ইনসাইড থট

জীবন নিয়ে বাণিজ্য!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/07/2018


Thumbnail

বাঁচতে হলে খেতে হয়, শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে, তা না হলে জীবনের প্রতি পরতে পরতে থাকে ঝুঁকি যা অনেক সময় মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন একটা সাংঘাতিক খবর পাওয়া গেছে সম্প্রতি। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিটিউটের বরাত দিয়ে একটা খবরে বলা হয়েছে যে, বাজারে বিক্রি হওয়া শিশু খাদ্যের শতকরা ৮০ভাগে ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে যা ফলে ইদানিং আবার শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। এক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে যে, প্রতি ১৯ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু মারা যায় সম্পুরক শিশু খাদ্যে উচ্চ মাত্রার ভেজাল থাকা আর অপুষ্টিজনিত কারণে। শিশুদের মাঝে ডায়রিয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে সম্পুরক শিশু খাদ্যে উচ্চ মাত্রার ভেজাল থাকার কারণে। জরিপে বলা হয় যে, ২০০৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে মারা গেছে ৩ হাজার ৮৫০ জন যার অধিকাংশই শিশু, আর তারা বিরাট অংশই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল।                            

শিশুদের নিয়ে আমার আনুষ্ঠানিক কাজটা শুরু ১৯৮৪ থেকেই। শিশুদের নিয়ে কাজ করতে করতে শিশুদের নানা সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আমার আগ্রহ জন্মায়। আমি সন্তানের বাবা হবার পরে নিজের সন্তান তথা শিশুদের মানুষ করা নিজের অভিজ্ঞতা আর নানা বইপুস্তক ঘেটে, অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পাঁচটা বই লিখি যার কোনো কোনোটি একাধিক ক্যাডেট কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে রেফারেন্স বই হিসেবে পড়ানো হয়। এর পর থেকেই মিডিয়ায় শিশুদের নিয়ে কোনো খবর বেরুলে তাতে আমার চোখ আটকে যায়। কারণ সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা শিশুই আমাদের সেনালি ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর। তাই উপরের খবরে আমি এতই আশাহত হয়েছি এই ভেবে যে, টাকা কামানোর জন্য শিশুদের তথা মানুষের জীবনকে ঢাল হিসেবে যারা ব্যবহার করছেন তাদের আমরা কী নামে ডাকবো, ভেবে পাচ্ছি না। কয়েকবছর আগের কথা, বিশ্বখ্যাত এক বাংলাদেশি ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানিতে প্রস্তুত শিশুখাদ্যে (দই) ক্ষতিকর উপাদান পেলে মামলা হয় আর তাঁকে আদালতে যেয়ে জামিন নিতে হয়। জামিন পাবার পরে উনি তাঁর কোম্পানির উৎপাদিত শিশুখাদ্যে ক্ষতিকর উপাদান থাকার প্রমাণ পাবার পরেও ক্ষমা চাননি একটিবারের জন্যেও, কিংবা মুখে কোনো অপরাধ বোধের ছাপ ছিল না। উনার ছবিসহ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে অন্ততঃ তাই বলেছিল। হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন যে, ‘যাক, আমাকে জেলে পুরতে পারেনি, আমি জামিনে মুক্ত হয়েছি’। এই যদি বিশ্বখ্যাত ব্যক্তির মানসিকতা হয় তবে অন্যদের আর কী বলার আছে।

আরেকটি খবরে দেখলাম, খাদ্য নিরাপত্তার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮ এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। গত ০৯ জুলাই ২০১৮ সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ আইনের খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়।

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বলেন, নিরাপদ লাভজনক কৃষি, টেকসই পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি শস্যের বহুমুখীকরণ ও বিপণন, উৎপাদনের প্রসার এ নীতির লক্ষ্য। এছাড়া প্রতিকূল পরিবেশে কৃষি উৎপাদন, নগরকেন্দ্রিক কৃষিসেবা, কৃষি উদ্ভাবনী সম্প্রসারণ, সারের ব্যবহার সম্পর্কেও বর্ণনা করা হয়েছে এ নীতিতে।  

তাড়াতাড়ি আর কম কষ্টে বেশি টাকা আয়ের জন্য গ্রামের মানুষ শহর তথা ঢাকায় আসছে দলে দলে, বন্যার পানির মতো। কেন মানুষ শহরে আসছে তার কারণ জানতে গ্রামের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে, নিরাপদ খাদ্য মজুত গড়ার নামে বেসরকারি খাতে এ বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির কারণে (বাজারে চালের দাম বেশি হলেও) গত কয়েক বছরের মধ্যে চাষী পর্যায়ে ধানের বিক্রি মূল্য ধান উৎপাদণ খরচের তুলনায় কম। তাই ধান উৎপাদনে চাষীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। কেমিক্যাল বা সিনথেটিক সারের অপরিকল্পিত ব্যবহারে জমির সাস্থ্যহানী বা জমির উর্বরাশক্তি হ্রাস, মানসম্পন্ন উন্নত বীজের অভাব বা বীজের বেশি দাম, সেচের ব্যয় বেশি, অর্থাভাবে সময় মতো সেচ না দিতে পারা, সারা দেশের এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোনের কথা চিন্তা না করে ফসল নির্বাচন, চাষের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক চিন্তা না করা বা ঐতিহ্য রক্ষা করে চলা, আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার অভাব, সার কীটনাশকের অপরিমিত ব্যবহার, এগ্রো-মেট্রোলজীর ব্যবহার বা প্রয়োগ না করার ফলে আমরা কৃষিতে সম্ভাব্য সাফল্য আনতে পারিনি। আমরা পারিনি কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণের মধ্যকার দূরত্ব দূর করতে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ হচ্ছে না কৃষি পণ্যের উৎপাদনে। এগ্রো-মেট্রোলজির অর্থ হলো কয়েক বছরের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে ফসল বোনা/ লাগানোর / সংগ্রহের সময় এগিয়ে বা পিছিয়ে নেওয়া, ইত্যাদি। উপরের কথা মনে রেখে, যে এলাকায় যে ফসল ভালো হবে বা হতে পারার সম্ভাবনা আছে, সেই এলাকায় সেই ফসলের উৎপাদন করার সরকারী নীতির সুষ্ঠু প্রয়োগ/ বাস্তবায়ন এখন খুব জরুরী। এখনো কৃষি নির্ভর এই বাংলাদেশে যারা কৃষির নীতি নিয়ে আর তার বাস্তবায়নে কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে যারা খুব ক্ষমতাশালী তাঁদের অধিকাংশের হাতেকলমে শিক্ষা নেই, পুঁথিগত বিদ্যায় উনারা অনেক জ্ঞানী। সরকারের পক্ষ থেকে যারা কৃষকদের কাছ থেকে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংগ্রহের মুল্য নির্ধারণ করেন হয় তারা পন্যের উৎপাদন ব্যয় জানেন না, না হয় তাঁদের ব্যক্তিগত লাভের প্রশ্ন জড়িত আছে আর না হয় তাঁরা জেনে বুঝেই আমাদের কৃষিকে ধ্বংস করতে চান।     

কৃষক, যারা গোটা জাতির খাদ্যের যোগান দেন তাদের বেলায় সব অবিচার অনাচার এক সঙ্গে করা হয়। কী হচ্ছে এর ফলে? অভাবে পড়ে শহর থেকে গ্রামে পালে পালে মানুষ চলে আসছেন। অবশ্য তাদের একটা অংশ আসছে নদী ভাঙ্গন বা কাজের অভাবে কিন্তু চাষির ছেলেরা অধিকাংশই আসছে সুপরিকল্পিতভাবেই। কারণ একজন চাষি একটা ফসল করে মাসে নিজের শ্রমের খরচও পান না। কিন্তু একজন রিক্সা চালক শহরে এসে রিক্সা বা অটোরিক্সা চালালে পান ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে গড়ে প্রায় তিন লাখ টাকা আয় করেন। তাই এসব দেখে কেন চাষাবাদ করবে মানুষ। তাই জমি বেঁচে কৃষকের ছেলে চলে যায় বিদেশে, কিংবা শহরে এসে নানা কাজ করে, গ্রামে সে যা করতে পারতো না। ফলে শহর হচ্ছে ভারাক্রান্ত, গ্রাম হচ্ছে মানুষ শূন্য। 

অন্যদিকে কৃষকের পণ্য কিনে নিয়ে একটু বাহারী প্যাকেট করে ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীরা তাই আবার বিক্রি করছেন ১০০ থেকে ৩০০ গুণ বেশী দামে আমাদের শহুরে বাঙ্গালী বাবুদের কাছে, কিংবা বিদেশে। যদিও সে লাভের ছিটেফোটার ভাগও কৃষকের ভাগ্যে জোটে না, এমনকি যদি সেটা সোশ্যাল বিজনেসও হয়। এগুলো দেখার দায়িত্ব যাদের তারা আইনের প্যাঁচে আটকা, একদম নুলো। তাদের কথা দেশের প্রধানমন্ত্রীর কানে যায় না, গেলেও শহরে বেড়ে ওঠা তথাকথিত বিশেষজ্ঞগণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখে (!) তাদের মতো করে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। উপায় কী? আমাদের আশে পাশের সব দেশ কৃষি বা কৃষিপণ্যে ভর্তুকি দেয়, দিতেই হবে। তারা কিভাবে দেয়। সেটা সঠিকভাবে অনুসরণ করা কি অসম্ভব! শুধু আমলা নির্ভর না হয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন দরকার। কারণ সব দোষ যেহেতু রাজনীতিকদের, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তাই তাদের দায়িত্বে থাকলে সেটা তুলনামূলক ভালোভাবেই পালিত হবে। কারণ অনিয়ম করলে মামলা হবে, জেল হতে পারে, রাজনীবিদ নিজে ও তার দল জনপ্রিয়তা হারাবে। কিন্তু সরকারী আমলা চুরি বা অনিয়ম করলে জনস্বার্থে অন্যত্র বদলী হবে। মানে অন্য উপজেলা বা জেলায় যাবেন। ভাবটা এমন যে সেখানে জনগণ নেই,মানে জনগণের স্বার্থহানীর সুযোগ নেই। তদন্ত হবে সেই রকম, কারণ ‘কাউয়ার মাংস কাউয়ায় খায় না; ফলাফল সব অসৎ আমলা নির্দোষ প্রমাণিত, সৎ রাজনীতিবিদও যান জেলে।       

শিল্প কারখানাসহ কত কত খাতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে, কিন্তু শুধু কৃষকদের বেলায় ‘কাকের মত চোখ বুজে’ আছে। সরকারের নীতি নির্ধারকগণ এখন থেকে চিন্তা না করলে, কৃষকদের সঠিকভাবে ভর্তুকি না দিলে গ্রামের মানুষ পালে পালে শহরে আসবে, গ্রামের দখল নেবে নব্য জমিদারী স্টাইলের ব্যবসায়ী কৃষক যারা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে জিম্মি করে ব্যবসা করবে, যা এখন করছে শিশু খাদ্য নিয়ে খুব বেশী। কৃষকদের কিন্তু এসি রুমের চাহিদা নেই। তাঁরা শুধু নিজের উৎপাদিত পন্যের উচিৎমুল্যের নিশ্চয়তা চায়। খারাপ বীজ বিক্রেতার কাছ থেকে কিনে ঠকলে তার ক্ষতিপূরণ চাই অনতিবিলম্বে। উদ্ভাবিত নতুন নতুন জাত আর কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারের হাতেকলমে শিক্ষার নিশ্চয়তা চায়, দুবেলা খেয়ে গ্রামেই শান্তিতে থাকতে চায়। তা না হলে কৃষির নতুন মাফিয়ারা দখল করে নেবে সব, শুধু টাকা আয়ের জন্য, যেনতেন উপায়ে। যেমন তাঁরা এখন করছে শিশুখাদ্যে, অন্যান্য খাদ্যে,অন্যান্য পণ্যে। সেদিন মনে হয় আর বেশী দূরে না যে আমদের পুরো জাতি সাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে আর তার থেকে বেরিয়ে আসবে কম করে হলেও তিন জেনারেশন, যদি বিজ্ঞান সত্য হয়। সুতরাং, আমরা যতই বলি না কেন, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, কিন্তু আমরা কি আমাদের সন্তান বা নিজেদের জন্য নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে পারছি! যেহেতু আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা এখনও নিশ্চিত করতে পারিনি ফলে, এটা ঝুঁকিমুক্তও নয়। আমাদের শিশু সন্তানদের আর আমাদের জীবন নিয়ে বানিজ্যটা আমার মতো অনেককেই যে ভাবায়, তা আমি নিশ্চিত।


লেখক:  উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

বাংলা ইনসাইডার 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭