ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

ইবাদত-বন্দেগী পূর্ণ ইরানিদের রমজান


প্রকাশ: 21/03/2024


Thumbnail

পুরো রমজান মাস জুড়ে কোরআন-হাদিস চর্চা, ওয়াজ-নসিহত এবং দিক-নির্দেশনা দানের উদ্দেশ্যে সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জ ও শহরে ছড়িয়ে পড়েন আলেম এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা। দেশবাসীকে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-প্রজ্ঞায় আলোকিত করে তুলতে, এসময় তারা নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখেন।

দেশটিতে রমজান মাসে প্রায় সবাই কোরআন তেলাওয়াত করেন। এটা তাদের সাধারণ অভ্যাস। 

এছাড়াও, আয়োজন করা হয় বড় বড় কোরআন মাহফিলের। সেখানে শুধু কোরআন তেলাওয়াত হয়। আর যারা কোরআন পড়তে জানেন না, তারা এ মাসে কোরআন পড়া শিখে নেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের এ মাসে কোরআন শেখানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এভাবেই, জনমনে পবিত্রতার প্রশান্তি ছড়িয়ে অতি শান্ত ভাবে রমজানের আগমন ঘটে ইরানে।‌ 

বাংলা ইনসাইডার আয়োজিত 'ইনসাইড রমজান' ধারাবাহিক এর আজকের পর্বে আমরা জানবো ইরানের মুসলিমদের রমজান ও ইফতার সংস্কৃতি-

ইরানিদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রমজান একটি ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে। রমজান এলেই ইরানের অনেক লোক তাদের দোকান বা গলি আলো এবং ফুল দিয়ে সাজায়। লোকেরা একে অপরকে 'রমজান মোবারক' বলে অভিনন্দন জানায়। দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও এরা প্রায় সবাই শিয়া।

শিয়া-অধ্যুষিত এ দেশটিতে রমজানের ২১তম দিনে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদত বরণের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। শিয়া ধর্মমতে, এ মাসের ১৯ তারিখে হজরত আলী (রা.) ছুরিকাহত হন এবং ২১ তারিখে মারা যান। ইরানিরা অনেক সময় এই তিন দিনকে ‘পুনরুত্থানের রাত’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।

এই দিনগুলোকে শোকের কাল হিসেবে পালন করা হয়। কেউ কেউ রাস্তায় নেমে হজরত আলী (রা.)-এর কষ্ট আর তার মৃত্যুতে প্রকাশ্য শোক পালন করেন। অন্যরা, একান্তে শোক পালন করেন বা স্থানীয় মসজিদে অন্যদের সঙ্গে মিলে রাত জেগে নামাজ পড়েন, কোরআন তেলওয়াত করেন।

তবে, ইরানের বিভিন্ন এলাকা এবং গোত্রের মধ্যে রোজা পালনের রীতিনীতিতে বেশ তারতম্য দেখা যায়। সিরাজ শহরে শাবানের শেষ শুক্রবার থেকেই শুরু হয় রমজান পালনের উৎসব। 

আবার, উত্তর প্রদেশের ইরানিরা রমজানের কয়েকদিন আগে থেকেই রোজা রাখে। তাদের ভাষায় এই রীতিকে বলে 'পিশাশো'।

শিয়া সম্প্রদায়ের অষ্টম ইমাম রেজার মাজারে প্রতিদিন একজন আন্তর্জাতিক কারি পবিত্র কোরআন থেকে এক পারা করে তেলাওয়াত করেন। তার সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে কণ্ঠ মেলান। ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা এটি সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। এ ছাড়া এখানকার বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পবিত্র রমজান উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে।

ইরানি শিয়াদের আরও একটি মজার ব্যাপার হলো, তাদের আলেমদের ফতোয়া অনুসারে বালাদে কবিরা বা বৃহৎ শহর তথা মেগাসিটিতে সতের কিলোমিটারের অধিক সফর করলেই মুসাফির হয়ে যেতে হয়। আর মুসাফিরদের রোজা রাখা জাফরি ফেকাহতে নিষিদ্ধ। এ জন্য মসজিদগুলোতে রমজান মাসে ইতেকাফকারীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তারা দিনের বেলায় অফিস করেন এবং রাতের বেলায় মসজিদে অবস্থান করেন। প্রত্যেক মসজিদেই ইফতার, খানাপিনা ও সাহরির আয়োজন থাকে।

তবে, ইফতারি শেষে ইরানে শিয়া মুসলমানদের মধ্যে তারাবির ব্যস্ততা নেই। কারণ শিয়া মাজহাবে তারাবি নামাজের বিশেষ গুরুত্ব নেই। তারা রাতে কোরআন তেলাওয়াত করে।

ঢোল ও গজল গেয়ে সেহরিতে জাগায়

অতীতে লোকজনকে জাগ্রত করার একটি পদ্ধতি ছিল, সেটা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মতো একটি দল পাড়া বা মহল্লায় ঢোল ও গজলসহ জাগ্রত করা। সিরজান অঞ্চলে এ দলটি লোকদের বাড়ির দরোজায় টোকা দিয়ে জাগ্রত করত। টোকা দিতে দিতে বাড়ির মালিককে সম্ভাষণ করে কবিতা আবৃত্তি করত।

সময় নির্ধারণে মোরগের ডাক

অতীতে ইরানের সময় নির্ধারণ ও সেহরির রীতিনীতির আরেকটি মাধ্যম ছিল মোরগের ডাক। ইরানের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন বিশ্বাস করেন, মোরগ রাতের দীর্ঘ পরিসরে তিনবার ডাক দেয়। প্রথমবার অর্ধ রাতে, দ্বিতীয়বার অর্ধ রাত পার হওয়ার পর ও সর্বশেষ ভোরবেলা। এ কারণেই নিজেদের বাড়িতে মোরগ রাখা কল্যাণ ও বরকতের প্রতীক মনে করত। সাধারণ লোকজন বিশ্বাস করত, আরশে এলাহিতে বৃহৎ ও সাদা রঙের একটি মোরগ রয়েছে। যেটা ভোরে নিজের ডানা ঝাঁপটায় এবং উচ্চ স্বরে আজান দেয়। এ আজানের ধ্বনি পৃথিবীতে অবস্থানকারী সব মোরগের কানে পৌঁছে যায়। তারা এ আজানের অনুকরণে নিজেরাও আজান দেয় ও লোকজনকে ভোর সম্পর্কে অবহিত করে।

কসম খেয়ে সেহরিতে উঠা

কেউ কেউ বিশ্বাসী ছিল যে, ঘুমের সময় যদি মাটির কসম খাওয়া হয়, তবে সেহরির সময় জাগ্রত হওয়া যাবে। যেমন-কেরমান প্রদেশের সিরজান অঞ্চলের লোকজন ঘুমের আগে আঙুল দিয়ে মাটিকে আঘাত করে বলে, হে মাটি! আমার পাপ তোমার ঘাড়ে, সেহরির সময় আমাকে জাগ্রত করো।

উচ্চ স্বরে মোনাজাতে সেহরিতে জাগায় 

অধিকাংশ শহরগুলোতে ধর্মভীরু ব্যক্তি নিজের বাড়ি বা মসজিদের ছাদে চলে যান। উচ্চ স্বরে মোনাজাত করে রোজাদার লোকদের রোজা রাখার জন্য জাগ্রত করেন। ছন্দোবদ্ধ কবিতা বা মোনাজাতে খাজা আবদুল্লাহ আনসারি বা শেখ সাদির কবিতা অথবা গ্রামীণ কবিদের কবিতা মোনাজাতের মূল উপাদ্য। ফজরের আজানের কিছুক্ষণ আগে মোনাজাতকারী সবাইকে সতর্ক করে দিত। বলত, ‌হে মোমিনগণ! শুধু কিছু পানি পান করতে পারবেন।

তারইয়াক টানার প্রচলন

কোনো কোনো এলাকায় তারইয়াক টানার (এক ধরনের আফিম বা গাঁজা জাতীয় জিনিস, তবে নিষিদ্ধ নয়। সাধারণত ধূমপানের মতো মামুলি ছিল) প্রচলন ছিল। তাদের উদ্দেশ্যে বলত, পানি পান করুন ও তারইয়াক পান শেষে মুখ পরিষ্কার করে নিন। 

বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সেহেরিতে জাগায় 

কোনো কোনো অঞ্চলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সেহরির সময় জাগ্রত করা হতো। সেহরির সময় জাগ্রত করার জন্য একবার ও সেহরির সময় শেষ হওয়ার আগে একবার এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এগুলো প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে কিছু অঞ্চল ছাড়া শুধু বেতার, টেলিভিশন ও মসজিদে ঘোষণা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সতর্ক করা হয়।

ইরানিদের ইফতার 

ইরানিরা ইফতারের সময় শুরুতে আমাদের মতো ঠাণ্ডা শরবত ও পানীয় গ্রহণ না করে গরম চা ও সুস্বাদু খিঁচুড়ি খেতে পছন্দ করে। তা আসলেই রমজানের দহনে উত্তপ্ত উত্তেজিত জঠর ও পেটের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত। 

এগুলো ছাড়াও ইরানিরা ইফতারিতে 'অশ' বা স্যুপ, খেজুর, কলা, দুধ, পনির, রুটি, মধু, আপেল, চেরি, তরমুজ, তলেবি বা এক ধরনের বাঙ্গি ও আঙ্গুর খেয়ে থাকেন।  

আর থাকে এক রকমের জিলাপি। ইরানিরা জিলাপিকে বলে জুলবিয়া। এই জিলাপি দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের জিলাপির মতো। তবে এতে আড়াই প্যাঁচ থাকে না, প্যাঁচের সংখ্যা অসংখ্য এবং আকৃতি তুলনামূলকভাবে অনেক চিকন। ইরানিরা হালিমও খেয়ে থাকে ইফতারিতে। এদের হালিম কিছুটা টক জাতীয়। ছোট চাল, চিনি আর জাফরান দিয়ে রান্না হয় এক ধরনের ক্ষির বা পায়েশ যার ইরানি নাম 'শোলে জার্দ'।  এটিও ইফতারির একটি নামিদামি উপাদান। 

মসজিদে কিংবা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে ইরানে। মাশহাদে ইমাম রেজার মাজারে প্রতিদিন অন্তত ১২ হাজার মানুষের ইফতারির যোগান দেওয়া হয়।

এছাড়াও, ইফতারের সময় ইরানিরা খাদ্যদ্রব্য এবং পানীয়-শরবত নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পথচারীদের আপ্যায়ন করে আনন্দ পান।

রমজানকে বিদায়

রমজান মাসের শেষ রাতগুলোতে খোদা হাফেজ মাহে রমজান নামে একটি অনুষ্ঠানও এখানকার বিভিন্ন শহরে প্রচলিত রয়েছে। এই অনুষ্ঠানটি কোনো কোনো শহরে ২৭ রমজান, আবার কোনো কোনো শহরে রমজান মাসের শেষের দিকের সেহরির পরপর, আবার কোথাও কোথাও মাগরিব ও এশার নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয়। লোকেরা মসজিদে অথবা ওই এলাকার প্রসিদ্ধ একজনের বাড়িতে জড়ো হন এবং বিদায় নামক প্রসিদ্ধ কবিতা পাঠ করে রমজানকে বিদায় জানান।

এছাড়াও, দেশটিতে রমজানের শেষ দিন মহান ভোজের সঙ্গে পালিত হয়। উপবাস ভঙ্গের পর্ব আসে একটি পবিত্র প্রার্থনার সঙ্গে। যাকে সালাতুল ঈদ বলা হয়। বেশির ভাগ লোক তাদের স্থানীয় মসজিদে সাম্প্রদায়িক প্রার্থনার জন্য উপস্থিত হয়। ইফতারটি আরও বড়সড় এবং পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীরা এতে যোগ দেয়। সাধারণত বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং মারজা দ্বারা দোয়া পরিচালিত হয়।

ঈদ উদযাপন 

ইরানে ঈদ উদযাপন হয় অনেকটা নিরবে। অনুষ্ঠানের ঘটা থাকে ব্যক্তিগত সব আয়োজনে। ঈদে দান করাটা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে প্রতিটি মুসলিম পরিবার গরিবদের মধ্যে খাবার বিলিয়ে থাকে। এমনকি ধনী অনেকে এই দিনে ত্যাগের মহিমায় গরু বা ভেড়ার মাংস গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে থাকে। যদিও ঈদুল আজহায় এ নিয়ম প্রচলিত, কিন্তু ইরানিরা অনেকে ঈদুল ফিতরেও গরিবদের মধ্যে মাংস বিতরণ করে।

এখানে, ধর্মপালন একেবারেই ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। ইরানের ধর্মপ্রাণ মানুষ রোজা রাখে, নামাজ পড়ে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম পালন নিয়ে তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই বললেই চলে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭