ইনসাইড বাংলাদেশ

দুবাইয়ের পথে নাবিকরা, শিগগির ফিরছেন দেশে


প্রকাশ: 16/04/2024


Thumbnail

সম্প্রতি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে মুক্ত করতে টানা এক মাস ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার, জাহাজ মালিকসহ, সংশ্লিষ্টরা। অবশেষে সেই চেষ্টা সফল হলো। জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছেন এমভি আব্দুল্লাহসহ জাহাজটির ২৩ নাবিক। এজন্য দিতে হয়েছে মুক্তিপণ। কিন্তু কত টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হলো এমভি আব্দুল্লাহ, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চান না জাহাজ মালিকপক্ষের কেউই।

তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যথাযথ নিয়ম মেনেই মুক্ত করা হয়েছে এমভি আব্দুল্লাহ। তবে সোমালিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, লেনদেন হওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ৫০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে এই তথ্য জানিয়েছে সোমালিয়ার গণমাধ্যম দ্য ডেইলি সোমালিয়া। দুই জলদস্যুর বরাত দিয়ে রোববার একই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এদিকে নাবিকদের মুক্তির খবরে স্বস্তি ফিরেছে ২৩ নাবিকের পরিবারে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেন কবির গ্রুপের (কেএসআরএম) মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘জাহাজটি মুক্ত করা হয়েছে। এটি এখন আরব আমিরাতের দিকে যাচ্ছে। সেখানে পণ্য খালাস করবে, আর নাবিকরা দেশে ফিরে আসবে শিগগির’।

এদিকে রোববার (২৪ এপ্রিল) সকালে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘টাকা-পয়সা কিংবা মুক্তিপণের সঙ্গে আমাদের কোনো ইনভলভমেন্ট নেই। টাকা দিয়ে জাহাজ ছাড়িয়ে আনা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ছবি দেখাচ্ছেন, এসব ছবির কোনো সত্যতা নেই। ছবিগুলো কোথা থেকে আসতেছে, কীভাবে আসতেছে, সেটা আমরা জানি না। আমরা তাদের (জলদস্যু) সঙ্গে নেগোসিয়েশন করেছি দীর্ঘদিন। এখানে মুক্তিপণের কোনো বিষয় নেই। আমাদের আলাপ-আলোচনা এবং বিভিন্ন ধরনের চাপ আছে। সেই চাপগুলোও এখানে কাজে দিয়েছে।’

তবে, কতজন ফিরবেন দেশে, এখনো আসেনি সিদ্ধান্ত সোমালিয়ান দস্যুদের হাতে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত ২৩ নাবিকই এমভি আব্দুল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে রয়েছেন। আগামী ১৯ কিংবা ২০ এপ্রিল জাহাজটি আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এর পরই জানা যাবে, মুক্ত নাবিকদের মধ্যে কারা কারা জাহাজে থাকবেন এবং কারা আবুধাবি থেকে দেশে ফেরত আসবেন।

কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আবুধাবির আল হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর পর সিদ্ধান্ত হবে, মুক্ত নাবিকদের মধ্যে কারা জাহাজে থাকতে চান, কারা চান না। যারা আবুধাবি থেকে দেশে ফিরতে চাইবেন তাদের যাবতীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের আনা হবে।’

সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ২৩ নাবিক দেশে ফিরবেন বিমানযোগে। জাহাজটি আরব আমিরাতের দুবাই যাওয়ার পর সেখান থেকেই বিমানে উঠবেন তারা।

জলদস্যুদের কবল থেকে নাবিকসহ জাহাজটি মুক্ত হওয়ার আগেই নাবিকরা কে কোথা থেকে সাইন অফ (জাহাজের কর্ম থেকে অব্যাহতি) করবেন, তার তালিকা চূড়ান্ত করে রাখে জাহাজের মালিকপক্ষ। তাদের নির্দেশে এ ব্যাপারে ক্যাপ্টেনকে একটি তালিকাও দিয়েছেন নাবিকরা। সেই তালিকায় জাহাজের ২৩ নাবিকের মধ্যে ১৮ জন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দর থেকে সাইন অফ করবেন বলে জানিয়েছেন।

বাকি পাঁচজন জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছালে সাইন অফ করবেন বলে জানিয়েছেন। তার পরও নাবিকদের সবাইকে দুবাই থেকে এক যোগে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে জাহাজটির মালিকপক্ষ।

কেএসআরএম গ্রুপের ডিপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত জানান, ঈদের আগেই নাবিকদের ফিরিয়ে আনার কথা ছিল; কিন্তু এর সময় পরিবর্তন হয়। অতীতে জাহান মণির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত সময়ে ২৩ নাবিককে মুক্ত করা হয়।

তিনি আরও জানান, মুক্ত হওয়া ২৩ নাবিককে বিমানে চট্টগ্রামে নেওয়া হবে। চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা ফিরবেন স্বজনদের কাছে। আর উদ্ধার হওয়া জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ যাবে দুবাইয়ে। সেখানে ওই জাহাজে যোগ দেবেন নতুন নাবিকরা।

যেভাবে পৌঁছানো হয় টাকা মুক্তিপণ হিসেবে ডলারভর্তি তিনটি বস্তা পেয়ে জিম্মি ২৩ নাবিককে মুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ত্যাগ করেছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। গত শনিবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টায় মুক্তিপণের ডলার জলদস্যুদের হাতে পৌঁছালে নাবিকসহ জাহাজটি তারা ছেড়ে দেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কেএসআরএম গ্রুপের ডিপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত।

জলদস্যুদের এক আবদিরাশিদ ইউসুফ রয়টার্সকে বলে, আমাদের কাছে দুই রাত আগে মুক্তিপণের অর্থ এসেছে। সেগুলো জাল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখেছি। তারপর আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে সরকারি বাহিনীকে এড়িয়ে চলে যাই। সব নাবিকসহ জাহাজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ডেইলি সোমালিয়া বলছে, মার্চে ভারত মহাসাগরে জিম্মি হওয়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর মুক্তি জন্য জলদস্যুরা ৫০ লাখ ডলার নিয়েছে বলে জানা গেছে। জলদস্যু পালিয়ে গেছে এবং পান্টল্যান্ড বাহিনী তাদের ধরতে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে বলে পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিন দিন বিলম্বে ঈদ এসেছে নাবিকদের ঘরে অক্ষত অবস্থায় সব নাবিকের মুক্তি পাওয়ার খবর শুনে জিম্মি থাকা নাবিকদের পরিবার এখন আনন্দে উদ্বেলিত। ঈদের তিন দিন পরই যেন প্রকৃত ঈদ আনন্দ এসেছে তাদের ঘরে। জাহাজটির প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খানের মা শাহনুর আক্তার বলেন, ‘ঈদের তিন দিন পরেই যেন ঈদ এসেছে আমাদের ঘরে। আমার ছেলেসহ সবাই অক্ষত অবস্থায় মুক্তি পেয়েছে, এই খবর শোনার পর ভালো লাগছে সব। তারা এখন নিরাপদে দেশে ফিরলে টেনশন থেকে মুক্তি পাব।’

মালিকপক্ষের সংবাদ সম্মেলন এমভি আব্দুল্লাহ

এদিকে জাহাজটি মুক্ত হওয়ার পর রোববার (১৪ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত কেএসআরএম ভবনে সংবাদ সম্মেলনে করে জাহাজের মালিকপক্ষ। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) শাহরিয়ার জাহান রাহাত জাহাজটিকে ২৩ নাবিকসহ দস্যুমুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, ‘পুরো ঘটনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোরভাবে মনিটর করেছেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধারে বিদেশি যুদ্ধজাহাজ অভিযান চালাতে চেয়েছিল; কিন্তু আমরা বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চেয়েছি। আমাদের কাছে নাবিকদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। যে কারণে আমরা অভিযানে সম্মত ছিলাম না। আমাদের সরকার কুইক রেসপন্স করেছে। পুরো ঘটনায় সাংবাদিকরা সহযোগিতা করেছে। আশা করছি, ১৯-২০ এপ্রিল জাহাজটি আমিরাত পৌঁছাবে। এরপর নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, জাহান মণির সময় আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল। তখন উদ্ধারে সময় বেশি লেগেছিল। এবার জাহাজ দস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকেই আমরা জাহাজের লোকেশন ট্র্যাক করতে থাকি। যোগাযোগ শুরুর পর প্রতিদিনই দস্যুদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গত দুদিন আগে আমাদের দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক নাবিকের ভিডিও নিয়েছি। মুক্তিপণের প্রতিটি কাজ আইনগতভাবে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে। কত ডলার সে বিষয়টি আমরা নানা কারণে বলতে পারছি না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোমালিয়া, কেনিয়ার নিয়ম মানতে হয়েছে।

আবারও জলদস্যুদের হামলার শঙ্কা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরার পথে আবারও জলদস্যুদের কবলে পড়ার শঙ্কায় এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি স্পেন ও ইতালির নৌবাহিনীর স্কর্টে ভারত মহাসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ অতিক্রম করতে যাচ্ছে ‘এমভি আব্দুল্লাহ’। সোমালীয় জলদস্যুদের অন্য কোনো গ্রুপ হামলা চালানোর শঙ্কায় এ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান মেরিন বিশেষজ্ঞরা।

কেএসআরএম গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) শাহরিয়ার জাহান রাহাত জানান, ‘ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ ঘিরে রেখেছে এমভি আব্দুল্লাহকে। তারাও একটি মানসিক চাপের মধ্যে ছিল। আমাদের মতো চারটি দেশের নৌবাহিনীর তাগিদ ছিল, যাতে তাড়াতাড়ি ওই ইস্যুটা সমাধান করা যায়। এ কারণে আল্লাহর রহমতে আমরা এ ইস্যুটা দ্রুত সমাধান করতে পেরেছি।’

কেএসআরএমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেন, আমেরিকার একটা কন্ডিশন আছে, একটি ডলার নিতে হলেও তাদের সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। ওটা আমাদেরও নিতে হয়েছে। এ ধরনের ইন্টারন্যাশনাল কাজে তাদের অনেক অ্যাসোসিয়েটের সমন্বয় করতে হয়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭