ইনসাইডার এক্সক্লুসিভ

তৃতীয় লিঙ্গের ক্ষমতায়ন: এলডিডিপি প্রকল্পের নীরব বিপ্লব (ভিডিও)


প্রকাশ: 05/04/2024


Thumbnail

খায়রুন তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর একজন। তবে সে আর দশজনের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে না, মানুষের কাছে চাঁদা চায় না কিংবা কারো কারো মতো অশ্লীল আচরণ করে মানুষকে বিব্রতও করে না। সময় করে একটু ঘাস কাটে, বাচ্চাকে সময় দেয়। তার পরিবারের সদস্যের যত্ন করতেই তার বেশির ভাগ সময় যায়। এভাবেই ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত হয় তার। যত স্বপ্ন পুরো পরিবার নিয়েই। সেই স্বপ্ন পূরণে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে। আর স্বপ্ন পূরণে সহযাত্রী হয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)।

বলছি, সিরাজগঞ্জ সদরের কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের খায়রুন হিজড়ার কথা। যিনি একজন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মানুষ। তবে এখন তার বড় পরিচয় হলো তিনি একজন পুরোদমে খামারি এবং প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের পিজি গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য। তার আইডি নম্বর ৬৮৮৭৮-এসসি-০৩-১১। শুরুতে ২০টি উন্নত জাতের মুরগি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে তার খামারে গরুর সংখ্যা ৫টি, ছাগল রয়েছে ৮টি। এছাড়া বেশ কিছু মুরগিও রয়েছে তার খামারে। দু মাস আগে একটি ছাগল বাচ্চাও দিয়েছে।

শুরুটা ২০টি মুরগি দিয়ে শুরু করলেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি খায়রুন হিজড়া। কোন অজ্ঞাত রোগে দু-একটি মুরগি মারা গেলে যোগাযোগ করেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় তাকে পরামর্শ দেন সেগুলো বিক্রি করে যেন তিনি ছাগল বা অন্য কিছু কেনেন এবং সেগুলো দিয়ে খামার করেন। এরপর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের পরামর্শে তিনি মুরগিগুলো প্রায় ১০ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা দরে দুটি ছাগল কেনেন। এরপরই যেন ঘুরে যায় খায়রুন হিজড়ার ভাগ্যের চাকা। এখন তার খামারে ছাগলের সংখ্যা ৮টি। একইভাবে ছাগলের পাশাপাশি একটি গরু দিয়ে শুরু করলেও এখন তার গরুর সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫টি। এতে করে দৈনিক তিনি ৭ থেকে ৯ লিটার গরুর দুধ বিক্রি করতে পারেন তিনি।

খায়রুন হিজড়া বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, আমি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে ট্রেনিং করেছি। এরপর তারা আমাকে ২০টি মুরগি দেয়। কিন্তু সেগুলো দিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারিনি। সেজন্য ‍মুরগি গুলো বিক্রি করে আমি ছাগল কিনেছি। পরে একটা সময় আমি একটি গরু কিনি। এখন আমার খামারের ৫টি গরু এবং ৮টি ছাগল এবং বেশ কিছু মুরগি রয়েছে।

এই খামার নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন থাকে একদিন সে ছোট থেকে বড় হবে। আমারও স্বপ্ন আছে একদিন আমি বড় খামারি হব। সেজন্য এখানে আমার বিনিয়োগ দরকার। যেটা আমার জন্য কঠিন বা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। কারণ আমরা হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) হওয়ার কারণে কেউ আমাদের ঋণ দেয় না, দিতেও চায় না। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার আমাদের জন্য দুষ্কর। সেজন্য সরকার থেকে যদি আমাদের বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে আমি যেমন আরও এগিয়ে যেতে পারব তেমনি আমার মতো হাজারো হিজড়া স্বাবলম্বী হবে। তাদেরকে কারও কাছে আর হাত পাততে হবে না। এছাড়া সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ মুরগির পরিবর্তে যদি ছাগল বা গরু দেয়া হয় তাহলে বেশ ভালো হবে। 

জানা যায়, দেশব্যাপী প্রান্তিক খামারিদের নিয়ে প্রোডিউসার গ্রুপ (পিজি) গঠন করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। উদ্দেশ্য এসব পিজিগুলোর মাধ্যমে প্রান্তিক খামারিদেরকে সংগঠিত করে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ইত্যাদি পৌঁছে দেওয়া এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধনে কাজ করা। 

সারাদেশে মোট ৬৫০০টি পিজি গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে সদস্যের সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ৪০ জন। মোট ৬৫০০ পিজি গ্রুপের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এটি একটি এবং একমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের পিজি গ্রুপ।

পিজি গ্রুপে শুধু খায়রুন হিজড়া একা নয়, তার সাথে আছে আরও ১৪ জন অর্থাৎ মোট ১৫ জন পিজি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সোহাগী হিজড়া (৬৮৮৭৮-এসসি-০৩-১২), মো: সবুজ ওরফে সংখিনী (৬৮৮৭৮-এসসি-০৩-১৩), সেতু হিজড়া (৬৮৮৭৮-এসসি-০৩-১৫) সহ আরও কয়েকজন। যারা প্রত্যেকে পিজি গ্রুপের সক্রিয় সদস্য।

সিরাজগঞ্জ জেলার হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) সমিতির সভাপতি মো: ওমর ফারুক রাব্বি বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্তৃক গঠিত ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের নিয়ে গঠিত ১৫ সদস্যের পিজি দল নিয়ে আমরা কাজ করছি। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর আমাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকি। গবাদি পশু থেকে শুরু করে লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কে, পিজি দলের দায়িত্ব-কর্তব্য কি, দলের সভাপতি, ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব কর্তব্য সর্ম্পকে এবং পিজি দলের নীতিমালা সম্পর্কে জেনেছি। 

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রত্যেক সদস্য প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে সঞ্চয় রাখি। রাজশাহী ‍কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে আমাদের পিজি দলের একটা একাউন্ট আছে। শুরুতে উপজেলা থেকে আমাদের ২০টি করে মুরগি দেয়া হয়। আমরা সেগুলো লালন পালন করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। পিজি দলের পক্ষ থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছে আমাদের অনুরোধ আমাদের যেন গরু এবং ছাগল দেয়া হয় তাহলে আমরা আরও ভালো ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারব। ফলে মানুষের কাছেও আমাদের আর হাত পাততে হবে না। আমরাও কর্ম করেই খেতে চাই। কারও মুখাপেক্ষী হতে চাই না। আমরা একটা দল গঠন করে দেখিয়েছি যে, হিজড়ারা সমাজের মূল স্রোতে এসে কাজ করে খেতে চায়। সমাজের সহযোগিতা পেলে আমরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো।

সিরাজগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, আমরা যখন রাস্তা ঘাটে বের হয় তখন দেখা যায় যে, রেল স্টেশন বা বাজারগুলোতে তারা (হিজড়া) অন্যের কাছে হাত পাতে। যেহেতু এলডিডিপি প্রকল্প থেকে সুযোগ ছিলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে নিয়ে আসা। এরই অংশ হিসেবে তৎকালীন রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক ডা. নজরুল ইসলাম ঝন্টু স্যারের মাথায় প্রথম এই ধারণা আসে। এদেরকে নিয়ে যদি একটা দল গঠন করা যায় তাহলে এরা মানুষের দ্বারে দ্বারে যে হাত পাতে এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং আমাদের সমাজের মূল স্রোতে তারা চলতে পারবে। তারাও আমাদের সমাজে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে। এই চিন্তা থেকেই আমরা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে সেটা প্রস্তাব করি। কর্তৃপক্ষ সেটা গ্রহণ করে। এরপর আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরুতে ২০টি করে মুরগি দিয়েছি। পাশাপাশি মুরগির খাদ্য এবং পাত্র দিয়েছি। সেখানে থেকে তারা এখন একটা ভালো অবস্থানে আছে। 

সিরাজগঞ্জের এই হিজড়া পিজি গ্রুপ একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ্য করে উপজেলা এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, হিজড়া নিয়ে আরও বৃহৎ পরিসরে কিভাবে কাজ করা যায় আমরা সেটা নিয়ে এগোচ্ছি। সিরাজগঞ্জ জেলায় ২০০৫ জন হিজড়া রয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে এই রকম দল আরও বাড়ানো যায় কিনা। এখন আমরা শুরুতে তাদের শুধুমাত্র মুরগি দিয়ে থাকি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তাদেরকে যেন আমরা গরু বা ছাগলও দিয়ে পারি সেটা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের নিয়ে যদি আমরা আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারি তাহলে সমাজে একটা বিপ্লব ঘটবে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭