ইনসাইড বাংলাদেশ

কক্সবাজারে দৌরাত্ম বাড়ছে মানব পাচার সিন্ডিকেটের


প্রকাশ: 30/04/2024


Thumbnail

কক্সবাজারে মানব পাচারকারীদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়দের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এরই মধ্যে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা করেছে সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। তালিকায় ৩০ জন রোহিঙ্গা ও ৩০ জন স্থানীয় বাসিন্দার নাম পেয়েছে গোয়েন্দা সূত্র।

 

তদন্তে উঠে এসেছে মানব পাচারের ভয়ংকর তথ্য। পাচারকারীরা ভুক্তভোগীদের উন্নত জীবনযাপনের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখিয়ে সাগর পথে নিয়ে যাওয়ার পর অনেকে ফিরেছেন লাশ হয়ে। পাচারকারী ৬০ জনের ৩০ জনই রোহিঙ্গা সদস্য। আর ভুক্তভোগীদের মধ্যে মিয়ানমারের বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গা সদস্যদের সংখ্যাই বেশি।

 

স্থানীয়দের মধ্যে বাংলাদেশি এই চক্রের অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ হোসাইন ওরফে ডাকাত হোসাইন ওরফে দালাল। চক্রের ৬০ জনই মানব পাচারের সিন্ডিকেট বিদেশি নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত।

 

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশি মানব পাচারকারী চক্রটি মিয়ানমারের নৌ বাহিনী ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সংশ্লিষ্টতায় এবং সেখানকার দালাল চক্রের মাধ্যমে নৌ পথে প্রথমে থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়া নিয়ে যায়। সেখানে বিমানযোগে বৈধভাবে অন্যান্য দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। এরপর সেখানে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের জিম্মি করা হয়।

 

আকাশপথে নেওয়ার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের ট্রলারে করে থাইল্যান্ড থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পাচার করে সেখানকার দালালদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। যাদের জিম্মি করা হয় তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের মুক্তিপণ নিয়ে সাগরপথে আশপাশের দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৯ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ১৯ টি মানব পাচারের মামলা হয়। মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

 

যে কৌশলে পাচার হয়ে থাকে:

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা ট্রলার ও কার্গোতে আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রী খালাসের পর রপ্তানি যোগ্য পণ্যের জন্য ট্রলার ও কার্গো নাফ নদীর জাইল্লার দ্বীপে নোঙ্গর করে থাকে। মাদক চোরা চালান ও মানব পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গারা নাফ নদীর জাইল্লার দ্বীপে নোঙ্গরকৃত ট্রলার ও কার্গোর পরিচালকের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করে ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার জন্য।

 

গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে তথ্য উঠে এসেছে, তৎকালীন রোহিঙ্গা শরণার্থী পাচারের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা সাগরপথে ট্রলারযোগে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত তাদের আত্মীয়দের কাছে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন।

 

উল্লেখ্য, আশ্রয় শিবিরের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কর্মহীন অবস্থায় বসবাস করায় এবং মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রলম্বিত হওয়ায় আত্মস্বীকৃতি ও কাজের সন্ধান করতে গিয়ে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে এসব রোহিঙ্গারা। এভাবে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়ায় সাগরপথে যাওয়া স্বল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে পারলেও এদের বেশিরভাগই সমুদ্রে ট্রলার ডুবিতে মারা যান। আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার ও উদ্ধারও হন।

 

বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে উন্নত জীবনযাপনের আশায় বিদেশে অবৈধভাবে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে। আরেকটি অংশ অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ গিয়ে কাজের পাশাপাশি বাংলাদেশি পরিচয়ে অবৈধভাবে বসবাস এবং পাসপোর্ট সংগ্রহের চেষ্টা করে থাকে। রোহিঙ্গাদের এমন কার্যকলাপের কারণে সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শ্রম বাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

 

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বিগত সময়ে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। বিদেশে চাকরি প্রত্যাশী যারা যাচ্ছেন সেসব রোহিঙ্গারা দালালদের মাথাপিছু আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে থাকেন। আর টাকা দিয়েও প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকে।

 

কারাভোগ শেষে ফিরে এলেন ১৭৩ জন:

প্রায় আড়াই বছর মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মিয়ানমারের নৌ বাহিনী ও বিজিপির কাছে আটক হয়ে কারাভোগের পর গত বুধবার (২৪ এপ্রিল) ১৭৩ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ১৭৩ জনের মধ্যে ১২৯ জনই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন থানার, ৩০ জন বান্দরবান জেলার এবং ৭ জন রাঙ্গামাটি জেলার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার বাসিন্দা। তবে পুলিশের ভাষ্য, এই ১৭৩ জন শুধু মানব পাচারকারীদের কাছেই নয় বিভিন্ন কারণে তারা ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন।

 

গত বুধবার (২৪ এপ্রিল) ১৭৩ জনের মধ্যে কারাভোগের পর দেশে ফিরে আসেন টেকনাফ উপজেলার রাজারছড়া এলাকার মোস্তাক আহমেদের ছেলে নোমানসহ আরও ৫০ জন। তারা মিয়ানমারের নৌবাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন আড়াই বছর আগে। তারা সমুদ্রপথে ট্রলার করে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে আটক হয়েছিলেন।

 

ওই ট্রলারে দেশের বিভিন্ন স্থানের আরও ৪৯ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের বহনকারী ট্রলারটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থায় ছিল। চার থেকে পাঁচ দিন সাগরে ভাসমান থাকার পর মিয়ানমারের নৌ বাহিনী তাদের আটক করে। পরে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে সে দেশের কারাগারে পাঠায়। প্রায় আড়াই বছর (৩০ মাস) কারাভোগের পর বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রচেষ্টায় গত ২৪ এপ্রিল স্বদেশে ফেরত আসেন নোমান।


নোমান জানান, উন্নত মানের চাকরির আশায় উনছিপ্রাং এলাকার হোসাইন দালালের প্রলোভনে পড়ে তিনিসহ রামু, মহেশখালী এবং আরও বিভিন্ন এলাকার ৪৯ জন মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিলেন। তাদের আটক করার পর প্রতিদিন এক বেলা খাবার দেওয়া হতো। কারাগারে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পাশাপাশি অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধারণা করা হয়েছিল, কখনো আর ফেরা হবে না দেশে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছে তারা।

 

কইভাবে নোমানের মতো হোসাইন দালাল চক্রের খপ্পরে পড়েন হোয়াইক্ষ্যং এলাকার বাসিন্দা রশিদ আহমদ। কক্সবাজারে বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে দুই ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

এসময় তিনি বলেন, ‘আমার দুই ছেলে মুক্তার আহমেদ আল মামুনকে অল্প টাকায় মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে হোসাইন দালাল টেকনাফের বাহারছড়ার জাহাজপুরা এলাকা থেকে বোটে তুলে দেন। বোটে কয়েক দিন থাকার পর মিয়ানমার সীমান্তে নামিয়ে দেয়। পরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি তাদের আটক করে। হোসাইন দালাল মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দুই লাখ টাকা নেন। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বিভিন্ন অজুহাত দেখান। পরে দুই ছেলে মিয়ানমার থেকে কল করে জানায়, তারা কারাগারে আছে। হোসাইন দালালের ঘরে বেশ কয়েকবার গেলেও উল্টো আমাকে হুমকি দিয়ে তিনি বের করে দিয়েছিলেন। তিনি অনেক প্রভাবশালী। তার এক ভাগনে নাকি মন্ত্রীর সচিব।




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭