ইনসাইড থট

বিরামহীন বেপরোয়া গাড়ি চালনায় ঈদযাত্রায় ঝরছে প্রাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/06/2018


Thumbnail

পরিবার-পরিজন, মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগটা কেউই হাতছাড়া করতে চান না। তাই ঈদে ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে মানুষ নিজের শিকড়ে ছুটে যান। কিন্তু ঈদকে কেন্দ্র করে মাত্র কয়েকটা দিন উপভোগ করতে যাওয়া মানুষের অনেকেরই আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয় যাতায়াতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির কারণে।

এবারও ঈদের দিন থেকে তিন দিনে দেশের ৩২টি জেলায় ৫৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৩ জন প্রাণ হারিয়েছে আহত হয়েছে ১১২ জন। গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। এর মধ্যে নীলফামারীর সৈয়দপুরে একটি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। মাগুরায় ৪ জন, টাঙ্গাইলে ৫ জন, নেত্রকোনায় ২ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন, নওগাঁয় ৩ জন, ঝিনাইদহে ৩ জন, বগুড়ায় ২ জন, ঠাকুরগাঁয়ে ৪ জন, শেরপুরে ১ জন, নরসিংদীতে ১ জন, জয়পুরহাটে ১ জন, কিশোরগঞ্জে ১ জন, ঢাকার সাভারে ১ জন, কক্সবাজারে ১ জন, বরিশালে ১ জন, মানিকগঞ্জে ২ জন, ফেনীতে ৩ জন, রংপুরে ৩ জন, চট্রগ্রামে ৮ জন, চুয়াডাঙ্গায় ২ জন, নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে ৫ জন, সিলেটে ২ জন, নাটোরে ২ জন, কুমিল্লায় ৩ জন, পাবনায় ১ জন, ভোলায় ১ জন, ময়মনসিংহে ৪ জন, ফরিদপুরে ২ জন, জামালপুরে ১ জন, হবিগঞ্জে ১ জন, লক্ষীপুরে ১ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহতদের অনেককেই পঙ্গুত্ব বরণ করে পরিবারের বোঝা হয়ে জীবনযাপন করতে হবে।



তিন দিনে সংঘঠিত ৫৩টি দুর্ঘটনার ১৮টি বাসসৃষ্ট যা মোট দুর্ঘটনার ৩৪ শতাংশ, ১৩টি মোটরসাইকেলসৃষ্ট যা মোট দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশ, বাকি দুর্ঘটনাগুলো অটোরিক্সা, কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ট্রাক, ইজিবাইক, ভটভটিসৃষ্ট। মৃত্যুবরণকারি ৮৩ জনের মধ্যে ২৬ জন মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী যা মোট মৃত্যুবরণকারীর ৩১ শতাংশ। এ বছর প্রাণহানির সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ মোটরসাইকেলসৃষ্ট দুর্ঘটনা এবং মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের ব্যাপকহারে মৃত্যুবরণ।

প্রতিবছর ঈদ উপলক্ষ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সড়কপথে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানিসহ ঘরমুখো মানুষকে রাস্তায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এবং দুর্ঘটনা হ্রাসে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারপরও সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। এতে জনসাধারণ খুবই উদ্বিগ্ন।

কয়েক বছর ধরে ঈদের আগে-পরে তিন দিন করে মোট সাত দিন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ঈদযাত্রায় ট্রাকসৃষ্ট দুর্ঘটনা কমে গেলেও সার্বিক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি বেড়েই চলেছে।

পবার এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঈদের আগের চেয়ে পরে বিশেষ করে ঈদের দিনসহ দুই-তিন দিন দুর্ঘটনা বেশি হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বিরামহীন বাস চালানোর ক্লান্তি, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, সড়কে যানবাহনের চাপ কম ও রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালানো, মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার ছোট যানের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া।

ত্রুটিপূর্ণ সড়ক অবকাঠামো, সড়ক অব্যবস্থাপনা, চলাচলের অনুপযোগী যানবাহন, উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালকের অভাব, অদক্ষ, লাইসেন্সবিহীন ও মাদকাশক্ত চালক, বেপরোয়া ও অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালনা, ওভারটেকিং, অতিরিক্ত লোড বহন, গতিসীমা না মানা, সড়কে প্রদত্ত সংকেত অনুসরণ না করা, যানবাহন যথাযথভাবে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, মালিক ও চালকের অতি মুনাফার লোভ, দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তির আওতায় না আনা, আইন যুগোপযোগী না করা, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে ব্যর্থতা, মালিক, চালক, বিআরটিএ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, সর্বস্তরে সচেতনতার অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তঃ বেড়ে চলেছে।

অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। নিরাপদে, যুক্তিসঙ্গত খরচে, নির্দ্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা জনগণের কাম্য। এ অঞ্চলে নদীপথই ছিল যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ব্রিটিশ শাসনামলে রেলওয়ের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে যে সড়কপথ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা একশত বছর আগে কল্পনাও করা যেত না।

নিরাপদ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রেল ও নৌপথের গুরুত্ব অপরিহার্য। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নৌ পথ ও রেল পথের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা সড়ককেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অতিরিক্তি সড়ক নির্ভরতার কারণে দুর্ঘটনা, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, জ্বালানি ব্যয়, যাতায়াত খরচ, যানজট ও যানজটজনিত সময়ের অপচয়সহ নানারকম সমস্যা বেড়ে চলেছে। দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, স্ট্রোক, বধিরতাসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে। জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে।

ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নের ফলে সারাদেশ থেকে মানুষ প্রতিদিন ঢাকার দিকে ছুটছে। কেউবা ঢাকায় অবস্থান করার জন্য কেউবা সংক্ষিপ্ত সময়ের কাজে আসছেন। উৎসবের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আসা-যাওয়া করে। এই চাপ সামলানো অসম্ভব এবং অযৌক্তিকও বটে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যাতায়াতের এই চাহিদা অনেকাংশেই হ্রাস করা সম্ভব। এজন্য বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা শহর, পৌর এলাকায় মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এমনকি গ্রাম পর্যায়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে নিকটবর্তী স্থানে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোর সুযোগ পায়।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়ঃ

মোটরসাইকেলসৃষ্ট দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং প্রাণহানি হ্রাসে বিদ্যমান আইন কোনো রকম শিথিলতা ছাড়াই কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। অন্যথায় মোটরসাইকেলসৃষ্ট দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি খুব শীঘ্রই ব্যাপক আকার ধারণ এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে।

সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মালিক, চালক, সরকারি সংস্থা ও জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরীভিত্তিতে গ্রহণ করা।

অনিরাপদ যানবাহন চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ ও গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা।

যানবাহনের গতিসীমা, ওভারটেকিং, ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ করা।

চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং এ লক্ষ্যে আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা।

ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে সততার সাথে আইনানুগ বিধি বিধান অনুসরণ করা।

মালিক, চালক, বিআরটিএ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর-এর জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা।

সড়ক নিয়মিত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।

দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা।

ঢাকার উপর চাপ কমাতে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ।


লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পবা এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর
বাংলা ইনসাইডার/এসএইচটি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭