ইনসাইড থট

বাজেট প্রস্তাবে পরিবেশ কতটা গুরুত্ব পেয়েছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/06/2018


Thumbnail

পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নীতি-কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ০৭ জুন বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাজেট পর্যালোচনায় এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নদ-নদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, দারিদ্র, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ু দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, মাএাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভ’গর্ভস্থ পানির অত্যাধিক উত্তোলনে বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানি ক্রমাগত বৃদ্ধি, এবছর চৈত্র মাসে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিপাত, গত বছর হাওরে অকাল বন্যা ও চট্রগ্রাম অঞ্চলে অতি বৃষ্টির কারণে চট্রগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় ব্যাপক পাহাড় ধস ও প্রাণহানি এবং বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার আমুল পরিবর্তন এর চাক্ষুস প্রমাণ।

বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরিসংখ্যান মতে জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং ক্রয় ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ৩২তম।চৎরপবডধঃবৎযড়ঁংবঈড়ড়ঢ়বৎং-এর প্রক্ষেপণ মতে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ২৮তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ অর্জন ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে হবে। আর এসব উন্নয়ন হতে হবে টেকসই ও স্থায়িত্বশীল। এ লক্ষ্যে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

২০২১ সাল নাগাদ রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৬০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সারা দেশের বিশেষ করে ঢাকা ও ঢাকার আশে পাশের জেলার সাথে স্বল্পতম সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপন অপরিহার্য। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহসড়ক ৬ বা ৮ লেনে উন্নীত করেও শুধুমাত্র সড়কপথে পণ্য পরিবহন করে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন রেলপথকে কমপক্ষে ৪ লেনে উন্নীত করা। যার মধ্যে দুটি লেন যাত্রী পরিবহণ করবে আর দুটি লেন শুধুমাত্র পণ্য পরিবহন করবে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দুরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে কুমিল্লা বা লাকসাম হয়ে চট্রগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হলে দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার কমে ২৩০ কিলোমিটারে দাড়াবে। এতে সময় অনেক কম লাগবে, অর্থ সাশ্রয় হবে, দূষণ কমবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে রেল মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এ বিষয়ে নির্দেশ দিলেও বাস্তব অগ্রগতি নেই বললেই চলে। ঢাকা থেকে কুমিল্লা বা লাকসাম হয়ে চট্রগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে জরুরীভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্জ্য পরিশোধানাগার নির্মাণ, তরল বর্জ্য রিসাইক্লিং এবং জিরো ডিসচার্জ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও শিল্পকারখানায় এগুলোর বাস্তবায়ন নেই। তরল বর্জ্য রিসাইক্লিং এবং জিরো ডিসচার্জ উৎসাহিত করার জন্য শিল্পকারখানাকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করা। এতে দূষণ হ্রাস পাবে এবং শিল্পকারখানায় পানি ব্যবহারের পরিমাণ কমে যাবে যা বৃহৎ পরিসরে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু, কর্ণফুলী, হালদা নদী দখল-ভরাট-দূষণে আজ মৃতপ্রায়। এ নদীগুলোর দখল-ভরাট-দূষণ নিয়ন্ত্রণে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাসহ পর্যাপ্ত বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে।

ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমিয়ে আনার কথা বলা হলেও গৃহীত পদক্ষেপে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন বাস্তবতা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ঢাকা মহানগরীতে ১৮৪টি গভীর নলক’প বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্তমানে রাজধানীতে ৭৮০টি গভীর নলক’প রয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুটের বেশি করে করে নিচে নেমে যাচ্ছে। পবার তথ্য মতে এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকা শহর পানির অভাবে বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়বে। নতুন করে ১৮৪টি গভীর নলক’প বসানো হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও দ্রুত নিচে নেমে যাবে এবং ঢাকায় পানির হাহাকার ২০৩৫ সালের অনেক আগেই শুরু হবে। ঢাকা মহানগরীতে আর কোনো গভীর নলকূপ স্থাপন না করে পানির সমস্যা সমাধানে ঢাকার আশপাশের নদীগুলো দূষণমুক্ত করা ও সেগুলোর পানি ব্যবহার উপযোগী করে তোলার উদ্যোগ নেয়া উচিত।

প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমেই সবার জন্য সর্বত্র সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। শুধুমাত্র প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে এলক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য, সুস্থ পরিবেশ, দূষণমুক্ত পানি ও বায়ু, মাদক ও তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, মাঠ, পার্ক, জলাধার, হাঁটার পথ ব্যবহার উপযোগীতার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল ও ডায়গোনস্টিক সেন্টার স্থাপন, চিকিৎসক, সেবিকা, প্যারামেডিক্স ও অন্য সহযোগী নিয়োগ, তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসম্মত দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। এছাড়াও জনগণকে সচেতন করতে হবে।

২০০৯ সালে নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠিত হয়। এ ফান্ডে ২০০৯-১০ ,২০১০-১১ ও ২০১২-১৩ অর্থছরে প্রতি বছর ৭০০ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৪০০ কোটি টাকা , ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থছরে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা, পরবর্তী প্রতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, যত্রতত্র অপ্রয়োজনে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে অভিযোগ ওঠায় অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এ ফান্ডে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া কোনোভাবেই যুক্তি সংগত নয়। যাদের ব্যর্থতায় ফান্ড যথাযথভাবে ব্যবহার হয়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং এফান্ডে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।

পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি ও পরিবেশ সুরক্ষার স্বার্থে পলিথিনের ব্যবহার কমানোর জন্য সকল ধরনের পলিথিন, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর উপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগে সম্পূরক শুল্কের প্রস্তাব করার মাধ্যমে নিষিদ্ধ পণ্যকে বৈধতা প্রদান এবং উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, ব্যবহার উৎসাহিত করার সামিল। নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগে সম্পূরক শুল্কের প্রস্তাব প্রত্যাহার করা।

তামাক একটি কৃষিপণ্য হলেও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিধায় তামাকের উৎপাদনকে সরকার সব সময় নিরুৎসাহিত করে আসছে। তবে তামাক প্রক্রিয়াজাতপূর্বক রপ্তানি উৎসাহিত করতে তামাকজাত পণ্যের উপর আরোপিত ২৫% রপ্তানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে করে তামাক চাষে উৎসাহ দেয়া হবে। কৃষি জমিতে তামাক চাষ হয় বিধায় খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। তামাক চাষ কমলে আবাদযোগ্য জমিও রক্ষা পাবে। প্রক্রিয়াজাতপূর্বক রপ্তানির ক্ষেত্রে তামাকজাত পণ্যের উপর আরোপিত ২৫% রপ্তানি শুল্ক বহাল রাখা।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ১১১৯ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বরাদ্দ ৮৯১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১২৬৯ কোটি টাকা। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তরসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য সংস্থার সম্মিলিত বরাদ্দ ১২৬৯ কোটি টাকা। পরিবেশ ব্যবস্থাপনা-জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এ বরাদ্দ অপ্রতুল। পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের উপর ন্যস্ত। অধিদপ্তরের বিভাগীয়সহ ২১টি জেলায় অফিস রযেছে এবং ৪৩ জেলায় অফিস নেই। এছাড়াও পরিবেশ ব্যবস্থাপনাসহ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণাগারের গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রয়েছে। বিভাগীয়সহ ২১টি জেলা অফিসে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাবে বর্জ্যরেসহ নদ-নদীর পানির গুণাগুণ পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও রয়েছে জনবলের অভাব। ৪৩ জেলায় অধিদপ্তরের অফিস স্থাপন, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ এবং প্রতিটি অফিসে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত গবেষণাগার স্থাপনের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান এবং কর পুনর্বিন্যাস করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পবা এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর
বাংলা ইনসাইডার/এসএইচটি/জেডএ

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭