ইনসাইড বাংলাদেশ

বনবিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জের ২০ হাজার একর ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ধ্বংস


প্রকাশ: 18/03/2024


Thumbnail

কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্যারাবন ও ঝাউবাগান কেটে অবৈধ  চিংড়ি ঘের নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রভাবশালী  রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিরা। এই দখল প্রতিযোগিতায় প্রভাবশালীদের দুই বিবদমান গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে গত ২ মার্চ সোনাদিয়াতে গুলিবিদ্ধ ২ জন নিহত হয়েছে। এতে আহত হয় ১২ থেকে ১৫ জন। 

প্যারাবন ও ঝাউবাগান রক্ষার দাবিতে গত ৩ মার্চ রোববার  বিকাল তিনটায় সোনাদিয়ার নিকটবর্তী ঘটিভাঙগায় বিশাল মানববন্ধন করেছে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) মহেশখালী উপজেলা শাখা। এতে সংহতি প্রকাশ করে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন,ইপসা ও স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। 

ধরার মহেশখালী শাখার আহবায়ক জেএইচএম ইউনুসের সভাপতিত্বে সদস্য সচিব এম আজিজ সিকদারের সঞ্চালনায়  অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি  ছিলেন জেলা ধরার আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল কাদের চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন জেলা ধরার যুগ্ম আহবায়ক এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন, তৌহিদ বেলাল, সিনিয়র সাংবাদিক আবদুস সালাম কাকলী, জাহেদ সরওয়ার,  রতনদাশ, আমিন উল্লাহ, উপকূলীয় সাংবাদিক ফোরামের সাধারন সম্পাদক হোবাইব সজীব, আ ন ম হাসান, স্থানীয়দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, মোস্তাক আহমদ,মোঃ রিদোয়ান মাহির,কামাল হোসেন, সাজ্জাদ হোসেন, রাশেদ খান মেনন,আবদুল হক ও মোহাম্মদ হানিফ।

বক্তারা বলেন, যারা প্যারাবন ও ঝাউবাগান কেটে চিংড়ি ঘের করছে তারা গণ দুষমন। তাদের চিহ্নিত করুন। আর প্রাণ- প্রকৃতি যারা ধবংস করে  তাদের পতন অনিবার্য। তাদের চিহ্নিত করে আন্দোলনের পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

উল্লেখ্য গত ২ মার্চ শনিবার প্যারাবন ধ্বংস  করে চিংড়ি ঘের তৈরি করতে গিয়ে বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ১ টা   অর্থাৎ ৩ ঘন্টাব্যাপী বন্দুক যুদ্ধ চলে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জন নিহত ও ১২/১৫ গুলিবিদ্ধ হয়।নিহত দু'জন হচ্ছেন বড় মহেশখালী মুন্সির ডেইলের মৃত গোলাম কুদ্দুসের ছেলে সাইফুল ইসলাম ( ৩০) ও সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড়ার আনোয়ার পাশার ছেলে সাদ্দাম হোসেন (৩৮)।

এ বিষয়ে মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ সুকান্ত চক্রবর্তী জানিয়েছেন,সোনাদিয়ায় প্যারাবন কেটে লবণ ও চিংড়ি ঘেরের দখল নিতে দু পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। ওসি বলেন বড় মহেশখালী ইউনিয়নের জাগিরাঘোনা নিবাসী জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বাধীন অস্ত্র সন্ত্রাসী ও সোনাদিয়ার পশ্চিম পাড়ার আজিম মিয়া গ্রুপের সাথে এ ঘটনা ঘটে।নিহত হয় দু' পক্ষের দুই জন।কোন পক্ষই এ ঘটনায় থানায় কোন লিখিত এজাহার দেননি। তার পর ও পুলিশ ঘটনায় জড়িত চারজন ও অস্ত্রসহ রাকিব নামের এক যুবককে আটক করেছে। 

অনুসন্ধান ও সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালীর সোনাদিয়া, কুতুবজোম, ঘটিভাংগা, তাজিয়া কাটা,মাতারবাড়ি, ধলঘাটা,কালারমারছড়া, আমাবশ্যাখালী,হেতালিয়া বড়দিয়া ও শাপলাপুরের   প্রায় ১২ হাজার একর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন ও ঝাউবন কেটে  অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে চিংড়ি ঘের।

 শুধু তাই নয় ৪/৫ টি খালে ও দেয়া হয়েছে বাঁধ।ওইসবখালে যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ  করতো হতদরিদ্র জেলেরা তারা পড়েছেন মহা বিপাকে।প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীচক্র রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে  সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও বনবিভাগের বাঁধা উপেক্ষা করে কেটে যাচ্ছে নির্বিচারে প্যারাবন ও ঝাউবাগান।প্যারাবন ও ঝাউবাগান কেটে যারা চিংড়ি ঘের করছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় লোকজন জড়িত।  

স্থানীয়  কুতুবজোম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেছেন প্রভাবশালী অর্ধশতাধিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধি মিলেমিশে ঘটিভাঙগা, তাজিয়া কাটায় প্যারাবন ও বাউবাগান নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছেন। তাদের এই অপকর্মের প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে।তাই স্থানীয়রা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না।

এ দিকে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) র মহেশখালী উপজেলা  শাখার আহবায়ক মোঃ ইউনুচ এ প্রতিবেদককে বলেন, গত ২/৩ বছর ধরে পুরো মহেশখালী উপকূল জুড়ে প্যারাবন ও ঝাউবাগান ধ্বংস করে হাজার হাজার একর চিংড়ি ঘের তৈরি করেছেন।বনবিভাগ তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক  মামলা করলে ও ঠেকানো যাচ্ছেনা বন নিধন। কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আরো দ্বিগুণ শক্তি বা উৎসাহ নিয়ে কাটছেন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।  

ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিয়ে গবেষণারত (অবসর প্রাপ্ত) শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা শ. ম আবদুল জব্বার বলেন, দ্বীপের দক্ষিণ পশ্চিমে জেগে উঠা চরাঞ্চল ও ছোট ছোট ১৫/২০ টি দ্বীপে প্রাকৃতিকভাবে ও সৃজিত প্যারাবন গড়ে উঠায়  মহেশখালী দ্বীপকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে।অথচ ভূমিগ্রাসীচক্রই মহামৃল্যবান প্যারাবন কেটে তৈরি করছে  চিংড়ি ঘের ও লবন মাঠ।এ অবস্থায়  প্রাকৃতিক দূর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালীর ব্যাপক এলাকা সাগরগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে।ফলে জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।চট্টগ্রাম উপকৃলীয় 
বনবিভাগের নিয়ন্ত্রাধীন 

মহেশখালীতে প্যারাবন রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা আয়ুব আলী জানান, ২০২৩ সালের জানুয়ারী থেকে ১৫ মার্চ  ২০২৪ পর্যন্ত ১৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত  তিন হাজার বন খেকোকে আসামী করে ৪৮ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। শুধু গত ফেব্রুয়ারী মাসে দায়ের করা হয়১২ টি মামলা। বিশেষ করে সোনাদিয়া - ঘটিভাঙগা এলাকায় ৮ হাজার একর জমি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে (বেজা) ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে রয়েছে নিছিদ্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও ঝাউবাগান। একটি প্রভাবশালীচক্র মূলত সে সব প্যারাবন ও ঝাউবাগান কাটছে। এই ঘন জঙ্গলে ছিল নানা প্রাণ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য এবং অতিথি পাখীর আবাসস্থল। এখন সেখানে ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের ফলে নেই কোন পশুপাখি। তারপর ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বনকর্মীরা স্পেশাল টহল জোরদার করেছি। এরপরও রক্ষা করা যাচ্ছে না বন।প্রভাবশালীরা এতই বেপরোয়া যে আইন কানুন কিছুই মানে না।

কথা প্রসঙ্গে রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, বেজা)র ৮ হাজার একর ছাড়া গোরকঘাটা রেঞ্জের আওতাধীন কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, ঈদগাঁও এর পোকখালী চকরিয়ার রামপুর, বদরখালী, মহেশখালীর শাপলাপুর, মাতারবাড়ি, ধলঘাট, কালারমারছড়া, হোয়ানক,বড়মহেশখালী কুতুবজোমের প্রায় ১২ হাজার একর বনভূমি বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বন বিভাগের হাত  ছাড়া হয়েছে। তবে প্রায় এক হাজার থেকে  দেড় হাজার একর বনভূমি পূনঃউদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। জনবল সংকট ও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বনকর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিমি মারমা বলেন,বন বিভাগ যখনই সুবিধা চান তখনই আমরা এগিয়ে যাই।বর্তমানে বেজার যে জমিতে যারা প্যারাবন কেটে চিংড়ি ঘের তৈরি করার পায়তারা করছেন শীঘ্রই আমরা তাদের সনাক্ত করে অভিযানে নামবো।যে যত বড় শক্তিশালী হোক কাউকে ছাড় দেবনা।

চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ বেলায়েত হোসেন বলেন, বেজাকে যে জমি সোনাদিয়া - ঘটিভাঙগা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে সেখানে আমাদের কোন দায়দায়িত্ব নেই। তারপর ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন কমীরা বন রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর আমাদের প্যারাবন কেটে যারা চিংড়ি ঘের তৈরি করেছেন তাদের প্রত্যকের বিরুদ্ধে আমরা মামলা দিয়েছি।এসব ভূমি উদ্ধার করে আবার ও প্যারাবন সৃজন করা হবে।তবে এ জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট  প্রশাসন ও পুলিশের উপস্থিতি। 

ঘটিভাঙ্গার আছদ আলী নামের একবৃদ্ধ এ প্রতিবেদককে জানান, মহেশখালীর সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতা ও জন প্রতিনিধিরা মিলেমিশে প্যারাবন ও ঝাউবাগান ধ্বংস করেছেন।আর মারা পড়ছে দিনমজুর এবং মামলায় আসামী হচ্ছে নিরীহ গরীব লোকজন। সব রতি মহারতি মিলে সাবাড় করছে বন।তারা রয়েছেন পর্দার অন্তরালে।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭