ইনসাইড থট

স্যাটেলাইট যুগে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 10/05/2018


Thumbnail

আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে মহাকাশে নিজেদের কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। আসছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসবে বাংলাদেশের নাম ইতিহাসে উঠবে মহাকাশে উপগ্রহ পাঠানো দেশ হিসেবে। সব ঠিক থাকলে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যাত্রা শুরু করবে।

প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। ফ্লোরিডার ক্যাপ ক্যানাভেরালে অবস্থিত স্পেস এক্সের লঞ্চ প্যাড থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হবে। এরই মধ্যে ফ্রান্সের থেলেস এলেনিয়া স্পেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান স্যাটেলাইটটির নির্মাণকাজ শেষ করেছে।

স্যাটেলাইটটি সঠিকভাবে মহাকাশে পাঠানো গেলে আট দিন পর এটি মহাকাশে বরাদ্দ পাওয়া ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাবে। সেখান থেকে নজরদারি চালাতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। পাওয়া যাবে উন্নত জিপিএস ব্যবস্থা, দুর্যোগ সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, গবেষণাসহ বিভিন্ন সুবিধা। সম্প্রচার সুবিধা। বাকি ২০টি বিদেশি বা প্রতিবেশী দেশের কাছে ভাড়া দিতে পারবে। উৎক্ষেপণের পর পরবর্তী ৩ বছর পর্যন্ত এর তদারকি করবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের গাজীপুরে প্রায় ১৩ একর জায়গার পাঁচ একরজুড়ে এই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে বিদেশি স্যাটেলাইট ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করছে।

স্যাটেলাইটের শরীর ধাতু সংকরের ফ্রেম দিয়ে তৈরি। একে বলে বাস। এতেই স্যাটেলাইটের সব যন্ত্রপাতি থাকে। প্রত্যেক স্যাটেলাইটে থাকে সোলার সেল এবং শক্তি জমা রাখার জন্য ব্যাটারি। এর পাওয়ার সিস্টেম প্রসেসকে পৃথিবী থেকে সবসময় মনিটর করা হয়। স্যাটেলাইটে একটি অনবোর্ড কম্পিউটার থাকে যা একে নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন সিস্টেমকে মনিটর করে। স্যাটেলাইটের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল এর রেডিও সিস্টেম ও অ্যান্টেনা।

প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক-পিএস রকেটের সাহায্যে স্পুটনিক-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হন।এরপর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাস্ট্র পাঠাতে সক্ষম হয় । এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও অধিক দেশ থেকে কয়েক হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে তবে পৃথিবীর মাত্র ১০ টি দেশ নিজস্ব প্রযুক্তিতে ও নিজস্ব উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশগুলি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৫৭), যুক্তরাষ্ট্র (১৯৫৮), ফ্রান্স(১৯৬৫), জাপান(১৯৭০),চীন(১৯৭০),যুক্তরাজ্য(১৯৭১),ভারত(১৯৮০), ইসরায়েল(১৯৮৮),ইউক্রেইন(১৯৯২) ও ইরান (২০০৯)।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি মূলত কম্যুনিকেশন বা তথ্যের দেয়া নেয়ার স্যাটেলাইটে। এই স্যাটেলাইটে একটি একটি অ্যান্টেনা সিস্টেম, একটি ট্রান্সমিটার তথা প্রেরক যন্ত্র, পাওয়ার সাপ্লাই ও রিসিভার তথা গ্রাহক যন্ত্র থাকে।এই সিস্টেমে আর্থ স্টেশন ট্রান্সমিটার থেকে মডুলেটেড মাইক্রোওয়েভ তথা সিগন্যাল+ উচ্চ কম্পাঙ্কের বহনকারী তরঙ্গ পাঠানো হয় স্যাটেলাইটে।স্যাটেলাইট সেই মডুলেটেড ওয়েভকে বিবর্ধিত করে পৃথিবীতে স্থাপিত গ্রাহক স্টেশনে পাঠিয়ে দেয়। এখন কোন স্যাটেলাইট যদি ৩৫,৭৮৬ কি.মি. উচ্চতায় স্থাপিত হয় তখন স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর সাথে সমবেগে আবর্তন করে অর্থাৎ স্যাটেলাইটটি এমনভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে যেন পৃথিবীর চারদিকে এক বার ঘুরতে তার ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে আর যেহেতু পৃথিবীরও নিজের চারদিকে একবার ঘুরতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে তাই পৃথিবীর সাপেক্ষে স্যাটেলাইটটিকে স্থির মনে হবে। তখন এই ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ভূ-স্থির উপগ্রহ আর এই কক্ষপথকে বলা হয় জিও স্টেশনারি অরবিট বা ভূ-স্থির কক্ষপথ। এই কক্ষপথ কম্যুনিকেশনের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী কিন্তু এই কক্ষপথেরও একটি অসুবিধা আছে তা হলো এই কক্ষপথে স্থাপিত একটি কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট সমগ্র পৃথিবীকে কভার করতে পারে না পৃথিবীর বক্রতার কারণে। সমগ্র পৃথিবীকে কভার করতে হলে এই কক্ষপথে তিনটি স্যাটেলাইট স্থাপন করতে হয়।যদি তিনটিই স্যাটেলাইট পরস্পর থেকে ১২০ ডিগ্রি কোণে জিও ষ্টেশনারি অরবিটে অবস্থান তাহলে একই সাথে সমগ্র পৃথিবীকে কভার করা সম্ভব।

অভিকর্ষজ বলের ফলে একটি বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুর্ণায়মান কোনো বস্তুই স্যাটেলাইট। এ হিসাবে চাঁদ পৃথিবীর প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট।গত শতক থেকে মানুষও নিজেদের সুবিধার জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে অনেক কৃত্রিম স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে।

রকেটের পাঠানোর সময় রকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয় ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম (আইজিএস) মেকানিজম। মহাকাশে পাঠানোর পর সেগুলো পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। স্যাটেলাইটের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ থাকে ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত উপগ্রহ-কেন্দ্রের।

স্যাটেলাইট সুবিধার জন্য মহাকাশ গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেলিযোগাযোগ, দিকনির্দেশনা ,মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস, জিপিএস, ম্যাপিং সিস্টেম, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা কাজে ব্যবহার করা যায়।


বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সুবিধাসমূহ

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে টিভি চ্যানেল আছে প্রায় পঁয়তাল্লিশটি।

ইন্টারনেট সেবা-দানকারী প্রতিষ্ঠান বা আই এস পি আছে কয়েকশ।

রেডিও স্টেশন আছে পনের টি এর উপরে। আরও আসছে।

তাছাড়া ভি-স্যাট সার্ভিস তো আছেই।

বিটিআরসির হিসাবে, প্রতিটি টিভি চ্যানেল স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ডলার দিয়ে থাকে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু করতে পারলে দেশে শুধু বৈদেশিক মুদ্রারই সাশ্রয় হবে না, সেই সাথে অব্যবহৃত অংশ নেপাল, ভুটান এর মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আয় করা যাবে। কারণ ৪০ টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে মাত্র ২০ টি ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। আর বাকি ২০ টি ভাড়া দেওয়া হবে।

১। মহাকাশ বা জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা
২। আবহাওয়ার পূর্বাভাস
৩। টিভি বা রেডিও চ্যানেল, ফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রযুক্তি
৪। নেভিগেশন বা জাহাজের ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনায়
৫। পরিদর্শন – পরিক্রমা (সামরিক ক্ষেত্রে শত্রুর অবস্থান জানার জন্য)
৬। দূর সংবেদনশীল
৭। মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে
৮। মহাশূন্য এক্সপ্লোরেশন
৯। ছবি তোলার কাজে (সরকারের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ)
১০। হারিকেন, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এর পূর্বাভাস
১১। আজকাল সন্ত্রাসীরা অনেক রিমোট এরিয়া তেও স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করছে।
১২। গ্লোবাল পজিশনিং বা জি পি এস
১৩। গামা রে বারস্ট ডিটেকশন করতে
১৪। পারমাণবিক বিস্ফোরণ এবং আসন্ন হামলা ছাড়াও স্থল সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য ইন্টিলিজেন্স সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা পেতে।
১৫। তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিভিন্ন খনির সনাক্তকরণ ইত্যাদি
১৬। ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করা
বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু-১ নামে একটি স্যাটেলাইট উপগ্রহ পাঠানোর কাজ অনেক আগেই শুরু করেছে। এর জন্য ৮৫ কোটি টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষজ্ঞ কোম্পানিকে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে।
এই মুহূর্তে বিশ্বের ৫৫ টি দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে। বাংলাদেশ সহ ২৪ টি দেশ নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠানোর চেষ্টা করছে। এখানে উল্লেখ্য যে ভারত ১৯৭৫ সালে Aryabhata নামের উপগ্রহ পাঠায়। আর পাকিস্তান ১৯৯০ সালে Badr-1 নামের উপগ্রহ পাঠায়। বর্তমানে এই দুইটি দেশের একাধিক উপগ্রহ আছে।
এমনকি ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, কলম্বিয়া, মউরিতাস, কাজাকাস্তান এর ও নিজস্ব উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট আছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ২০ টির ও বেশী দেশ আমাদের স্যাটেলাইট স্থাপনের সম্ভাব্য অবস্থান(মহাকাশে নির্ধারিত স্থান) নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক


বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭