প্রকাশ: 30/03/2024
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এত ব্যাংক দিলেন কেন- এমন প্রশ্ন রেখে বাংলাদেশ
ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশে ব্যাংকের
সংখ্যা ৬১। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যেসব ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল তার কোনোটাই ভালো করছে
না। এসব ব্যাংকের উদ্দেশ্যই ছিল ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করা। পদ্মা ব্যাংকের মতো এগুলোকে
নাম বদলে ভালো করার চেষ্টা না করে লিকুইডেট করে দেওয়াটা সবচেয়ে ভালো।
শনিবার (৩০ মার্চ) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘ব্যাংকিং খাতে
সুশাসন জোরদারে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে ছায়া সংসদ’ বিতর্ক শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে
এসব কথা বলেন তিনি। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন জোরদারে ব্যাংক একীভূতকরণ বিতর্ক প্রতিযোগিতায়
বিপক্ষ দল বিজয়ী হয়েছে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক আগেই বলেছিলাম এত ব্যাংকের অনুমোদন
দিলে মার্জারের সিদ্ধান্তে যেতে হবে। দেরিতে হলেও মার্জার অ্যাকুইজেশনের সিদ্ধান্তটা
ভালো। তবে মার্জারের মাধ্যমে ব্যাংক লুটেরা বা দুর্নীতিবাজরা যাতে পার না পেয়ে যায়
সে বিষয়ে খুব গুরুত্বসহকারে নজর রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রলেপ দিয়ে ব্যাংক খাতের চিকিৎসা করা যাবে না।
অর্থনীতির স্বার্থে এটাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমাদের দেশে মার্জারের ভালো
উদাহরণও রয়েছে। যেমন ইস্টার্ন ব্যাংক এখন একটি। তবে খেয়াল রাখতে হবে ভালো ব্যাংক
যেন দুর্বলের প্রভাবে নড়বড়ে হয়ে না যায়। পাশাপাশি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক
কর্মকর্তা ও ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎকারি গ্রাহকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, আমি জানি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট
বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে। কিন্তু কোনো অ্যাকশন হয় না। অন্যদিকে পরিচালকরা তাদের
ঋণ ভাগাভাগি করতে থাকে। এগুলো একটি অর্থনীতির জন্য খুবই খারাপ। এজন্য ব্যাংকের আইনে
কিছু সংস্কার প্রয়োজন। অন্যথায় যে আইন আছে সেটার যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
প্রতিযোগীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত সক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন
করলে তিনি উত্তরে বলেন,
এখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে দুর্বল। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে
উপরে নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকলে হবে না। অর্থনীতির স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয়
সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হয়। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা
হলো- আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি ডিবেট
ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। প্রতিযোগিতায় প্রস্তাবের (ব্যাংকিং
খাতে সুশাসন জোরদারে ব্যাংক একীভূতকরণ) পক্ষে প্রাইম ইউনিভার্সিটি এবং বিপক্ষে বিজিএমইএ
ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির বিতার্কিকরা অংশগ্রহণ করে।
সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, দেশের উন্নয়ন নিয়ে
আমরা গর্ব করলেও আর্থিক খাতের অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ হয়। মাথা হেইট হয়ে আসে।
ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারে সংস্কৃতি আমাদের জন্য একটা বড় কালো দাগ। ব্যাংকিং খাতের
অনিয়ম ভয়াবহ ক্যান্সারের রূপ নিচ্ছে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ, রিজার্ভ
চুরি, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি, ফারমার্স ব্যাংকের পতন, পিপলস লিজিং এর অবসায়ন, হলমার্ক,
বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনির জালিয়াতি, পুঁজি বাজারের কারসাজি, শেয়ার মার্কেট লুট ইত্যাদি
কলঙ্কিত ঘটনা আর্থিক খাতকে ব্যাপক দুর্বল করে ফেলেছে। ব্যাংক খাত আজ তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
সোনালী ব্যাংক লুট হয়েছে। জনতা ব্যাংক লুট হয়েছে। বেসিক ব্যাংক ধ্বংস হয়েছে। পদ্মা
ব্যাংক কলঙ্কের ইতিহাস রচনা করেছে। এই বেসামাল পরিস্থিতি উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক সবল
ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে ব্যাংক একীভূতকরণের
মাধ্যমে আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি। কতিপয় রাজনৈতিক
চক্র, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যাতে আর আর্থিক খাতে অনিয়ম করতে না পারে তার জন্য সরকারকে
কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। সম্প্রতি পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে।
তিনি বলেন, একীভূত হওয়ার পর রেড জোনে থাকা পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকদের
নগদ অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যেও
টেনশন তৈরি হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে পদ্মা ব্যাংকের ভাইরাস যাতে এক্সিম ব্যাংকে সংক্রমিত
না হয়। একই সাথে এক্সিম ব্যাংককেও নিজেদের কোনো অনিয়ম থাকলে দ্রুত তা সমাধান করা উচিত।
তা না হলে এক্সিম ব্যাংকও পদ্মায় ডুবে যেতে পারে। মনে করা হয় ফারমার্স ব্যাংকে বাঁচতে
দিয়ে পদ্মা ব্যাংক হতে দেওয়াটা ছিল বড় ভুল। ফারমার্স ব্যাংকটিকে বন্ধ করে দিলে হয়তো
এত বড় আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও কম হতো। কিসের ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে, দুর্বল
ব্যাংকের দায়-দেনা কে পরিমাপ করবে, দুর্বল ব্যাংকের ক্ষতির দায় কে নেবে, ভালো ব্যাংকটি
খারাপ অবস্থায় পড়বে কি না, একীভূত ব্যাংক দুইটি কীভাবে পরিচালিত হবে এগুলো এখন বড় প্রশ্ন?
তিনি আরও বলেন, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর সাথে
দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। যার সুফলও পাওয়া
গেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দেনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাংক
একীভূত হয়েছে। এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। ব্যাংক একীভূত হলে উন্নত মূলধন ব্যবস্থা,
তারল্য বৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকি প্রশমন, দক্ষতা বৃদ্ধি, ট্যাক্স বেনিফিট,
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বেশকিছু সুবিধা তৈরি হয়।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন দশ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন-
১. ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল
করে প্রয়োজনে প্রচলিত আইনের সংস্কারের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা
করা।
২. আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা।
৩. ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের
নামের তালিকা জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা।
৪. আর্থিক খাতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণখেলাপিদের বিদেশ
ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ, দেশে বিদেশে স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির
তালিকা করে এনবিআর ও দুদকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও ব্যবসা সম্প্রসারণ
প্রদান করা।
৫. শুধু সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত নয়, যারা ব্যাংক
দুর্বল করার জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যাতে সরকারের
ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকালে এসব অসৎ ব্যক্তিরা পার পেয়ে যেতে না পারে।
৬. দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষতির দায় কে নিবে তা স্পষ্ট করা। একই সঙ্গে
দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানত গ্রহণ ও বিতরণ ছাড়া অন্যসব কার্যক্রম বন্ধ করা।
৭. দুর্বল ব্যাংকের আদায় অযোগ্য ঋণ আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ
করা।
৮. ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর অধিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত
করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম না হয়।
৯. ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করতে হবে। যাতে মালিকদের
প্রতিনিধিত্বকারী পর্ষদ যেন ব্যবস্থাপনা কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
১০. ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সুফল পেতে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ
ভূমিকা পালন করা। যাতে কোনো পক্ষপাতমূলক সংবাদ ব্যাংক একীভূত প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে না
দাঁড়ায়।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ব্যাংক একীভূতকরণ ব্যাংকিং খাতে সুশাসন
জোরদার করবে শীর্ষক ছায়া সংসদে বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ,
সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা, সাংবাদিক ইকবাল আহসান এবং সাংবাদিক সেলিম মালিক।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭