ইনসাইড থট

পহেলা বৈশাখ উৎযাপনে তারিখ বিতর্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/04/2018


Thumbnail

গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার বা আমরা যাকে ইংরেজী বর্ষপঞ্জি বলি সেই ইংরেজী সালের কোন মাসের কয় তারিখে হবে পহেলা বৈশাখ? সেটা ১৪ এপ্রিল না ১৫ এপ্রিল? বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিলে ১লা বৈশাখ উৎযাপিত হলেও পাশেই ওপার বাংলা বা ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলে ১৫ এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ হিসেবে উৎযাপন করা হয়।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, কিছু ভিন্নমত থাকলেও মোগল সম্রাট আকবরের আমলেই খাজনাসহ অন্যান্য কর আদায়ে নানা সমস্যা দেখা দিত। প্রজারা অর্থাভাবে পারেন না ঠিকমতো খাজনা দিতে। সম্রাটও সব খবর জেনে কঠোর হতে পারেন না খাজনা আদায়ে। কারণ খাজনা আদায়ের যে দিন ধার্য ছিল সেই সময় প্রজাদের হাতে অর্থ থাকতো না। কৃষিভিত্তিক সমাজ তাই ফসল উঠার মৌসুম খাজনা আদায়ের সময় নির্ধারণ করা ভালো হবে ভেবে চিন্তা শুরু করলেন সম্রাট আকবর ও তাঁর সভাসদগণ। অনেক হিসাব নিকাশ করে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে ফসলী সন হিসেবে এই বাংলা সন চালু করা হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি লাভ হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই শুরু হয় পহেলা বৈশাখ উৎযাপন। তখন প্রজাদের প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের (চৈত্র সংক্রান্তি) মধ্যে সকল খাজনা ও অন্যান্য কর পরিশোধ করতে হতো।

বাংলা সন যেভাবেই চালু হক না কেন ‘বাংলা পঞ্জিকা একটি চান্দ্র-সৌর ভিত্তিক পঞ্জিকা। তারিখ নির্ধারণ করা হয় সূর্যের বিভিন্ন রাশিতে প্রবেশের পরের দিন থেকে। ক্ষণ, তিথি, নক্ষত্র, করণ, যোগ নির্ণয় করা হয় চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। বাংলা পঞ্জিকার তারিখ ২ ভাবে গননা করা হয়, যথা ১. সূর্য সিদ্ধান্ত (প্রাচীন সিদ্ধান্ত) ও ২. দৃক সিদ্ধান্ত (বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত) সূত্রানুসারে। উভয় সিদ্ধান্তের একটি মিল হল। সূর্য যেদিন কোন রাশিতে রাত্র ১২টার মধ্যে প্রবেশ করে পরের দিন বাংলা পঞ্জিকায় নতুন মাসের ১ম দিন হয়, না হলে ১ দিন পরে বাংলা মাস শুরু হয়’। তাই ইদানিং কালে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে কখনও ১৪ এপ্রিল কখনও ১৫ এপ্রিল ১ বৈশাখ হয়ে থাকে’। আমাদের দেশে ১ বৈশাখ ধরা হয় ১৪ এপ্রিল।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, ১৯৫২ সালে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাথ সাহা ভারতে প্রচলিত ভারতে প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জিকার আমূল সংস্কারের সুপারিশ করেন। অই প্রস্তাবের ভিত্তি ছিল আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান। ডক্টর মেঘনাথ সাহার প্রস্তাব অনুসারে বৈশাখ থেকে ভাদ্র এই ৫ মাস হবে ৩১ দিনের আর আশ্বিন থেকে ফাল্গুন হবে ৩০ দিনে। চৈত্র মাসও হবে ৩০ দিনে কিন্তু অধিবর্ষ বা লিপইয়ার হলে চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। সেই হিসেবে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হওয়ার কথা। কিন্তু ভারতের সনাতনপন্থীরা ডক্টর মেঘনাথ সাহার প্রস্তাব গ্রহন করেন নি। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন যে, পঞ্জিকা ব্যবসায়ীদের একগুঁয়েমির কারণেই ডক্টর মেঘনাথ সাহার প্রচলিত বর্ষপঞ্জিকার আমূল সংস্কারের প্রস্তাব ভারতে বাস্তবায়ন করা যায় নি।

এদিকে বাংলা একাডেমী ১৯৬৩ সালে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার সংস্কারের জন্য ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেয়। ঐ কমিটি ডক্টর মেঘনাথ সাহার প্রস্তাব অনুযায়ী বৈশাখ থেকে ভাদ্র এই ৫ মাস ৩১ দিনের আর আশ্বিন থেকে ফাল্গুন ৩০ দিনে করার প্রস্তাব করে। প্রস্তাবে আর বলা হয় যে, চৈত্র মাসও হবে ৩০ দিনে কিন্তু অধিবর্ষ বা লিপইয়ার হলে চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। তদানিন্তন পূরব পাকিস্তানের এই বাংলায় তা সাদরে গ্রহণ করা হয়। এর পর থেকে এই বাংলায় ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ আর ১৩ এপ্রিলকে চৈত্র সংক্রান্তির দিন ধরা হয়ে আসছে।

আমরা শৈশবে দেখেছি চৈত্র সংক্রান্তিতে হতো গ্রামীণ উৎসব। কয়েক দিনের দুধ জমিয়ে রেখে নানা ধরণের পিঠা পায়েস বানিয়ে তা বিলি করা হতো। ধানের পোয়াল (খড়) দিয়ে দড়ি বানিয়ে মঙ্গল কামনা করে ধুপ-ধুনো দিয়ে গাছে গাছে বেঁধে দেওয়া হতো যেন পরের বছর ভালো ফলন হয়। ভালো ফসলের জন্যও নানা অনুষ্ঠান করা হ’তো। ভালো খাবারের আয়োজন হতো চৈত্র সংক্রান্তিতে, ভাবটা এমন যে, ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তাঁর’। আবার বছরের শুরুর দিনের হালখাতার প্রস্তুতিও চলতো, পহেলা বৈশাখেও খাবার ছিল ভালো। তাই প্রাচীন বাংলায় মানে অবিভক্ত বাংলার কোনো কোনো এলাকায় চৈত্র সংক্রান্তি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো যা প্রলম্বিত হয়ে বৈশাখেও চলে আসতো। গান, বাজনা, খেলাধুলার মতো কিছু বিনোদনের আয়োজনও থাকতো এই উপলক্ষ্যে। পরে আবার কোন কোন এলাকায় ১লা বৈশাখে ব্যবসায়িরাও হালখাতা করতেন। নতুন বছরে নতুন খাতা খুলতেন হিসেবের। সেই অনুষ্ঠানে কিছু মিষ্টি জাতীয় হাল্কা খাবার, যেমন- জিলাপী, পরিবেশন করা হতো আগত অতিথীদের মাঝে, কিন্তু কখনো তাঁরা পান্তা ইলিশ খেতে দিতেন না। বাংলার অধিকাংশ গ্রামে পান্তা খাওয়া হতো পিয়াঁজ-মরিচ সাথে লবন দিয়ে, ইলিশ ছিল না সেখানে। বিশেষ করে- এখন যেখানে ইলিশ পাওয়া যায় সেইসব এলাকা বাদে বাকী এলাকায় ইলিশ ছিল দুস্প্রাপ্য মাছ। ছোট্ট এক টুকরা ইলিশ মাছের সাথে এক চামচ ঝোল দিয়ে লবন মেখে এক মাটির সানকি (মাটির থালা) ভাত খেয়ে নিতেন এসব উঁচু এলাকার মানুষ।

নগারায়ণ শুরু হলে মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ কাজের জন্য শহরে আসেন। কিন্তু তাঁদের নাড়ির টান রয়ে যায় শৈশবের স্মৃতি ঘেরা গ্রামে, গ্রামকে তাঁরা খুব মিস করতে লাগলেন। তাঁদের আর্থিক সঙ্গতি বাড়ার সাথে সাথে ১লা বৈশাখের আসল চরিত্র পাল্টে যেতে লাগলো, আস্তে আস্তে তা উৎসবের অনুষ্ঠানে মোড় নিতে থাকলো। যেমনভাবে হোলি ছিল ভালো ফসলের জন্য প্রার্থনার অনুষ্ঠান, কিন্তু এখন সেটা উৎসব। দিনে দিনে এই হোলি উৎসবের চরিত্র বদলে যাচ্ছে, হচ্ছে সর্বজনীন। এই হোলি উৎসবের চরিত্র আরও যে বদলে যাবে লক্ষণ দেখে তাই মনে হচ্ছে।

‘১৯১৭ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায় কোনো কোনো লেখায়। তবে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাংলা ১৩৭১ সালের ১লা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে এই বাংলায় বেশ ঘটা করে। এই উপলক্ষ্যে মেলা শুরু হয়। আর মেলায় আগতদের মাঝে নানা ধরণের খাবার বিক্রির প্রচলন হয়। বৈশাখে অনেক গরম, আর গরমের দিনে বাসায় বেঁচে যাওয়া ভাত পানি দিয়ে রাখা হতো। তা না হলে তা পচে যেতো (তখন ফ্রিজ ছিল না, গ্রামে তো ছিলই না)। এই পানি ভাত খেলে শরীর মানে পেট খুব ঠান্ডা মনে হয়। তাই মেলায় প্রাচীন বাংলার মাটির সানকিতে, লবন সহযোগে পিয়াজ মরিচ দিয়ে পান্তা খাওয়া / বিক্রি করা শুরু হ’লো, অনুষ্ঠানে গ্রামীণ আমেজ দিতে। পরে হয়তো ক্রেতার চাহিদা মেটাতে অথবা বেশী বিক্রির আশায় খাবারের মেনুতে নতুনত্ব আনতে ধীরে ধীরে এই পান্তার সাথে অন্যান্য তরকারী, ভর্তা যোগ হতে শুরু করে।

আচরণই চেতনার বহিঃপ্রকাশ। মানুষ তাঁর আচার আচরণে তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করেন। মা’কে জড়িয়ে ধরে বা চুমু দিয়ে মা’কে বুঝিয়ে দিই যে তাঁকে ভালোবাসি। প্রেমিকাকে ফুল দিয়ে আমরা প্রকাশ করি আমাদের ভালোবাসা। বন্ধু স্বজনদের নিজের বাসায় দাওয়াত করে কিংবা বিভিন্ন স্থানে মিলিত হয়ে প্রকাশ করি যে, আমরা ভালো বন্ধু, আপনজন। ভালোবাসা বা হৃদয়ের আকুতি প্রকাশের উছিলা তো লাগবেই। কোনো কিছু করা যথেষ্ট নয়, আমাদের চেতনা বা বিশ্বাসকে অন্যের মাঝে সঞ্চারিত করতে আমরা নানা উপায় অবলম্বন করে থাকি। বাংলাকে ভালোবাসার প্রকাশ তাই পহেলা বৈশাখের উৎসব হ’লে কি তাতে দোষের কিছু হবে!

ইদানিং পহেলা বৈশাখের উৎসব বর্ণিল হয়েছে আরো অনেক। ঢাকায় চারুকলার বিশাল আয়োজন দেখলে তার অনুমান করা যায়। পহেলা বৈশাখের উৎসব উপলক্ষ্যে ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে মংগল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই। তার ফলশ্রুতিতে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো বাংলাদেশের চার দশকের এই ঐতিহ‌্যের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দেয়। খাওয়া আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আরো অনেক উপাদান যোগ হয়েছে বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের উৎসবে। গ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে তা’ ছড়িয়ে পড়েছে। এখানেই শেষ হয়নি তার যাত্রা, এই উৎসব এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও ব্যাপ্তি লাভ করেছে। হয়ে উঠেছে সার্বজনীন উৎসব। আগামীতে এই উৎসবের চরিত্রের যে আরও পরিবর্তিত হবে তার লক্ষণও সুস্পষ্ট। সেখানে আর কী কী যোগ হবে বা থাকবে, তা এখন বলা যাবে না। সময় তা বলে দেবে। খাজনা আদায়ের জন্য যে বাংলা সন শুরুটা যদি চরিত্র বদল করে উৎসব হয় তাহলে বর্তমান পহেলা বৈশাখের চরিত্র যে বদলাবে না তাঁর গ্যারান্টি কে দেবে? তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়, আনন্দের জন্য, প্রাণের সাথে প্রাণের মিলনের জন্য উৎসবের মৃত্যু নেই, হবে না, এর কলেবর আরো বাড়বে বই কমবে না, এমনটি আশা করাই যায়।


বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭