ইনসাইড থট

ভারতের সঙ্গে বিএনপির লেনাদেনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/06/2018


Thumbnail

ভারত সরকারের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য বিএনপি মরিয়া। আসলে এই আনুকূল্য মানে ক্ষমতার মসনদে বসতে ভারতের সহযোগিতার প্রত্যাশা বিএনপির। তারা নাকি খুব আশাবাদী, নাকি ঢং করছে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে। কেউ কেউ বলছেন বিএনপি নেতারা খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে এই ভেবে যে, ভারত তাঁদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন। দাতাদের সহায়তা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম একটা প্রধান উপাদান, কিন্তু একমাত্র নয়। তবুও ভারতে সঙ্গে বিএনপি তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য ভুল স্বীকার করে নতুন সম্পর্ক গড়তে চায়, ভারতকে অনেক কিছু দিতে চায়, সেই অঙ্গীকার করে এসেছে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর দল। অপরদিকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন  তা অনেকটা এমন যে, আমি যা দিয়েছি তার প্রতিদান কী ভারত দিতে পারবে! তাহলে একবার একটু পেছনে ফিরে দেখে নিই বিএনপি কী করেছে আর আওয়ামী লীগ কী করেছে ভারতের জন্য।      

উন্নয়নের অন্যতম প্রধান বাঁধা হচ্ছে  কোনো দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। যার ফলে সরকার বিরোধীদের ডাকা হরতাল, বন্ধ, অবরোধ, কর্মবিরতি, ইত্যাদি।  ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, ভারতের ৬০৪ টি জেলার মধ্যে ১৬০ টি জেলায় নকশাল আন্দোলনের ফলে ভারত সরকার উন্নয়নে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। তবে ইদানীং বিভিন্ন প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে লাগাম টেনে ধরা গেছে, নকশাল নামের সন্ত্রাসী আন্দোলনেও ভাটা পড়ানো গেছে।  কে বা কারা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ দিয়েছে  আর কে বা কারা ভারতের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে ভারতকে সহায়তা করেছে তার হিসাব করা যায়।  এ থেকে ভারত বুঝে নিয়েছে কে তার দেশের সার্বিক উন্নয়নের মিত্র আর কে তার শত্রু।  এটা বিশ্লেষণের আগে ভারতের বর্তমান অবস্থার দিকে একটু আলোকপাত করে নিই।

ভারত সরকারের মতে, তাঁদের দেশে এখনো অনেকগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলমান। কাশ্মীর থেকে স্বাধীনতার দাবী করা হচ্ছে। তাঁদের সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান ছাড়াও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ। অস্ত্র আর টাকার যোগান যে পাকিস্তান থেকে আসে তা প্রায় নিশ্চিত। আন্দোলন হচ্ছে আসামে, একদল হচ্ছে উলফা বা United Liberation Front of Assam (ULFA)। অন্যটি হচ্ছে  মাল্টা নামে Muslim United Liberation Tigers of Assam (MULTA)। তারা উভয়েই চায় স্বাধীন ভূখণ্ড। এর বাইরেও এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আছে যারা নিরন্তর নানান ঝামেলায় ফেলছে ভারত সরকারকে।  এছাড়া নাগাল্যান্ড ছিল নাগা বিদ্রোহ, যদিও তা সাম্প্রতিক কালে এক চুক্তির বলে অবদমিত হয়ে আছে। যেমনটি আছে আমাদের দেশে শান্তি চুক্তির পরে চাকমা বিদ্রোহীদের অবস্থা।  

আমাদের অনেকের মনে থাকার কথা যে, ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। অভিযোগ আছে যে, অনুপ চেটিয়ার অর্থাৎ উলফার টাকায় তার চাচাতো বোনের স্বামী বাংলাদেশের বিরাট শিল্পপতি বনে গেছেন, মালিক হয়েছেন একাধিক মিডিয়ার। দেশের একটা নামকরা দৈনিকের খবরে বলা হয়েছিল যে, এই বেঈমানীর জন্য তাঁর প্রাণ প্রিয় নিরপরাধ কন্যাকে প্রাণ দিতে হয়। যা, হোক অবশেষে ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফলে আসাম প্রশ্নে ভারত কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সময় পায়।   

যাক, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের যে কথা বলছিলাম সেটাতেই আবার ফিরে আসি। কাশ্মীর, আসাম, নাগাল্যান্ডের বাইরেও শিখরা একসময় করতো স্বাধীন খালিস্তানী আন্দোলন, যা পরিচালিত হতো কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে। এটি এখন মৃত পর্যায় তবুও শেষ হয়ে যায় নি, এখনো মিটি মিটি জ্বলে। পাশের রাষ্ট্রের মদদেই যে, এটা হতো তা ভারত সরকারের জানা।  

এনএলএফটি বা National Liberation Front of Tripura (NLFT) ত্রিপুরা রাজ্যের স্বাধীনতা চায়, আন্দোলন চলমান। কিন্তু পর্যাপ্ত জনসমর্থনের অভাবে এটি তেমন আলোচিত না।      

আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপারেই হচ্ছে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ। পাশে পাকিস্তানের ও চীনের বন্ধু রাষ্ট্র মিয়ানমার বা আমরা যাকে আগে বলতাম বার্মা।ভারতের মিজোরাম প্রদেশ ছিল খুব অশান্ত, স্বাধীনতার আন্দোলন করতো তারা। দলের নাম ছিল National Liberation Front of Tripura (NLFT) তাঁদের নেতা ছিলেন লালডেঙ্গা। এরা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মিজোরামকে ভারত থেকে আলাদা করে তাঁদের ভাষায়, স্বাধীন করতে চায়। তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে এদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এক পর্যায়ে লালডেঙ্গার ভারত সরকারের সাথে আপোষ রফা হলে তিনি শান্ত হন এবং ১৯৯০ সালে তিনি ৫৩ বছর বয়সে লন্ডনে মারা যান। এই NLFT এখন একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু জানলে অবাক হনে যে, NLFT’র হেটকোয়াটার্স এর ঠিকানা হচ্ছে  সাজাক, খাগড়াছড়ি, বাংলাদেশ। দাবি করা হয় যে, প্রায় ৬৫ জন সন্ত্রাসী কিছু কুড়ে ঘরে লুকিয়ে থাকে, এছাড়া ১০-১২ জন মিজো সন্ত্রাসী থাকে খাগড়াছড়ির বোয়ালছড়িতে।  এগুলোর পরিচালনা আর টাকার যোগান হয় ভারত বিরোধী রাষ্ট্রের টাকায়, বাংলাদেশে থাকা তাঁদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাধ্যমে।    

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে মিজোরামের  সন্ত্রাসীদের টাকার যোগানে বিরাট বাঁধা পড়ে। ফলে তাঁদের অধিকাংশই দেশে চলে যেতে বাধ্য হন। তাঁদের বরাট অংশ সরকারের সাথে সমঝোতায় বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে ভারতে মিজোরামের অভ্যন্তরে পালিয়ে থাকা চাকমা বিদ্রোহীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করে দেয় ভারত। এর ফলে চাকমা বিদ্রোহীদের সশস্ত্র আন্দোলন চরম প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে। টাকা, অস্ত্রের যোগান বন্ধ  প্রায় হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের প্রতিনিধির নামে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।      

বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রে জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরের কাছে নকশালবাড়ির একটি গ্রামে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন দুটি শিশু-সহ মোট ১১ জন লোক। সেখান থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র একাংশ তাদের নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) একটি পৃথক উগ্র বামপন্থী দল গঠন করেন। এ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায় চৌধুরী, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতাল। এ বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ২৫ মে তারিখে। তখন নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের উপর স্থানীয় ভূস্বামীরা ভাড়াটে গুন্ডার সাহায্যে অত্যাচার করছিল। এরপর এই কৃষকরা ঐ ভূস্বামীদের সেখান থেকে উৎখাত করে। চারু মজুমদার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুং এর অনুসারী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ভারতের কৃষক এবং গরিব মানুষদের মাও সে তুং এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে শ্রেণিশত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা প্রয়োজন।

১৯৭০ সালের দিকে এ আন্দোলন অর্ন্তদ্বন্দ্বের কারণে কয়েকটি বিরোধী অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আলীপুর জেলে নিহত হন। তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি, সম্ভবত তাঁকে হত্যা করা হয়। পলিটব্যুরোর অন্যতম নেতা সুশীতল রায় চৌধুরী আত্মগোপন থাকা অবস্থায় মারা যান। প্রধান নেতৃবর্গের বড় অংশই জেল বন্দী হন। পরে নকশালপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) বহু ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে যায়।

উইকিপিডিয়া সুত্রে জানা যায় যে, ১৯৮০ সালের দিকে প্রায় ৩০ টি নকশালবাদী দল সক্রিয় ছিল এবং তাদের জনবল ছিল প্রায় ৩০,০০০। ২০০৪ সাল ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে প্রায় ৯৩০০ নকশালবাদী ক্যাডার সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের কাছে প্রায় ৬৫০০ অনিবন্ধিত অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে, এছাড়া দেশী অস্ত্র তো আছেই। Judith Vidal-Hall (২০০৬) এর মতে সাম্প্রতিক সময়ে নকশালদের সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০ এবং তারা ভারতের বনভূমির প্রায় এক পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।তারা তাদের কর্মকান্ড ভারতের ভারতের ৬০৪ টি জেলার ভেতর ১৬০ টিতে বিস্তার করেছে।

চারু মজুমদারের দল নামে খ্যাত নকশালদের শেল্টার দেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ থেকে চীনপন্থী এসব সন্ত্রাসীদের সার্বিক সহযোগিতা করা হতো। টাকা পয়সা,আশ্রয়, ইত্যাদি দিয়ে অথবা অন্য কোন দেশের মাধ্যম হয়ে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা দিয়ে নকশালদের কম করে হলে ৮টা ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৯৭ সালের দিকে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে। যাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত ছিল। এসব ঘাটির মালিক ছিল ভারতের নকশালরা। যাতে অর্থ অন্যান্য সব কিছু যোগানদাতা ছিল পাকিস্তান। এতে চীনের পরক্ষ সমর্থন যে ছিল তাতে কোনই সন্দেহ নেই, কারণ এসব গ্রুপরাই চীনা পন্থী। এর একটি ঘাঁটি ছিল চুয়াডাঙ্গায়। ১৯৯৭ সালের দিকে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এসব ঘাঁটি বন্ধ হয়ে যায়।

এত কিছুর পরও ভারতের সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতায় যাবার ক্ষেত্রে বিএনপি’র সতর্ক আশাবাদ, লন্ডনে তারেক রহমানের সাথে ফখরুল সাহেবের সফল বৈঠক,ফিরে আসার পরে মুখে কূলুপ এঁটে থাকা, কয়েকদিন আগে মুন্সীগঞ্জে প্রগতিশীল কবি, প্রকাশককে হত্যা, শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভিনের ছেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের স্বাক্ষী এবং পেশায় একজন ব্যাংকার সুমন জাহিদের ধড় মাথা আলাদা করা লাশ উদ্ধার, সব হিসেবে জট পাকায়। আন্দোলনের নামে কী হতে যাচ্ছে ঈদের পরে! কী আছে ভারতের সঙ্গে বিএনপি’র লেনা দেনার খেরো খাতায়?       

লেখক: কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

e-mail: arefinbhai59@gmail.com

তথ্যঋণঃ বিবিসি, উইকিপিডিয়া, অন্যান্য



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭