ইনসাইড থট

নির্বাচনী রাজনীতি এবং একজন শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 09/07/2018


Thumbnail

গাজীপুর সিটির নির্বাচনের পর সকলের চোখ এখন রাজশাহী, সিলেট আর বরিশালে। আগামী ৩০ জুলাই এ তিন সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণের পরই শুরু হয়ে যাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল। সব ঠিক থাকলে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে নানামুখি জল্পনা-কল্পনা এবং হিসাব-নিকাশ। রাজনৈতিক দলগুলো ঘর গোছানোর চেষ্টা করছে। ছোট দলগুলো বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সংসদে যাওয়ার কৌশল খুঁজছে।

নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে জোট-মহাজোটের রাজনীতিতেও। বিএনপির নেতৃত্বে ২০- দলীয় জোট থাকবে, না ভাঙবে সে আলোচনা যেমন আছে, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের কলেবর বাড়া বা কমার বিষয়েও আলোচনা আছে। নামসর্বস্ব দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য ঘুর ঘুর করছে । উপায় খুঁজছে আগামী নির্বাচনে কিভাবে অংশ নেওয়া যায়, কীভাবে থাকা যায় আগামী সরকারে। তিন সিটি নির্বাচন শেষ হলেই দেশে নির্বাচনী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগবে।

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি গত তিন দশক ধরেই আটকে গেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি – এই দুই দলের মধ্যে। হয় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে নতুবা বিএনপি। ১৯৯১ সালের নির্বাচন থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই ধারাই চলছিল। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড আওয়ামী লীগ তৈরি করল ২০১৪ সালে। যদিও বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে ক্ষমতায় বসে সরকার মেয়াদ পূরণ করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল তথাকথিত গণতান্ত্রিক দুনিয়া এটা ভালো ভাবে নেবে না, সরকারের ওপর নানা ধরনের চাপ থাকবে। তাই তাদের পক্ষে মেয়াদ পূর্ণ করা সম্ভব হবে না।

যারা সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন তারা এখন সরকারের মেয়াদ শেষে এসে বলছেন, আগের বার যেটা সম্ভব হয়েছে, এবার সেটা হবে না। আগামী নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক না হয় তাহলে দেশ বড়ো ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না।

তবে এ নিয়ে ভিন্নমত ও আছে। অনেকেই মনে করেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলেও দেশে মারাত্মক কোনো সংকট তৈরি হবে। তবে নির্বাচন অবশ্যই বিতর্কমুক্ত হওয়া ভালো।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সকলেই চায়। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে এয নির্বাচনটি হতে হবে অংশগ্রহনমূলক। একই সাথে সকলেই চায়, তার পছন্দের দলটি যেন নির্বাচনে জেতে । আমরা কেউ নিজেদের পরাজিতের দলে দেখতে চাই না। অথচ জয়-পরাজয় গণতন্ত্রের স্বাভাবিক রীতি।

তাছাড়া আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান এতোটাই বিপরীতমুখি যে এখানে একমত হওয়ার রাজনীতি আদৌ সম্ভব হবে কি না বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জনসমর্থন বা জনপ্রিয়তা যতোদিন কাছাকাছি থাকবে, ততোদিন অন্তত দেশের রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের ধারাও অব্যাহত থাকবে। দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আর একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠলে ভালো হতো। কিন্তু তেমন সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত বাস্তবে দৃশ্যমান নয়।

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমন জয়লাভের ব্যাপারে আশাবাদী, তেমনি বিএনপিও মনে করে জয় তাদের হাতের মুঠোয়। দেশের আইন-আদালতের প্রতি বিএনপির আস্থা কম। বিশেষ করে দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শাস্তি এবং জেলে যাওয়ার পর থেকে আদালতবিরোধী মনোভাব বিএনপির মধ্যে আরও প্রবল হয়েছে। একদিকে তারা আদালতের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করছেন, অন্যদিকে দেশের আদলতকে ক্রমাগত সরকারের আজ্ঞাবহ বলে প্রচার করছেন। এই প্রচারণার পরিণতির কথা বিএনপির নেতারা একবারও ভাবছেন না। দেশের মানুষকে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল করে তোলা কি খুব ভালো ব্যাপার? বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার দল। অর্থাৎ দুদিন আগে হোক আর দুদিন পরে হোক এই দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আজ বিরোধী দলে থেকে এমন কিছু বলা বা করা উচিত নয়, যা তারা ক্ষমতায় গেলে বুমেরাং হয়ে তাদেরই ঘায়েল করতে পারে।

আওয়ামী লীগ টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব আছে। বিএনপি এটাকে পুঁজি করেই রাজনীতিতে বাজি মাত করতে চাচ্ছে। বিএনপি ইতিবাচক ধারায় রাজনীতি করছে না। সর্বত্রই তারা বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা দেখছে। বিএনপির আশা আওয়ামী লীগের নেগেটিভ ভোটে জিতে যাবে বিএনপি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে বাংলাদেশ যে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, মানবউন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে যে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে, সেসব বিএনপি দেখতে চায় না, স্বীকার করতে চায় না।

মানুষ বিরোধিতা পছন্দ করে, নেতিবাচক কথাবার্তা মানুষকে বেশি করে আকর্ষণ করে। তবে পরিবর্তনের সুফল যেহেতু মানুষ যতোটুকুই হোক পাচ্ছে, সেজন্য সরকারবিরোধী আন্দোলনেও মানুষ নামছে না।

আমাদের দেশের বড়ো সমস্যা হলো দুর্নীতি ও পুঁজি- লুন্ঠন বা সম্পদ পাচার। আজ যারা প্রচার করছেন তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুন্ঠন প্রক্রিয়া বন্ধ হবে? বিএনপি শাসনের রেকর্ড এতো বছরে হয়তো মানুষের মন থেকে একটু বিবর্ণ হয়েছে। কিন্তু একেবারে কি মুছে গেছে?

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মানুষ সরকারের জুলুম-অবিচারের বিরুদ্ধে ভোট দেবে। মানুষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের হারিয়ে বিএনপির প্রার্থীদের জিতিয়ে দিল। তাহলে কি জুলুম-অবিচার বন্ধ হবে? গত নির্বাচনেও তো কয়েকটি সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাতে কি লাভ হয়েছে? সরকার বদল হয়েছে, নাকি নগরবাসী উন্নয়নবঞ্চিত হয়েছেন?

রাজনৈতিক দলের উচিত সাধারণ মানুষের সামনে এমন বক্তব্য তুলে ধরা যাতে তারা রাজনৈতিকভাবে আরো অধিক সচেতন হয়ে উঠতে পারে। ভুলবার্তা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভোটে জেতার রাজনীতি যে একটি দলের প্রকৃত জনপ্রিয়তার প্রমাণ নয় – সেটা আমরা অতীতে একাধিকবার দেখেছি।

নির্বাচনই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা মাপার উপায়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো অবস্থায় এই পরীক্ষায় অংশ নিতে চায়। আর এখানেই বিরোধ, এখানেই বিতর্ক। এই বিরোধ-বিতর্কের আশু অবসান আশা করা যায় না।

আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। যারা ক্ষমতায় থাকে এবং যারা ক্ষমতার বাইরে থাকে তাদের স্বার্থ একবিন্দুতে মেলানোর চেষ্টা সহজ নয়।

সবদিক বিবেচনাতেই আওয়ামী লীগই আছে সুবিধাজনক অবস্থানে। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে বিএনপি আছে ব্যাকফুটে। দলের প্রধান খালেদা জিয়া জেলে। তিনি জামিনে বের হয়ে আসতে পারলেও শারীরিক কারণেই আগামী নির্বাচনে সারাদেশে ছুটে বেড়িয়ে বিএনপির পক্ষে ভোট সংগ্রহ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমান দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকতে তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম।

সব বিবেচনায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান নড়বড়ে ভাবার কারণ দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতা-মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বাড়াবাড়ি এবং প্রচন্ড দলাদলি হলো আওয়ামী লীগের বড়ো সমস্যা। আবার তার বিপরীতে আছে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আকাশচুম্বী ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। তার সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো সংশয় নেই। আগামী নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন তাহলে ভোটের বাক্সে নিঃসন্দেহে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যা ঠেকানো খুবই কঠিন হতে পারে বিএনপির জন্য।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭