ইনসাইড থট

রাজনীতি নয় বুয়েট হোক অপরাজনীতি মুক্ত


প্রকাশ: 04/04/2024


Thumbnail

পিতা রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন তার আদরের একমাত্র শিশু পুত্রকে বেদম প্রহার করে আহত করেছেন। ঘুম ভাঙার পর বিষণ্ণ পিতা শিশু পুত্রকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। দু'একদিন পরপর এমন স্বপ্ন দেখতে দেখতে পিতা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পিতা কোনো দিশা না পেয়ে রাতে ঘুমানোই বন্ধ করে দিলেন। মানসিক দুশ্চিন্তা এবং  ঘুমের ঘাটতিতে তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। তখন আদরের শিশু পুত্র একটু এদিক-ওদিক করলেই পিতা তাকে উত্তম মধ্যম দেওয়া শুরু করলেন। আগে স্বপ্নে মারতেন আর এখন চুন থেকে পান খসলেই সত্যি সত্যি মারা শুরু করলেন! বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতি ঐ পিতার মত।

আবরার হত্যার পর থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও অপরাজনীতি চলেছে ঠিকঠাক ভাবেই। সবাই যখন ঘুমায়, তখন দু'একজন জেগে থাকলেও দেখে কে? তবে এই দু'একজনের খটখট শব্দ যখন সবার ঘুম ভাঙার কারণ হয়, তখন আর সবাই ঘুমাতে পারলেও ঐ বিশেষ দু'এক জনের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। বুয়েটে এখন একই দশা। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকায় বুয়েটের সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন এতদিন চুপচাপ ছিলো। আর এই সুযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহরী আর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র শাখা ইসলামি ছাত্রশিবির বিভিন্ন হলে সাধারণ ছাত্রদের আবেগকে পুঁজি করে অতি গোপনে ছাত্রলীগ বিরোধী ক্যাম্পেইন এর নামে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলো।

নিষিদ্ধ কিংবা অপ্রকাশ্য জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তার সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই আকর্ষণ যখন ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তা কোনো না কোনভাবে প্রকাশ্যে চলে আসে। কয়েকদিন আগে বুয়েট ছাত্র ইমতিয়াজ রাব্বী'র হল থেকে বহিস্কারের ঘটনায় বুয়েটে নিষিদ্ধ এবং অপ্রকাশ্য সংগঠনের এতোদিনের কর্মকান্ড প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ফলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত বছর যখন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে বুয়েটের ২৪ জন শিবির কর্মী সহ মোট ৩৪ জন ছাত্র দেশবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলো তখন বুয়েট প্রশাসন কিংবা আজকের সাধারণ ছাত্র নামধারীরা নিশ্চুপ ছিলেন। অথচ বুয়েট ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের কাছে অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয় মুখ সাদ্দাম হোসেনের প্রবেশকে কেন্দ্র করে সাধারণ ছাত্র নামধারীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধনের কর্মসূচি দিলেন। ভাবখানা এমন যে সাদ্দামের প্রবেশে বুয়েট ক্যাম্পাস অপবিত্র হয়ে গেছে।

সাদ্দাম হোসেন বুয়েট ক্যাম্পাসে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি। ক্যাম্পাসে বিশেষ প্রয়োজনে প্রবেশ করে অল্প সময় অবস্থান করেই চলে যান। অথচ এই ঠুনকো ঘটনায় সাধারণ ছাত্র নামধারীদের দাবির মুখে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র ইমতিয়াজ রাব্বীর হলের সিট বাতিল করা হলো।  তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে বুয়েটে কি কেবল স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ? আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র নামধারীরা কি সকলেই সাধারণ ছাত্র? না কি প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের ইন্ধনে তাদের এই আন্দোলন?

এই ঘটনাটি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্য প্রেসটিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। বুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রদের একপক্ষ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে অনড়। ছাত্রলীগের কঠোর এবং অনড় ভূমিকায় প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ইন্ধনে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে অপরপক্ষের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের অপরাজনীতি দৃশ্যমান হয়েছে। আন্দোলন কারীদের বেশিরভাগই যে সাধারণ ছাত্র নয়, তা দেশবাসী বুঝতে পেরেছে।

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েট ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা কর্তৃক মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ কে অত্যন্ত নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে পড়ে বুয়েট ক্যাম্পাস। ছাত্রদের দাবির মুখে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট প্রশাসন। সেই থেকে এতদিন বুয়েট ক্যাম্পাস ছিল ছাত্র  রাজনীতি মুক্ত। আবরার ফাহাদ এর হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকার শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করে। হত্যাকান্ডের পর আসামীদের প্রত্যেকে বুয়েট থেকে বহিস্কৃত হয়। হত্যাকারীদের পক্ষাবলম্বন না করে হত্যাকান্ডে জড়িত সকলকে তৎক্ষনাৎ বহিস্কার করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হত্যাকান্ডের পর সেদিনই আবরারের পিতা বাদী হয়ে মামলা করেন। মাত্র এক মাস ছয় দিনের মাথায় মামলার চার্জশীট দেওয়া হয় এবং দুই বছর দুই মাসের মাথায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর মামলার রায় হয়। রায়ে বিশ জন ছাত্রলীগ নেতার ফাঁসি এবং পাঁচ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়।

হত্যাকান্ডে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মোট পঁচিশ আসামীর সকলেই বুয়েটের ছাত্র। যদিও তারা মেধাবী কি না এই প্রশ্ন রয়েই যায়। কারণ সাজাপ্রাপ্ত সকলেই একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা কিংবা অনুসারী। তবে সংগঠন থেকে তাদের কেবল বহিস্কার করায় যথেষ্ট ছিল কি না এই প্রশ্ন রয়েই যায়। ছাত্রলীগের মত উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী, প্রাচীন এবং সুশৃঙ্খল ছাত্র সংগঠনের নেতারা কেন কিভাবে এ ধরণের নিপীড়নমূলক ঘৃণ্য পাশবিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হলো তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত ছিলো। ছাত্রলীগ বাঙালির ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। সেই সংগঠনের কোনো ইউনিটের নেতারা একজোট হয়ে একজন সাধারণ ছাত্রকে জঙ্গি কিংবা শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করবে এমনটা ভাবা যায়! ছাত্রলীগ কি সিরাজ শিকদারের সর্বহারা সংগঠন?

আবরার হত্যার পর বিগত সাড়ে চার বছর কেন বুয়েট ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের আস্থা অর্জন করতে পারলো না? ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে হল দখল, আধিপত্য বিস্তার এবং হলে টর্চার সেল গঠনের অভিযোগ পত্রিকার পাতায় বারবার উঠে আসে? কেন বারবার বিতর্কিতদের হাতে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়? ষাট এবং সত্তরের দশকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্ররা স্বাধীকার এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। ছাত্রলীগ ছিল ইতিবাচক কর্মকান্ডের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। আজ কেন বারবার ছাত্রলীগ নেতিবাচক কর্মকান্ডের শিরোনাম হয়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসন এর পাশাপাশি ছাত্রলীগের ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। শিক্ষার্থীদের যে কোন প্রয়োজনে, দাবি আদায়ের যৌক্তিক আন্দোলনে তাদের পাশে থাকা ছাত্রলীগের নৈতিক দায়িত্ব। অথচ ছাত্রলীগকে বিভিন্ন সময়ে বিপরীতমুখী ভূমিকায় দেখা যায়। এ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগের আজকের এই দূরত্ব।

আর এটিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন গুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেশবিরোধী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে পারছে। ক্ষমতার দম্ভ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করা যায় না। নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে হবে ছাত্রলীগকে। ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থায় আনতে পারলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব থাকবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে এবং রাজনীতি নয়, সকল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অপরাজনীতি মুক্ত হবে। সেটিই শিক্ষার্থী, অভিভাবক নির্বিশেষে সকলের প্রত্যাশা।

লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, খুলনা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭