ইনসাইড থট

ধর্মগুরু, পতিতালয় ও তথ্যসন্ত্রাস

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/07/2018


Thumbnail

বাচ্চাকে তার কম্পিউটার সায়েন্স বই থেকে সেন্সর নিয়ে পড়তে সাহায্য করছিলাম। কোন সেন্সর শব্দের মাত্রা নিয়ে, কোনটা আলো নিয়ে আবার কোনটা বায়ু বা পানি দূষণের খবরাখবর দেয় ইত্যাদি। কীভাবে সেন্সরের সাহায্যে চোর ধরে, বিরাট এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে কত মানুষ এলো গেলো তার হিসাব রাখে, কিংবা অন্ধকার হলে আপনা আপনিই সুইচ অন হয়ে আলো জ্বলে ওঠে, বাতাসে দূষণ থাকলে সতর্ক করে দেয়, ইত্যাদি। তার আগ্রহ বাড়াতেই পাশে বসে ছিলাম একটু উদাহরণ দিচ্ছিলাম আর ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ স্তরের নিরাপত্তা ভেঙ্গে সোনা জালিয়াতি নিয়ে খুব তোলপাড় চলছে। তখন মনে পড়ে গেলো কীভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন জনপ্রিয় পত্রিকায় শেখ কামালকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাত বানানোর চেষ্টা করে কাহিনী বানিয়েছিল। কীভাবে সেন্সরের মতো মানুষের সেন্সেটিভ অরগানে সুড়সুড়ি দিয়ে চেতনা জাগাচ্ছে এসব পত্রিকা। তাই ভেবে মনে মনে হাসলাম। পত্রিকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা ৯৬৩ কেজি স্বর্ণের বদলে যাওয়া। ভল্টে রাখা স্বর্ণ মিশ্র বা সংকর ধাতু হয়ে গেছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়েছে। ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ স্তরের নিরাপত্তা ভেঙ্গে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে এটা নাকি ‘ভৌতিক কাণ্ড’!  

একই দিনে  ‘আষাঢ়ে গল্প’ শিরোনামে অন্য একটি পত্রিকা বলেছে যে, শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে আটক বিলাসবহুল গাড়ি আদৌ তাদের দাবি অনুযায়ী এত দামি কিনা, কিংবা দামি এসব গাড়ি আটকের পর কী অবস্থা হয় সেসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। পত্রিকাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দারা অনেক সময় আটক করা গাড়ির দাম অতিরঞ্জিত করে গণমাধ্যম-সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে। এমনকি গোয়েন্দারা ৮০-৯০ লাখ টাকার টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮ ২০১৩ মডেলের দাম ৫ কোটি টাকা বলে প্রচার করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। সত্যিই যেসব কোটি টাকার গাড়ি উদ্ধার হয় সেসব গাড়ির কী হয় তা নিয়েও প্রতিবেদনে প্রশ্ন রাখা হয়েছে।

অন্য একটি পত্রিকায় ভূমি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে,‘ফাইল আটকে মন্ত্রী-সচিবের নজিরবিহীন হয়রানি’ শিরোনামে খবর ছাপা হয়েছে যে পত্রিকার মালিককে অনেকে আড়ালে আবডালে ‘ভূমি দস্যু’ বলে সম্বোধন করেন। তার মানে আমি এটা বলতে চাচ্ছি না যে, ভূমি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিমুক্ত জায়গা বরং মানুষের কাছে তাঁদের যে ইমেজ মানে মানুষের সেই সেন্স অরগানে টাচ করে রিপোর্টটি করা হয়েছে, যাতে পাবলিকে ভালো খান। যদিও এটা কতটুকু, মানে কতভাগ সত্য- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আরেকটি পত্রিকার খবরে এলসি জালিয়াতির খবর পড়ে মনে হচ্ছে যে, ব্যবসায়ীরা অধিকাংশই এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করছে। মানুষ এমন কথা শুনতে চান, তাই পত্রিকা এমন করে লেখে। কারণ সিনিয়র সাংবাদিকরা অনেক পড়াশুনা করেন, তাই তাঁদের কেউ যখন নষ্টামিতে মাতেন তখন আটঘাট বেঁধেই নামেন, পরিকল্পিতভাবেই নামেন, নিউজ করেন। প্রচারিত খবর নিয়ে অনেক আগেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই চরম সত্যটি তাঁরা ভালো করেই জানেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, ‘কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর।’

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাসদ পরিচালিত দৈনিক গণকন্ঠের মাধ্যমে শেখ কামালের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টার শক্ত অভিযোগ আনা হয়,বানানো হয় ‘আষাঢ়ে গল্প’। অনেকেই তা বিশ্বাস করেন, এখনো রেফারেন্স দেন নানা উপলক্ষে, যদিও কথাটি সত্য নয়। কিন্তু প্রমাণ করতে অনেক সময় লেগেছে,অনেক মূল্য দিতে হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে।

২৫-২৬শে এপ্রিল ১৯৮৬ সালে তদানীন্তন রাশিয়ান ফেডারেশনের চেরনোবিলে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে। চেরনোবিলে দুর্ঘটনা পরেই অস্ট্রেলিয়ার তৈরি রেড কাউ এর বাংলাদেশি এজেন্ট অমনি পরিকল্পিত প্রচার শুরু করেন যে ডেনমার্কের তৈরি ডানো দুধে মারাত্মক ক্ষতিকারক রেডিয়েশন পাওয়া গেছে যদিও রাশিয়ান ফেডারেশনের চেরনোবিল থেকে আকাশ পথে ডেনমার্কের দূরত্ব হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। কারণ ডানো বাংলাদেশের গুড়া দুধের বাজারের প্রায় ৯০ ভাগেরও নিয়ন্ত্রণ করতো। ডানো দুধে মারাত্মক ক্ষতিকারক রেডিয়েশন নেই এটা প্রমাণ করতে অনেক সময় লেগে যায়, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ডানোর ব্যবসায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়, যা এখনো উঠে আসেনি।

গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী লাকী যখন চরম জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে ওঠে ঠিক তখনই বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকায় লাকীকে বেশ্যা বানানোর চেষ্টা অনেকাংশেই সফল হয়। এই সেই পত্রিকা যাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে মনে করা হয়।

২০১৩ সালের ৫-৬ মে মাসে হেফাজত আন্দোলন নামে একটি নতুন সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশে করে বাংলাদেশ ব্যাংক চত্তরে। সেই বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে সরকার। রাতের অন্ধকারে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে শত শত মানুষকে সরকার হত্যা করেছে বলে প্রচার করে একটি মানবাধিকার সংগঠন। কিন্তু পরে প্রমাণ হয় যে, যাদের মৃত বলা হয়েছে তাঁদের প্রায় সবাই জীবিত, মৃতের সংখ্যা আর মৃত্যুর কারণের- দাবির সঙ্গে মিল নেই। কিন্তু ততদিনে সরকারের ইমেজের যা ক্ষতি হবার তা হয়ে যায়। সরকারকে ইসলাম বিরোধী সরকার মনে করতে শুরু করেন দেশের এক শ্রেণীর মানুষ। ফলে এই ঘটনার পরেই অনুষ্ঠিত সবগুলো সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে সরকারি দল খুব বাজে ভাবে হেরে যায়। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে সমাবেশ আসলে সরকার উৎখাতের একটা অপচেষ্টা ছিল তা প্রমাণিত হতে সময় লাগে, সরকারকে অনেক মূল্য দিতে হয়।

বিএনপি নেতাদের মার্কিন কংগ্রেস-ম্যানের বিবৃতি বা ভারতের বিজেপি নেতার টেলি সংলাপ জালিয়াতির কথা আমাদের ভুলে যাবার কথা নয়। এটা নিয়ে মিথ্যাচার পরে ধরা পড়লেও শুরুতে বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা বড় ধাক্কা দেয় আর বাজে ধারণার জন্ম দিতে শুরু করে। কিন্তু আইটি এই যুগে, প্রযুক্তির কল্যাণে তা ডালপালা বিস্তারে তেমন সক্ষম হয় না, উদ্দেশ্য বিফলে যায়।

এই তো কয়েকদিন আগের কথা। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীর মৃত্যু নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের নেতা ডাক্তার এমরান এইচ সরকার সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা স্ট্যাটাস দিয়ে বলে যে, একজন আন্দোলনকারী মারা গেছে। মুহূর্তে খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যা সামাল দিতে সরকারকে চরম নাকাল হতে হয়, যদিও খবরটি ছিল মিথ্যা। আহত শব্দের ‘আ’ বাদ দিয়ে হত মানে নিহত বানিয়ে দিয়েছিল। এটা ছিল নিউজের টুইস্টিং।

এটা যখন লিখছি তখন অনলাইন পোর্টালে খবর এলো যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা নিয়ে যে ‘ভৌতিক কাণ্ড’ হয়েছে তা মূলত ক্লারিকাল মিস্টেক মানে কেরানিদের ভুলে। বাংলায় লেখা ৪০ ইংরেজিতে ৮০ হয়ে গেছে। খুব বড় কোনো ঘটনা এখানে ঘটেনি সবাই একমত হয়েছেন এক সভায় যেখানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। এটা আসলে অতিরঞ্জন বা মিডিয়া টুইস্ট। যাকে অন্যভাবে বললে বলতে হয় তথ্য সন্ত্রাস। কারণ একটা মিথ্যা বা আংশিক সত্য নিয়ে তৈরি খবর যা মিডিয়া টুইস্ট নামে পরিচিত, তা গোটা দেশে আগুন জালিয়ে দিতে পারে। তাই সব শেষে আমার ফেসবুকের এক বন্ধুর ওয়াল থেকে নেওয়া একটা মিডিয়া টুইস্টের গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই।

একবার এক ‘ধর্মগুরু বাংলাদেশে আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। দুই দিনের সফর। তার কাছের লোকেরা তারস্বরে নিষেধ করতে শুরু করল- দয়া করে বাংলাদেশে যাবেন না।

ধর্মগুরু বললেন, কেন?

উত্তরে তারা বললেন- ঐ দেশে বিশেষ ধরনের সাংবাদিক আছে। তাদের সংখ্যা অগণ্য। তারা আপনাকে কলঙ্কিত করবে।

ধর্মগুরু বললেন, আমি জীবনে জ্ঞানত কোনো পাপ করিনি। মিথ্যা অপবাদের ভয় আমার নেই।

কারও নিষেধ কানে না নিয়ে তিনি বাংলাদেশের বিমানে উঠলেন।

ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখা মাত্রই একদল সাংবাদিক তাকে ঘিরে ধরল। প্রথম প্রশ্ন এলো- বাংলাদেশের পতিতালয় সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

ধর্মগুরু জানেন যে এই দেশের মানুষ খুব ধর্মপ্রাণ। তাই তিনি একটু অবাক হয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলেন- এই দেশে কি পতিতালয় আছে?

পরের মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশের সব টিভিতে একটাই লাইভ নিউজ- ‘বাংলাদেশে নেমেই পতিতালয়ের খোঁজ নিলেন ধর্মগুরু!’

পরদিন সব পত্রিকার হেডিং-- "বিমানবন্দরে নেমেই পতিতা খুঁজলেন ধর্মগুরু!"

ফেসবুক, টুইটার ভেসে গেল এই হেডিং দিয়ে।

ধর্মকেন্দ্র থেকে ফোন এলো- ‘ধর্মগুরু আপনি অবিলম্বে ফিরে আসুন এবং পদত্যাগ করুন।’

লেখক: কলামিস্ট ও উন্নয়নকর্মী

ই-মেইল: arefinbhai59@gmail.com

তথ্যঋণ: Zakir Talukder, AK Dulal, অনলাইন পোর্টাল, ইন্টারনেট, ইত্যাদি।

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭