সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানকে নিয়ে এখন সারা দেশ জুড়ে তোলপাড় চলছে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি আদালত ক্রোক পরোয়ানা জারি করেছে। বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী এবং কন্যার নামে থাকা ৮৩ টি বিভিন্ন স্থাবর সম্পত্তি দলিল জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এছাড়া তাদের ব্যাংক একাউন্টও জব্দ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেনজীর আহমেদ অত্যন্ত দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ চাউর হয়েছিল। এখন বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে।
সোমবার (২০ মে) মধরাতের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে ‘ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে যে অভিযোগ গুলো উত্থাপন করা হয়েছে সে অভিযোগগুলো বহুল প্রচারিত এবং পুরোনো। অভিযোগগুলো প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন আল জাজিরা ‘অল প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রামাণ্য চিত্র প্রচার করেছিল। ঐ প্রামাণ্য চিত্রটি নির্মাণ করেন ডেভিড বাগম্যান, তাসনিম খলিল এবং জুলকার নাইন। এরা তিনজনজনই বিতর্কিত, মতলববাজ এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য পরিচিত। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে জোর করে যুক্তিহীন ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে টেনে আনার করার চেষ্টা হয়েছিল। আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রীর লোক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এ প্রতিবেদনে। ঐ সময় ঐ প্রতিবেদন নিয়ে দেশে বিদেশে হৈ চৈ হয়।
মার্কিন ঘোষণার পর সাবেক সেনাপ্রধান তার মতো করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিজিবির মহাপরিচালক এবং সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় কোন রকম দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেননি। গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এটিও বলেছেন যে, এ ঘটনা সরকারকেও হেয় করে।
আজিজ আহমেদের নিষেধাজ্ঞার ঘটনাটি এমন এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করলো যখন দুই দেশ সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করেছেন। এ সফরে তিনি অতীতের তিক্ততা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছেন। লু এর সফরের পর সরকারের মধ্যে ছিলো স্বস্তি ভাব। বিএনপির মধ্যে হতাশা। তবে ডোনাল্ড লু তার সফরে সুস্পষ্টভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। আর তিনি ফিরে যাবার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনাপ্রধানের উপর এই নিষেধাজ্ঞার বার্তাটি ঘোষণা করলো। বাংলাদেশে সাবেক সেনাপ্রধানের এই নিষেধাজ্ঞার ঘটনাটি নিয়ে নানারকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি এই ঘটনার পর স্ববিরোধী অবস্থান নিয়েছে। দলের মহাসচিব মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এতে বিএনপির কিছু যায় আসে না। তার মতে এই নিষেধাজ্ঞা একধরনের বিভ্রান্তি। এটিকে তিনি বলেছেন ‘আই ওয়াশ’। আবার দলটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিকে সরকারের দায় হিসেবে প্রচার করছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দুরকম।পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টিকে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন বিষয় নয় বলেই মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানিয়েছিল বলে উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মন্তব্যও ছিলো একই রকম। কিন্তু বুধবার ওবায়দুল কাদের কথা বললেন উল্টো সুরে। ‘নিশি রাতের স্যাংশন পরোয়া করিনা’ বলে হুংকার দিলেন কাদের। আমি মনে করি এটি ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা। দুই দেশের সম্পর্কের উপর এটি কোন প্রভাব ফেলবে না। ব্যক্তির অপরাধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরকম নিষেধাজ্ঞা হরহামেশাই দেয়।
তবে এই নিষেধাজ্ঞার বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। জেনারেল আজিজ আহমেদ বাংলাদেশে একজন আলোচিত বিতর্কিত এবং সমালোচিত ব্যক্তি। ২০২১ সালের জুনে সেনাপ্রধানের পদ থেকে তিনি অবসরের পর নিভৃত জীবন যাপন করছেন বটে, কিন্তু তিনি সেনাপ্রধান এবং বিজিবির মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় তার কর্মকান্ড নিয়ে নানামুখী আলাপ আলোচনা এখনও চলমান। তার তিন ভাইকে নিয়ে সত্য-মিথ্যা নানা গল্প বিভিন্ন মহলে আলোচনা হয়। অনেকের ধারণা আজিজ আহমেদের কারণেই তারা বেপোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর কেউ কেউ একটি সরল সমীকরণ আনার চেষ্টা করছেন। তারা বলছে যে, আজিজ আহমেদ এইসব অপকর্ম করেছেন সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। বিতর্কিত এবং যুদ্ধ অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক ডেভিড ব্যাগম্যান ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা আল জাজিরার প্রতিবেদনে আজিজ আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই প্রামাণ্য চিত্রকে সামনে এনে অনেকে অপপ্রচারের নতুন এজেন্ডা গ্রহণ করেছে। কিন্তু নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করলে আল জাজিরার প্রতিবেদনে এটিই ছিলো সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে আজিজ আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের বিষয় আমলে নেয় নি। নির্মোহভাবে তার অনিয়ম গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো যে, আজিজ আহমেদ কি প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পায় এবং প্রশ্রয়ে কি তিনি এই কথিত অপরাধগুলো করেছিলেন? এর উত্তর 'না'। প্রধানমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালনকালে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধান পদে নিযুক্ত করেছেন। তাদের অনেকে সততা, ন্যায় নিষ্ঠার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একটি পদে ভালো বা খারাপ করা ব্যক্তির বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর নয়।
কোন দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রীর লোক হতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন তিনি কোন রাজনৈতিক দলের না, তাকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। সরকার নানারকম সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবতার কারেণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান করতে পারছে না একথা সত্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন দুর্নীতিবাজকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন এমন কথা কেউ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন না। দুর্নীতিবাজদের কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট বলে প্রচার চালানোর এক নোংরা খেলা ইদানিং প্রকট হয়েছে। এটি পরিকল্পিত মিথ্যাচার। এর উদ্দেশ্যে একটি জনগণের আস্থার জায়গা নষ্ট করা। বিজিবি বা সেনাপ্রধান হিসেবে আজিজ আহমেদ কোন অপরাধ করলে, তার দায় একান্তই তার, অন্য কারো নয়।
তবে একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই আজিজ আহমেদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে কঠিন সময়ে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তার তিন ভাইয়ের যে হত্যা মামলার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সে হত্যা মামলার ইতিহাসটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হারিছ , আনিস ও জোসেফের কর্মকান্ড বিবেচনা করলে সেটি অপরাধ মনে হবে। কিন্তু ৭৫’ পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতায় যদি দেখা যায় তাহলে সেটি বীরত্ব, প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারা সেই সময় ৭৫ এর ঘৃণ্য আত্ম স্বীকৃত খুনীদের দল ফ্রিডম পার্টিকে প্রতিরোধের জন্য জীবন বাজী রেখেছিলেন । জোসেফ, হারিছ, আনিছের মতো অনেকেই সেদিন ৭৫’ এর ঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ৭৫’এর পর প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? রাষ্ট্রদ্রোহী না বীর দেশপ্রেমিক? আওরঙ্গ, লিয়াকত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। তারা কি সন্ত্রাসী? তাদের কৌশল ভুল হতে পারে, তাদের প্রতিবাদের ভাষা ভুল হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি ছিলো আদর্শিক লড়াই, অস্তিত্বের যুদ্ধ। আনিছ, হারিছ কিংবা জোসেফের মতো কিছু সাহসী তরুণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছিল। তারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে হত্যার সাহস পায়নি। আনিছ, হারিছ জোসেফরা সেই সময় যদি ফ্রিডম পার্টির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে না নিতেন তাহলে আত্মস্বীকৃত ৭৫’র খুনীরা বাংলাদেশ দখল করে নিতো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি মানুষও থাকতো না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। যে কথিত হত্যাকান্ড নিয়ে আজিজ আহমেদের তিন ভাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং দন্ডিত করা হয়েছিল, সেই হত্যাকান্ডের পুরো বিচার প্রক্রিয়া হয়েছিল বিএনপির আমলে। যারা ফ্রিডম পার্টি এবং ৭৫’ এর খুনীদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। ঐ বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে দেশে কর্ণেল তাহেরের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পঙ্গু অবস্থায় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয় সেই দেশে ফ্রিডম পার্টির সশস্ত্র ক্যাডারকে প্রতিরোধ করার জন্য কাউকে হত্যা মামলার আসামি করাটা অস্বাভাবিক নয়। যিনি নিহত হয়েছিলেন তিনি ছিলেন ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসী, বহু মানুষের হত্যা দায়ে অভিযুক্ত। হারিছ, আনিছ, আজিজরা সেই সময় যেটা করেছেন সেটি কতটা রাজনৈতিক, কতটা সন্ত্রাসী তার বিচারের ভার ইতিহাসের। কিন্তু সেই সময় ৭৫’ এর খুনীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা ছিলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর একারণেই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা এবং এসমস্ত মামলায় যারা দন্ডিত হয়েছেন তাদেরকে ছেড়ে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। আওয়ামী লীগ সাহসের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেছে। ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচার জন্য যদি কেউ সহিংস হয়ে উঠে তবে সেটি আত্মরক্ষা, অপরাধ নয়। কাজেই হারিছ, আনিস, জোসেফকে মুক্ত করার বিষয়টি কোন ভাবেই দুর্নীতির সাথে যুক্ত করা উচিত না। এটি একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। এটি অস্বীকার করার কোন কারণ নেই তার ভাইদের ত্যাগ এবং ৭৫’ পরবর্তী সময়ে তাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের কারণেই আজিজ আহমেদ সরকারের দৃষ্টিতে এসেছেন এবং তার পদোন্নতি ঘটেছে। এমনকি একারণেই হয়তো তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পেয়েছেন। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের বাস্তবতা। রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা এবং আনুগত্য অনেক গুলো স্পর্শকাতর নিয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়।
দ্বিতীয় বিষয় হলো আজিজ আহমেদ যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি কি করেছেন? তিনি কি দুর্নীতি করেছেন? তিনি কেনাকাটার ক্ষেত্রে তার ভাইদেরকে প্রাধান্য দিয়েছেন? তার ভাইদের পরিচয় পাল্টে দিয়ে তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়েছেন? তার ভাইয়েরা অনৈতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন আজিজ আহমেদের নাম ভাঙ্গিয়ে? এসমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মতো করে নির্মোহভাবে তদন্ত করেছে। আল জাজিরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উপস্থাপন করেছে। এই বিষয়ের সাথে সরকারের কোন সম্পৃক্ততা নেই। সরকার এই ব্যক্তির দুর্নীতির দায় কেন নিবে? এ ধরনের পদে থেকে দুর্নীতি করতে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে অন্য কারো সহযোগিতা লাগেনা। ব্যক্তি আজিজ যখন একটি পদে গেছেন তখন যদি তিনি কোন দুর্নীতি করে থাকেন, তিনি কোন অন্যায় করে থাকেন তার সব দায়-দায়িত্ব একমাত্র তারই। তার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের নয়। শুধু আজিজ আহমেদ কেন এখন সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের দুর্নীতির থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসছে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির বিশাল ফিরিস্তি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই দুর্নীতির অভিযোগ হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্ট বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন হাইকোর্টের নির্দেশে বেনজির আহমেদের দুর্নীতির অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। ইতোমধ্যে আদালতের মাধ্যমে বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের সব স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ পেয়েছে দুদক। এর ফলে দুর্নীতির ব্যাপারে যে সরকার নির্মোহ এবং প্রভাবমুক্ত সেটি আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। বেনজীর আহমেদকে পুলিশ প্রধান করাটা ছিলো সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু পুলিশ প্রধান হয়ে তিনি যদি কোন অন্যায় করে থাকেন, যদি কোন দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তবে সেটি তার অপরাধ। এর দায় সরকার নেবে কেন?
প্রধানমন্ত্রী টানা ১৫ বছর এবং মোট ২০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ২০ বছরে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে শত শত নিয়োগ দিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে কেউ ভালো কাজ করেছেন, কেউ খারাপ কাজ করেছেন। কেউ দুর্নীতি করেছে, কেউ সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, কেউ আবার ছিলেন অযোগ্য। যে যেই কাজ করেছেন তার পুরষ্কার বা তিরস্কার তিনিই পাবেন। আনিছ, হারিছ, জোসেফের দন্ড মওকুফ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাদের নাম পাল্টানো, পরিচয় গোপন করে ভোটার কার্ড বা পাসপোর্ট গ্রহণ ব্যক্তিগত অনিয়ম, অপরাধ। বাংলাদেশে ডা. সাবরিনার মতো অনেকেই এধরনের অপকর্ম করেছে। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা জালিয়াতি করে পাসপোর্ট করেছে, সংগ্রহ করেছে জাতীয় পরিচয় পত্র। এটি সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা। এসব অনিয়ম করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর লোক হওয়ার দরকার নেই। সত্যিকারের প্রধানমন্ত্রীর লোকরা এই সব অনিয়ম করে না। কোন নির্দিষ্ট দায়িত্ব পেয়ে যারা দুর্নীতি করছেন, যারা অনিয়ম করছেন এটি একেবারেই তাদের সিদ্ধান্ত, তাদের লোভ। এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হবে তাদেরকেই। আমরা জানি যে, বিভিন্ন জায়গায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন বা আছেন যারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। অন্তত সাধারণ মানুষ তাই মনে করে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না বলেও অভিযোগ আছে। এটি সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন সহ সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে। আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে সে অভিযোগগুলো দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন যাতে নিরপেক্ষ তদন্ত করে তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের আশে পাশে যেসমস্ত লোক ছিলেন বা আছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যেসমস্ত দুর্নীতির অভিযোগ আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় সেই অভিযোগগুলোর নির্মোহ তদন্ত দরকার। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী যে টানা ক্ষমতায় আছেন এবং তিনি যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তার অন্যতম কারণ তিনি দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেন না। তিনি নিজে দুর্নীতির সঙ্গে জড়ান না। তার কট্টর সমালোচকরাও তাকে দুর্নীতিবাজ বলতে পারবে না। আর এই বাস্তবতায় যারা বিভিন্ন দায়িত্ব পেয়ে বা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেই দুর্নীতি করেন তারা প্রধানমন্ত্রীর লোক হতে পারে না, তারা বিশ্বাসঘাতক। প্রধানমন্ত্রীর লোকরা দুর্নীতি করে এই ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর লোক তারাই যারা দায়িত্ববান, সৎ যারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে চান। প্রধানমন্ত্রীর লোক তারাই যারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে, সততার সাথে পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর লোক তারাই যারা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শ অনুসরণ করে। যারা দুর্নীতিবাজ, চাটুকার, লোভী, অর্থ পাচার করে, লুটেরা তারা কখনোই প্রধানমন্ত্রীর লোক না।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com