ইনসাইড বাংলাদেশ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বোমাবর্ষণ


প্রকাশ: 30/03/2024


Thumbnail

৩০ মার্চ রাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনী চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওপর বোমা বর্ষণ করে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা নিরাপদ স্থানে চলে যান। সেখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও পিছু হটে যান। বোমাবর্ষণের আগে সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবেদন জানানো হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর কামান দিয়ে বোমা বর্ষণ করে। রাতে নগরীর আশপাশে ছত্রীসেনা নামায় তারা। ভোর পর্যন্ত ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে।

২৭ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে বের করে দিলেও কৌশলে থেকে গিয়েছিলেন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং। তিনি ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাদের হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ দেখতে পান। ব্যাংককে গিয়েই তিনি তা নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী প্রথম বিশদভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা সম্পর্কে জানতে পারে। প্রতিবেদনটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তানে ট্যাংক আক্রমণ: ৭,০০০ নিহত, ঘরবাড়ি ভস্মীভূত'।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা এখন ধ্বংস ও আতঙ্কের নগরী। ২৩ ঘণ্টা ধরে অবিরাম শেল বর্ষণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় সাত হাজারের বেশি লোককে হত্যা করেছে। সেনা অভিযানে ঢাকাসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। সাইমন ড্রিং লেখেন, সেনাবাহিনীই প্রধান জনপদগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। সেনাবাহিনী এখতে গুলি চালাচ্ছে এবং নির্বিচার দালানকোঠা দাংস করা হচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা ও ধংংসযজ্ঞ নিয়ে এই দিল দ্য নিউইয়র্ক টাইকও পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনী দেশজুড়ে বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করছে এ কুষ্টিয়ায় যুদ্ধ চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুষ্টিয়ায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। কুষ্টিয়ায় অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনাদলকে আক্রমণের জন্য ২৭ মার্চ ইপিআরের ফিলিপনগর কোম্পানি কুষ্টিয়া শহরের সুনির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়েছিল। দলটির নেতা ছিলেন বাঙালি সুবেদার মুজাফফর আহমেদ (পরে অনারারি লেফটেন্যান্ট)।

২৮ মার্চ দুপুর ১২টার মধ্যে সীমান্তে নিয়োজিত ইপিআরের সব কোম্পানি সমবেত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। একটি কোম্পানি সেনা ঝিনাইদহে যশোর-ঝিনাইদহ রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিল। আরেক কোম্পানি সেনা বিকেলে ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে পোড়াদহে যায়। পরিকল্পনা ছিল, আক্রমণ হবে একই সময়ে তিন দিক থেকে। আক্রমণের সময় ছিল ২৯ মার্চ ভোর চারটা। সব আয়োজন শেষ হওয়ার পরও পরিকল্পনা পাল্টে আক্রমণের নতুন সময় স্থির করা হয় ৩০ মার্চ ভোর চারটা।

৩০ মার্চ ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত হয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশ লাইনস ও ওয়্যারলেস কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে জিলা স্কুলের দিকে তাদের সদর দপ্তরে পালিয়ে যায়। কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। জিলা স্কুল এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়া গোটা শহর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিপর্যয় উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ব্যাটালিয়ন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই দিন বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ব্যাটালিয়নের তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক সরকার তখন ছিলেন দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটে। রফিক সরকার এক দিন আগে জানতে পেরেছিলেন, ৩০ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সামরিক কনভয় রংপুর থেকে বগুড়ার উদ্দেশে যাত্রা করবে। তিনি এক প্লাটুন সেনা নিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে বেলা তিনটার দিকে কনভয়টিকে অ্যামবুশ করেন। দুই পক্ষে প্রচন্ড তবি বিনিময় হয়। রফিক সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। পাকিস্তানিরা তাঁকে রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংস অত্যাচারের পর ১ এপ্রিল তাঁকে হত্যা করে। সৈয়দপুর সেনানিবাসে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিরাজুল ইসলামকে রংপুর সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়। ৩০ মার্চ রংপুর সেনানিবাসে পৌছানোমার ১০ জন বাঙালি সৈনিকসহ তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এত বিপর্যয়ের পরেও এই দিন দিবাগত রাতে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনের (বীর প্রতীক, স্বাধীনতার পর মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

যশোরে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহ

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ব্যাটালিয়ন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অর্ধেক বাঙালি সেনা মহড়া শেষে ২৯ মার্চ গভীর রাতে যশোর সেনানিবাসে ফিরেছিল। বাকি অর্ধেক ছিল ছুটিতে। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম, পরে মেজর, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী) এবং লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন (বীর উত্তম) ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পাকিস্তানি। প্রত্যন্ত সীমান্ত অঞ্চলে মহড়ায় থাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর তাঁরা পাননি। সেনানিবাসে ফেরার পর ৩০ মার্চ তাঁদের প্রায় নিরস্ত্র করা হয়। তাঁরা লক্ষ করেন, নিরন্ত্র অবস্থায় তাঁদের ঘিরে রেখেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনারা। তাঁদের বুঝতে বাকি থাকে না, কী ঘটতে চলেছে। রেজাউল জলিল কোনো সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে বাঙালি সেনারা হাফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেন। তাঁরা অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে গুলিবর্ষণ করতে করতে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে আসেন। এই সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ বহু বাঙালি সেনা শহীদ ও আহত হন। আর প্রায় ২০০ জন বাঙালি সেনা বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।


সূত্র: ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, দ্য টেলিগ্রাফ, নিউইয়র্ক টাইমস, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭