ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

মোদি-খাড়গে বাগ্বিতণ্ডায় হঠাৎ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ


প্রকাশ: 02/04/2024


Thumbnail

ভারতের ভোট নিয়ে বিজেপি-কংগ্রেস পাল্টাপাল্টিতে আচমকাই ঢুকে পড়ল বাংলাদেশ। চলে এল স্থলসীমান্ত চুক্তি প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভিযোগের যে জবাবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন, ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও তার কোনো জবাব মোদি দেননি। এমন কি বিতর্কের অবসানও ঘটেনি।

বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে কচ্চতিভু দ্বীপ, যে ভূখণ্ডটি ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কাকে ভারত দিয়েছিল। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

এত বছর পর হঠাৎ কচ্চতিভু দ্বীপ প্রসঙ্গটি রাজনীতির বিতর্কে টেনে আনার পেছনে রয়েছে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক পটভূমি। তামিলনাড়ুতে পায়ের তলার জমি শক্ত করতে বিজেপি এই দ্বীপের হস্তান্তরকে বড় করে তুলে ধরে কংগ্রেসকে দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করতে চাইছে।

কচ্চতিভু দ্বীপ হস্তান্তর প্রসঙ্গে তথ্য জানার অধিকার আইনের (আরটিআই) একটি প্রতিবেদন নিয়ে বিজেপির তামিলনাড়ু নেতৃত্ব কংগ্রেসবিরোধী প্রচার শুরু করামাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিষয়টি হাতিয়ার করে নেন। গত রোববার তিনি ‘এক্স’ হ্যান্ডলে ওই দ্বীপ শ্রীলঙ্কাকে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করে লেখেন, ‘এই চমকপ্রদ আরটিআই রিপোর্ট আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার, কংগ্রেস কী নিষ্ঠুরভাবে কচ্চতিভু দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছিল। দেশের সবাই এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, কংগ্রেসকে বিশ্বাস করা যায় না। ৭৫ বছর ধরে ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতা এভাবেই তারা নষ্ট করেছে। এখনো করছে।’

রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টির সূত্রপাত এখান থেকেই। রোববারই মোদির অভিযোগের দীর্ঘ জবাব দেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। সেখানেই টেনে আনেন বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রসঙ্গ।

দীর্ঘ সেই পোস্ট খাড়কে শুরু করেছেন এভাবে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হঠাৎই আপনি দেশের অখণ্ডতা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। সেই উদ্বেগও ধরা পড়ল শাসনের দশম বছরে। সম্ভবত নির্বাচনের কারণেই। এতে আপনার অসহায়তা প্রকট হলো।’

খাড়গে এরপর স্থলসীমান্ত চুক্তি টেনে লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী যে চুক্তি করেছিলেন তার প্রশংসা করে ২০১৫ সালে আপনিই বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন, এই চুক্তি শুধু জমির পুনর্বিন্যাস নয়, এতে দুই দেশের হৃদয়েরও মিলন ঘটেছে। সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছিল আপনার সরকারের আমলে। বন্ধুত্বের প্রমাণ রেখে তাতে আপনার সরকার কিন্তু ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশকে দিয়েছিল, বিনিময়ে পেয়েছিল বাংলাদেশের ৫৫টি ছিটমহল।’

স্পষ্টতই খাড়গে বোঝাতে চেয়েছেন, একটি দ্বীপ দেওয়ার জন্য যিনি কংগ্রেসকে দোষারোপ করছেন, তিনিই কিন্তু বাংলাদেশকে ১১১টি ছিটমহল দিয়েছেন!

খাড়গে এরপর লিখেছেন, ‘ওই বছর, সেই ১৯৭৪ সালে আরও একটি বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছিল ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে, কচ্চতিভু দ্বীপ নিয়ে। তামিলনাড়ুর নির্বাচনের প্রাক্কালে এখন আপনি ওই স্পর্শকাতর বিষয়টির অবতারণা করছেন, অথচ আপনার সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টে বলেছিলেন, চুক্তির মাধ্যমে কচ্চতিভু শ্রীলঙ্কার কাছে গেছে। সেটা ফিরিয়ে নিতে হলে যুদ্ধ করতে হবে। আপনার সরকার ওই দ্বীপ ফেরত নিতে কোনো উদ্যোগই কি নিয়েছিল?’

দেশের সর্বনাশের কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মোদি ১০ বছর শাসনের পরও এখনো নেহরু-গান্ধী পরিবারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। সেই প্রসঙ্গের অবতারণা করে খাড়গে লিখেছেন, ‘গান্ধীজি, নেহরু, প্যাটেল, ইন্দিরা, রাজীবের মতো নেতা দেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার জন্য জীবন দিয়েছেন। সর্দার প্যাটেল ৬০০ জন রাজার রাজত্বকে দেশের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন। অথচ কী বিপুল বৈপরীত্য দেখুন, গালওয়ান উপত্যকায় ২০ জন সেনা শহীদ হওয়ার পর আপনি চীনকে ক্লিনচিট দিলেন! চোখ খুলে দেওয়ার মতো কিছু থাকলে তা আপনারই দান। নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের মতো বন্ধুদেশের সঙ্গে বৈরিতার মাত্রাও আপনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনার পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার দরুন এই প্রথম রাশিয়া থেকে পাকিস্তানও অস্ত্র সম্ভার কিনল!’

মোদির উদ্দেশে খাড়গে তাঁর পোস্টের শেষে বলেছেন, ‘দেশের এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষায় কংগ্রেসিরা রক্ত ঝরায়নি। সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করে জীবন দিয়েছেন ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধী। কংগ্রেস নিয়ে এই আচ্ছন্নতা দয়া করে বন্ধ করুন। নিজের ব্যর্থতার দিকে তাকান, যার জন্য দেশকে ভুগতে হচ্ছে।’

খাড়গের জবাব মোদি না দিলেও কচ্চতিভু বিতর্ক কিন্তু বিজেপি ছাড়েনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদে এ নিয়ে বিতর্কের উল্লেখ করে বলেছেন, নেহরুর কাছে কচ্চতিভু দ্বীপ ছিল একটা ‘উপদ্রব’। ইন্দিরার সময় ওই দ্বীপের কাছে মাছ শিকারের অধিকার ভারত ছেড়ে দিয়েছিল।

ভোটের মুখে তামিল জেলেদের ধরা পড়াকে বিজেপি ইস্যু করে তুলতে চাইছে। সে জন্য দোষী করতে চাইছে কংগ্রেসকে। তামিলনাড়ুর রাজনীতিক জয়শঙ্কর তাই বলেছেন, সমস্যাটি মোটেই মরে যায়নি। ভালোভাবে জিইয়ে রয়েছে।

কংগ্রেসের তামিল রাজনীতিক সাবেক অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম সোমবার এ জন্য একহাত নিয়েছেন জয়শঙ্করকে। তিনি এক্সে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘এটা ঠিক, ভারতীয় জেলেরা ৫০ বছর ধরে আটক হচ্ছেন। তেমনই শ্রীলঙ্কার জেলেরাও ভারতের হাতে ধরা পড়ছেন। প্রতিটি সরকার এ নিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কথা বলেছে। জেলেদের ছাড়িয়েছে। সেটা হয়েছে জয়শঙ্কর যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন, যখন পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন এবং যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী—সব সময়েই।’

এরপরেই চিদাম্বরম প্রশ্ন করেছেন, ‘হঠাৎ কী এমন হলো যে জয়শঙ্করকে কংগ্রেস ও ডিএমকের বিরুদ্ধে গলা তুলতে হচ্ছে? অটল বিহারি বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী কিংবা তামিলনাড়ুতে শরিকদের সঙ্গে মিলে বিজেপি শাসন করছিল, তখন কি ভারতীয় জেলেদের শ্রীলঙ্কা আটক করত না কিংবা ২০১৪ সালের পর নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর?’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সমালোচনা করে চিদম্বরম লিখেছেন, ‘মানুষ কত দ্রুত রং বদলাতে পারে, দেখছি। একজন নম্র কর্মকর্তা থেকে এক স্মার্ট পররাষ্ট্রসচিব থেকে আরএসএস-বিজেপির মুখপাত্র হয়ে গেছেন তিনি। ডিগবাজি খাওয়ার ইতিহাসে জয়শঙ্করের জীবন জ্বলজ্বল করবে।’

জয়শঙ্কর ও বিজেপিকে ছেড়ে দেয়নি ডিএমকেও। দলের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, এত বছর পর এখন এই বিষয়ের অবতারণার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি কতটা নার্ভাস। তামিলনাড়ুতে হেরে যাওয়ার ভয়ে কতটা ভীত। তামিলনাড়ুকে বন্যার ত্রাণে কেন টাকা দিতে পারেননি, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে মোদি এখন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭