ইনসাইড পলিটিক্স

এবার উপজেলা নির্বাচনেও সাবেক-স্বতন্ত্র এমপির দ্বৈরথ


প্রকাশ: 05/04/2024


Thumbnail

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু তারপরেও নির্বাচন জমে উঠেছিল আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অংশগ্রহণে। শুধু নির্বাচনী পরিবেশ জমে উঠেছিল তাই নয়, দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বতন্ত্র হিসেবে জয়লাভ করেছিলেন ৬২ জন। এ ছাড়া তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছেন বেশ কয়েকজন। এরপর প্রায় তিন মাস পার হলেও কাটেনি সেই দ্বৈরথের রেশ।

উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে আরও একবার মুখোমুখি হচ্ছে এ দুই বলয়। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় নিজস্ব বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন স্বতন্ত্র এমপিরা। আর ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিজ নিজ অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছেন বিগত নির্বাচনে পরাজিত সাবেক এমপিরা। সেজন্য দুপক্ষই উপজেলা নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নানামুখী তৎপরতা।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্য ৬২টিতে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগ নেতারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কাছে হেরেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নৌকার প্রার্থীরা। ওই নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই বইতে শুরু করেছে উপজেলা নির্বাচনের হাওয়া। ফলে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে দ্বৈরথ তৈরি হয়েছিল, তা উপজেলা নির্বাচনেও বহাল থাকছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বর্তমান ও সাবেক এমপি সমর্থিতদের আলাদাভাবে নির্বাচন করার পথ উন্মুক্ত হয়েছে।

যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কাটাতেই উপজেলায় দলীয় প্রতীক দেওয়া হচ্ছে না। তবে দল মনোনীত প্রার্থী না থাকায় থাকায় প্রতিটি উপজেলায়ই ভোটের মাঠে নেমে পড়েছেন আওয়ামী লীগের দুই বা তারও বেশি নেতা।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমপি ও মন্ত্রীদের কাউকে সমর্থন দিতে নিষেধ করা হয়েছে। তবুও কেউ যদি পক্ষ নেয়, সেটা তার জন্যই আগামী দিনে বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়ে দল কড়া দৃষ্টি রাখছে। নির্বাচনের সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দলীয় শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটলে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবে না।’

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী, আগামী ৮ মে প্রথম ধাপের ১৫২টি উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু হচ্ছে। চার ধাপে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপে ১৬১টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের নির্বাচনের জন্য ২৯ মে ও ৫ জুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানান, বিগত দুটি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়া হলেও হঠাৎ সেই ধারার বিরতিতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। দল থেকে কাউকে মনোনীত করে না দেওয়ায় এবার জনপ্রিয় প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে তৃণমূলের অনেক নেতা মনে করেন। তবে একই সঙ্গে প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের কারণে দলের মধ্যে বিভক্তি আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা যেহেতু প্রার্থী হবেন, সেক্ষেত্রে নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়বেন, যা বিভেদের দেয়াল আরও সংহত করবে। এতে নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

এ ছাড়া দলের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এতে স্থানীয় সরকারে আওয়ামী লীগের আধিপত্যে ভাটা পড়তে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এর দ্বৈরথ বেশ পুরোনো। গত দুই নির্বাচনের মতো দ্বাদশ নির্বাচনেও কাজী জাফর উল্লাহ নিক্সনের কাছে পরাজিত হন। উপজেলা নির্বাচনেও এই দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যেতে পারে। এরই মধ্য ফরিদপুর-৪ আসনের তিনটি উপজেলায় দুই নেতার বলয়ের প্রার্থীরা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। সদরপুর উপজেলায় কাজী জাফর উল্লাহর বলয়ের জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান খান প্রার্থী হতে পারেন। তার বিপরীতে নিক্সনের বলয় থেকে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী শফিকুর রহমান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম বাবুসহ আরও দুজনের নাম শোনা যাচ্ছে।

অন্যদিকে নরসিংদী-৩ আসনে বর্তমান স্বতন্ত্র এমপি সিরাজুল ইসলাম ও সাবেক এমপি জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহনের দ্বন্দ্ব পুরোনো। এই আসনের শিবপুর উপজেলায় বর্তমান স্বতন্ত্র এমপির স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফেরদৌসী ইসলামের বিপরীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মোহনের মামাতো ভাই শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া রাখিল ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ প্রার্থী হবেন বলে আলোচনা রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য বদরুদ্দোজা মো. ফরহাদ হোসেন সংগ্রামের বলয় ভাঙার চেষ্টা করছেন বর্তমান এমপি সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। নাসিরনগর উপজেলায় দুই বলয় থেকে একাধিক প্রার্থী রয়েছে। সংগ্রামের বলয়ের প্রার্থী হিসেবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান সরকার ও রুমা আক্তারসহ কয়েকজন। বর্তমান এমপি একরামুজ্জামানের পক্ষের নেতাদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আব্বাস টিপু ও লতিফ হোসেন প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

কুমিল্লা-৪ আসনের বর্তমান স্বতন্ত্র এমপি আবুল কালাম আজাদ ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সংঘর্ষে গড়িয়েছিল। এই আসনের দেবিদ্বার উপজেলায়ও সবার নজর রয়েছে। এরই মধ্যে দুই বলয়ের প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে প্রচারে নেমেছেন। কালামের ছোট ভাই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মামুনুর রশীদ প্রার্থী হচ্ছেন। মামুনকে ঠেকাতে রাজীর বলয় থেকে মাঠে নেমেছেন সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক এ কে এম শফিকুল আলম (ভিপি কামাল) এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল চৌধুরীসহ কয়েকজন।

একই অবস্থা চট্টগ্রাম-১৬ আসনের বাঁশখালী উপজেলায়। এখানে সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ও বর্তমান স্বতন্ত্র এমপি মুজিবুর রহমানের বলয় থেকে রয়েছে প্রার্থী। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক খোরশেদুল আলম প্রার্থী হচ্ছেন মোস্তাফিজুর বলয় থেকে। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন মুজিবুরের বলয় থেকে উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক শিকদার।

দিনাজপুর-১ আসনের কাহারোল ও বীরগঞ্জ উপজেলায়ও রয়েছে বর্তমান স্বতন্ত্র এমপি জাকারিয়া জাকা ও সাবেক এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপালের দ্বৈরথ। দুটি উপজেলাতেই রয়েছে সাবেক ও বর্তমান এমপির প্রার্থী। কাহারোলে মনোরঞ্জন শীলের প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম ফারুক। অন্যদিকে জাকার প্রার্থী হচ্ছেন জেলা কৃষকলীগের সাবেক সহসভাপতি গপেশ চন্দ্র রায়। বীরগঞ্জ উপজেলায় বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের সঙ্গে মনোরঞ্জন শীলের সুসম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে জাকার প্রার্থী হতে পারেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু।

এর বাইরেও যেসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানকার উপজেলাগুলোতে সাবেক এমপিদের প্রার্থী রয়েছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘জনগণ একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে যাকে খুশি তাকে বেছে নেবে। একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করবেন। তবে কেউ যদি দলের মধ্যে অনৈক্য, বলয় সৃষ্টি করতে চায়, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ করে তাহলে আওয়ামী লীগ তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবে। নির্বাচনকে কঠোরভাবে মনিটর করছে আওয়ামী লীগ। শ্যালক, ভাগ্নে, স্ত্রী, ভাই ও এমপি লীগ হতে দেওয়া হবে না। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭