত সোহরাব হোসেনের ছেলে মহিদুল ইসলাম মাহি, লক্ষ্মীপুরের সিরাজ খন্দকারের ছেলে মোহাম্মদ রাসেল ওরফে বাদ রাসেল, মোহাম্মদপুরের স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের রফিক ম্যানেজারের বাড়ির ভাড়াটিয়া ভোলার ইউসুফ আলীর ছেলে মোহাম্মদ রাকিব, চাঁদপুরের দুলাল দেওয়ানের ছেলে সালমান দেওয়ান ওরফে ছলে, মোহাম্মদপুরের গ্রিনভিউ হাউজিংয়ের আজাদ মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া ভোলা সদর থানার মৃত মোজাম্মেল হাওদারের ছেলে জুয়েল উদ্দিন ওরফে জসিম হাওলাদার।

মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকার কিশোর গ্যাং ‘ল ঠেলা’ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন মওলা ইমরান। তাঁর সঙ্গে সোহান মুন্না, পারভেজ ওরফে ভাগিনা পারভেজ। গ্রুপটি স্থানীয় ছিনতাই ও  নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া আশরাফ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন আশরাফ। সহযোগী হিসেবে মোহাম্মদপুর এলাকায় নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কাউয়া ফরাদ, নিঝুম, রাজীব, হৃদয় ও সোহেল। এই গ্রুপটি চাঁদ উদ্যান এলাকায় ভাসমান হিসেবে ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায় ভাসমান হিসেবে ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে কাজ করেন মিরাজ, রেজাউল, আলামিন ওরফে লম্বা আল আমিন এবং রোহান নামের কয়েক যুবক। মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড় এলাকায় ছিনতাই, চুরি ও স্থানীয় দোকানপাট থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সুমন গ্রুপ। এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেন সুমন ওরফে বাবু, ওরফে জাউরা বাবু বলে জানা গেছে।

এসব এলাকার স্থানীয় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলে, র্যাব কার্যালয়ের ৫০০ গজের ভেতরেই কিশোর গ্যাং চক্র সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। বসিলা থেকে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত রাস্তাটিতে সব সময় চলে ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম। চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর ও ঢাকা উদ্যান এলাকাজুড়ে ধারালো দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রতিদিনই চলে কিশোর গ্যাংয়ের মহড়া। এই এলাকায় প্রতিদিনই দোকান, বাড়িঘর কিংবা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে হামলা করছে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। পুরো এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রের মহড়া দিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে ভূমি দখলের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব বিপথগামী কিশোর। আর এর সুবিধা নিচ্ছে প্রভাবশালী এলাকার কিছু অসৎ ব্যক্তি।

জানতে চাইলে র্যাব-২-এর অপারেশন অফিসার জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শিহাব উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত কিশোর গ্যাং নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ যখন যে তথ্য দিচ্ছে, সে আলোকে অপারেশন পরিচালিত হয়। তবে এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার পর তারা আদালতের মাধ্যমে ছাড়া পেয়ে আবারও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। প্রভাবশালী শ্রেণির কিছু ব্যক্তি এসব অপরাধীকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আছে।’





প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭