ইনসাইড থট

বৈশাখের চাওয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/04/2018


Thumbnail

চৈত্রের শেষ দিন থেকে বৈশাখের প্রথম দিনটি মোটেও পৃথক নয় - তেমনি ভ্যাপসা গরম, তেমনি দাবদাহ, মাথার ওপর তেমনি সতেজ সূর্য থাকে এ দু’দিন জুড়েই। রাতের প্রহরগুলিও একই রকম অস্বস্তির। তারপরও দুই দিনে কত ফারাক! শেষ চৈত্রদিন একটি বছরের শেষ দিন, প্রথম বৈশাখ দিন এক নতুন বছরের সূচনা। চৈত্রদিনের সঙ্গে সম্পর্ক পুরাতনের, জীর্ণ-বিবর্ণ চিন্তার; বৈশাখ দিনের সঙ্গে নতুনের, নতুন প্রত্যয়ের, প্রত্যাশার। পৃথিবীর সকল সংস্কৃতিতে পুরাতন বছর-নতুন বছরের মধ্যে আছে এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। এর কারণ নৃতত্ত্ব আর গণসংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত। প্রকৃতির সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে, বাস্তবের সঙ্গে প্রতিদিন যাদের যুদ্ধ করতে হয়, বন্যা-খরা অথবা নদীভাঙ্গন-মরুকরণের প্রকোপে যাদের জীবন বিপন্ন হয়, সেই খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার তালিকাটা দীর্ঘ। কিন্তু সংগ্রামী মানুষেরা বিপর্যয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না, তারা সংগ্রাম করেই যায়। এই মানুষদের সক্রিয়তা পেছনে একটা প্রণোদনা যোগায় আশা; জীবন নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা। আজ ভালো কাটেনি, হয়তো কাল ভাল কাটবে, নয়তো পরশু - এরকম একটা আশা থেকে এসব মানুষ সান্ত্বনা খোঁজে। এজন্য কৃষিভিত্তিক সমাজে (শিল্পযুগের আগে যেখানে মেহনতী মানুষদের সমাবেশটা হত সবচেয়ে বড়, যা আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে এখনো হয়) ঋতুভিত্তিক পালাপার্বণ আর কৃত্যে রঙের প্রকাশ ছিল, গান ছিল, উচ্ছ্বাস ছিল, যেহেতু তা প্রতিদিনের কঠিন জীবনযাপনের বাস্তবতা কিছুটা হলেও আড়াল করত। ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলি ভবিষ্যৎ নিয়ে, জীবন নিয়ে মানুষের আশাবাদ তৈরি করত। বাংলা নববর্ষ, লাওস বা বালি অথবা মঙ্গোলিয়ার নববর্ষের মতই, নতুনকে আবাহন করে - নতুনের হাত ধরে পরিবর্তন আসবে, সুখী ভবিষ্যৎ আসবে, সেই আশায়। নববর্ষ পালনের ইতিহাসের শুরুতেও এরকমটা ছিল, এখনো আছে।

মেহনতী মানুষের চাওয়া পাওয়াটা খুব বড় কিছু নয়। আমাদের দেশে মায়েদের যে কামনা, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে,’ সেরকম সামান্যই নববর্ষে এইসব মানুষের চাওয়া। আমাদের বিশাল বাংলার অসংখ্য মানুষ এখনো পণ্যসংস্কৃতির ফাঁদে পড়েনি; দুর্নীতি আর নানা অপ-লেনদেনের পাঁকে পড়ে সর্বভুক হয়নি, ক্ষমতার মোহে জগৎটাকে করায়ত্ত্ব করার চিন্তারও কোনো কারণ তাদের নেই। তারা চায় জীবনে খানিকটা হাসি আনন্দ, দুবেলা আহার্য, রাতে একটি চালের নিচে ঘুমানোর সুযোগ, শিশুদের স্বাস্থ্য আর শিক্ষা, নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা। এসব চাওয়া তারা যে ঘটা করে বৈশাখে উচ্চারণ করে তা নয়, কারণ সারা বছরই তো এসব চাওয়া তাদের বৃথা যায়। তবে নতুন বছরে মনে মনে হলেও তারা হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছাগুলি আবার মেলে ধরে।

বৈশাখ নতুন এক রূপ নিয়েছে শহরের নানা উদযাপনে। বাংলাদেশে ঘটা করে নববর্ষ পালনের ইতিহাস পঞ্চাশ বছরও হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে সারা দেশ জাগে বৈশাখে। তবে শহরের মানুষজনের চাওয়াটা ভিন্ন, তার তালিকায় বস্তুর আধিক্য, চাকচিক্যের সমাহার। শহরের অনেক মানুষের এতই আছে যে চাওয়ার তাদের কিছু থাকার কথা নয়। তারপরও তারা চায়। হয়তো স্বাস্থ্য, আরো সুযোগ, আরো গতিশীলতা, আরো অর্জন। তাদের উদযাপনে রঙ প্রকট, জাকজমক প্রকট। তারা পান্তা ইলিশ আর বৈশাখি রঙের কাপড়-জামা-শাড়ি-ফতুয়ার একটা প্রথাই তৈরি করে ফেলেছে। শহরের মানুষদের বর্ষবরণের সঙ্গে গ্রামের মেহনতী মানুষদের বর্ষবরণের তফাৎটা প্রকট। তারপরও তারা এক জায়গায় এসে মেলে, এবং জায়গাটা হচ্ছে দেশ। গ্রাম আর শহর মিলেই দেশ। এই দেশটায় বৈষম্য বড়; শহরের মানুষ আর গ্রামের মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্যটা প্রকট। তারপরও সবাই মিলে যে পরিসরটা সজীব করেছে, তার নাম দেশ। একাত্তরে গ্রাম শহরকে আশ্রয় দিয়েছিল, এরপর শহর গ্রামকে শুধু বঞ্চিত করেছে। তারপরও সব মানুষের ভেতর একটা ঐক্য রয়ে গেছে। সেই ঐক্যের মূল সূত্রও ওই দেশ।

সেজন্য একটা জায়গায় বৈশাখের চাওয়াতেও মিল আছে। আগেই বলেছি, গ্রামের মানুষের, মেহনতী মানুষের চাওয়া সামান্য, শহরের মানুষের চাওয়াটা ব্যাপক। কিন্তু তাদের চাওয়ায় একটা অভিন্ন ভবিষ্যৎ জায়গা করে নেয়। এবং সেই ভবিষ্যৎ এক সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।

২. ১৪২৪ সালে আমরা অনেক পেয়েছি; আবার অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনার, অপঘটনার, নির্যাতনের, নিপীড়নের, সন্ত্রাসের, বঞ্চনার, অধিকার হরণের, ক্ষমতার দম্ভের, বিত্তের অহংকারের। গ্রামের এবং শহরের - এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, এসবের প্রতিকার চেয়েছে। এই বৈশাখে তাদের চাওয়া, ১৪২৫ সালে যেন এসব না দেখতে হয়।

চাওয়াটা সামান্যই। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান, সমাজ আর ব্যক্তি সবাই মিলে একটা জায়গায় একমত হলে এসবের প্রতিকার এবং পুনরাবৃত্তি রোধ সম্ভব। এবং এই জায়গাটা হচ্ছে সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের একটা সংকল্প।

বৈশাখের প্রথম দিনে আমাদের চাওয়া হোক ওই সামাজিক, সার্বজনীন ঐকমত্য, বাংলাদেশকে সুখী ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার প্রতীজ্ঞা।

বাংলা ইনসাইডারের সকল পাঠকের জন্য শুভ নববর্ষ।

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭