প্রকাশ: 21/05/2024
একটি বাউন্ডুলে কিশোর থেকে আমি ও
আমার মত হাজার জনের
আজকের অবস্থানে আসার বাস্তবতা পদ্মা
পাড়ের রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ আর পদ্মারমতোই উদার ও গভীর
জ্ঞানের অধিকারী শিক্ষকদের কাছে ঋণী। পদ্মা
যেমন স্বচ্ছ পানি আর উর্বর
পলি দুকূলে বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করে
না, ঠিক
তেমনি আমাদের সময়ের শিক্ষকেরা তাদের জ্ঞান বিতরণে কখনো কার্পণ্য করতেন
না। তবে তার চেয়েও
বড় কথা হলো, কেবল
জ্ঞান সম্পন্ন বা শিক্ষিত হওয়ার
চেয়েও আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকরা জোর দিতেন ভালো
মানুষ হওয়ার উপর। তেমনি একজন
পিতৃতুল্য শিক্ষক সবার প্রিয় নজরুল
ইসলাম স্যার আমাদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে
যাত্রা করেছেন গত ১৯ মে
২০২৪ তারিখে।
আমরা ১১ - ১৩ বছরের
কিশোররা ক্যাডেট কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখনও আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে
থাকার মতো শক্ত মনের
অধিকারী ছিলাম না। নজরুল ইসলাম
স্যার সহ চারজন স্যার
তখন হাউজ মাস্টার (হোস্টেল
পরিচালক) হিসাবে পরম মমতায় আমাদের
বরণ করে নেন। থাকা,
খাওয়া, লেখাপড়া, বইপত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা বহির্ভূত সৃজনশীল কাজ, বাগান করা,
পিকনিক, শিক্ষা সফর ইত্যাদি অনেক
কিছুর ভেতর দিয়ে শিক্ষকরা
আমাদের সম্পৃক্ত করেছিলেন উন্নত মানুষ গড়ার মহান ব্রত নিয়ে।
আমাদের স্বভাব ছিল নানা প্রকৃতির। কেউ দুরন্ত, কেউ শান্ত, কেউ সাহসী,
কেউ ভীতু, কেউ ধনী, কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ গরিব, কেউ শহুরে, কেউ গেঁও, কেউ মেধাবী, কেউবা
আবার অমনোযোগী। এমন নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে যোগ দেয়া সবাইকে হাউজ মাস্টার হিসেবে নজরুল স্যার এক সুতোয় বেঁধেছিলেন।
যার যে প্রতিভা ছিল, সেটাই শানিত করে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিতেন সবাইকে। মনে পড়ে স্যার
কখনো দেয়াল পত্রিকা লেখার কৌশল দেখাচ্ছেন, আবৃতি-বক্তৃতা-বিতর্ক শেখাচ্ছেন, নাটকের
মহড়া করাচ্ছেন, খেলার মাঠে অন্য হাউসকে ঘায়েল
করার মন্ত্র দিচ্ছেন আবার পড়ার সময় পুরো পড়া আদায় করে ছাড়ছেন। সাধারণজ্ঞান প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির সময় মনে হতো কি জানেননা
এই পন্ডিত।
ক্যাডেট কলেজে সব ছিল ধরা
বাধা বা ছকে আঁকা।
সকালে শারীরিক প্রশিক্ষণ বা প্যারেড, এরপর
ক্লাস, দুপুরে নির্জনে বিশ্রাম, বিকালে খেলাধুলা, সন্ধ্যায় নামাজ শেষে লেখাপড়া আর
রাত দশটায় আলো নিভিয়ে ঘুম
- সাধারণত এর ব্যতিক্রম হওয়ার
কোন সুযোগ ছিল না। সপ্তাহে
দুদিন আমরা নাটক এবং
খবর দেখতে পেতাম দেশে একমাত্র টিভি
চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের কল্যাণে। অথচ এরই মাঝে
নজরুল স্যার কিভাবে যেন দেয়াল পত্রিকা,
নাটক, আবৃতি, বাগান, নামাজ সবকিছুই আমাদের হাতে-কলমে শিখিয়ে
ছেড়েছেন।
স্যার ছিলেন অর্থনীতির শিক্ষক। ক্যাডেট কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্ররা বেশি পড়ে আর
মানবিক বিভাগে ছাত্র থাকে তুলনামূলক ভাবে
কম। তাই নজরুল স্যার
মানবিক বিভাগ তথা অর্থনীতির ছাত্রদের
বুকে টেনে নিতেন। অর্থনীতির
মত একটি নিরস ও
জটিল বিষয়ও স্যারের উপস্থাপনা গুনে জীবন্ত হয়ে
উঠতো । আজকের দিনেও
হঠাৎ যখন পেঁয়াজ কিংবা
ডিমের দাম বেড়ে যায়,
নজরুল স্যারের কথা মনে পড়ে, যিনি
কি সুন্দরভাবে বুঝিয়েছিলেন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে
কৃত্রিম সংকট, যুদ্ধ বা রাজনীতি ঢুকে
গেলে অর্থনীতিতে কিভাবে বিপর্যয় ঘটে।
মনে পড়ে বেশি নাম্বার
পাওয়ার লোভে পৃষ্ঠার পর
পৃষ্ঠায় কত কিছু লিখে খাতা
ভরাতাম। ভাবতাম, সার কি আর
এত কিছু পড়বেন? বাস্তবতা
হলো, স্যার দাড়ি, কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত
পড়ে সব ভুল ধরিয়ে
দিতেন এবং সঠিক উত্তর
বুঝিয়ে দিতেন। মনীষীদের প্রতিটি কোটেশন যেন স্যারের মুখস্থ
ছিল। একটু এদিক ওদিক
হলেই ধরা পড়ে যেতাম।
এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায়
অর্থনীতিতে ছাত্ররা বরাবরই সর্বোচ্চ নাম্বার পেত। এসব ছাত্রদের
অনেকেই আজ দেশ-বিদেশের
নাম করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেউ কেউ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক ও
গবেষক।
৭০ দশকের শেষে ও আশির
দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা।
নজরুল স্যার ছিলেন আমাদের রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের বিতর্ক দলের মেন্টর তথা অভিভাবক বা
পরিচালক। আমরা স্কুল পড়ুয়া হলেও আমাদের প্রতিপক্ষ থাকতো বুয়েট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের
কোন একটি হলের বিতার্কিকরা। নজরুল স্যার একটা কথাই বলতেন, তুমি তোমার সেরাটা উপস্থাপন
করো, অপরপক্ষে কে আছে, তা দেখার দরকার নেই।
স্যার দুপুরের বিশ্রামের
সময় বা বিকেলের খেলার সময় আমাদের নিয়ে বসতেন। ঘড়ি ধরে বিতর্ক করাতেন। তারপর বাসে
করে রাজশাহী থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যামাগার ও সুইমিং পুলের
পাশে খেলোয়াড়দের জন্য একটি ডরমেটরি আছে। তার এক প্রাক্তন ছাত্রের আশীর্বাদে আমাদের
নিয়ে সেখানে উঠতেন। আরেক ছাত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ'র শিক্ষক। তাকে বলে
সেমিনার হল খোলাতেন আমাদের অনুশীলন করানোর জন্য। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিপক্ষ দলের বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রদের চেহারা দেখানো, যাতে আমরা বিতর্কের সময় ভয় না পাই। সেই সেমিনার হলের মঞ্চে
দাঁড় করিয়ে আমাদের বিতর্ক অনুশীলন করাতেন।
চূড়ান্ত দিনে বিটিভি
ভবনে আগেভাগে নিয়ে যেতেন। তিনি জানতেন বক্তৃতা দেয়ার ডায়াস বা রোস্ট্রাম (লেকচার
স্ট্যান্ড) আমাদের উচ্চতার তুলনায় বেশ উঁচু হবে। কারণ আমরা ছিলাম স্কুল কলেজ পড়ুয়া
কম উচ্চতার। তাই আগেভাগেই প্রযোজককে বলে পায়ের নিচে দেয়ার মত কাঠের চৌকি জোগাড় করতেন,
যাতে টিভি ক্যামেরায় আমাদের ভালোভাবে দেখা যায়। এত দিকে নজর থাকতো স্যারের।
বিতর্ক শুরুর আগে দর্শক সারিতে বসা স্যারের দিকে তাকাতাম। স্যার মৃদু হেসে হালকা করে হাত উঁচু করে একটা ইশারা দিতেন। সেই ইশারা দেখে মনে হতো আমি বিশ্বের সেরা বক্তা, আজ আমাকে দিয়ে বিশ্বজয়ও সম্ভব। সত্যিই আমরা পেরেছিলাম। স্কুল পড়ুয়া হয়েও একে একে বহু কলেজ, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে হারিয়ে পর পর কয়েক বছর আমরা উপরের রাউন্ডে যেতে পেরেছিলাম। এক রাউন্ড জিতলেই বিটিভি ভবন থেকে সোজা এলিফ্যান্ট রোডে নিয়ে যেতেন চাইনিজ খাবার খাওয়াতে। স্যারের মুখে থাকত বিশ্বজয়ের হাসি ও তৃপ্তি।
এমন মহান শিক্ষকের মৃত্যু
নেই। তবুও তার চলে যাওয়া অনেক কষ্ট দেয় আমাদের। এমন শিক্ষক খনজন্মা। এমন শিক্ষক স্রষ্টার
আশীর্বাদ। ওপারে ভালো থাকুক আমাদের প্রিয় নজরুল স্যার।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭