ইনসাইড থট

দায় এড়ানোর সংস্কৃতি জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রধান অন্তরায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/07/2018


Thumbnail

ঢাকা মহানগরীতে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলাভূমি, নিন্মাঞ্চল, খাল ও নদী ভরাট ও দখল, খাল ও নালা-নর্দমা আবর্জনায় ভরাট এবং নিয়মিত পরিষ্কার না করা, সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহিতার অভাব, দায়িত্বে অবহেলা, সমন্বয়হীনতা, জনসচেতনতার অভাব রাজধানীর জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। আর অস্বাভাবিক হচ্ছে গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি হওয়া, বর্ষাকালে বৃষ্টি না হওয়া। এবছর গ্রীষ্মকালে ঢাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এবছর শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি। টানা খরার পর শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহের শেষে বর্ষার আসল রূপ দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি। তবে রাজধানীবাসীর জন্য বর্ষার এমন রূপ চরম দুর্ভোগ বয়ে আনছে। কেননা কর্মচঞ্চল নগরজীবনে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, যানজট অনেকাংশেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে নগরবাসীকে পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি। জলমগ্ন রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় গর্ত থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনা।

বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা-যানজটে ঢাকা মহানগরী অচল হয়ে পড়ে। গত বছর ঠিক এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, এ বছর জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ, ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। ২৪ ঘণ্টায় ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। মেট্রো রেলসহ ওয়াসা, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বেশির ভাগ সড়ক এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যেটুকু সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য রয়েছে, তাও খোঁড়াখুঁড়িতে তৈরি হওয়া খানাখন্দে ভরা। জলাবদ্ধ সড়কে খানাখন্দের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে আটকে পড়ছে বাস, কার, অটোরিক্সা ও রিক্সা। এতে রাজধানীর বেশির ভাগ সড়ক জুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।

গত বছরের ২৬ জুলাই পল্লী উন্নয়ন, সমবায় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছু দিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে বর্তমান জলাবদ্ধতা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিটা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি, কোন জায়গায় আটকা পড়ছি। সে জায়গায় দ্রুত ব্যবস্থা নেব। ভারী বৃষ্টি হলেও যেন তিন ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশন হয়, সে ব্যাপারে ওয়াসাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এর আগে ঢাকার দুই মেয়র, ওয়াসার এমডি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা এক বছর সময় চেয়ে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মন্ত্রীকে এবং তাঁর মাধ্যমে নগরবাসীকে।

মন্ত্রীর নির্দেশ, মেয়র ও এমডির দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তব কোনো প্রতিফলন নগরবাসী দেখছে না। এবছরও সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে জনজীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত হাঁটুপানি থেকে কোমরপানি জমছে। গত বছর মেয়রকে হাঁটুপানিতে নেমে প্রতিশ্রুতি দিতেও দেখা গেছে। এতে আশ্বস্তও হয়েছিল নগরবাসী। কিন্তু এবছর এপ্রিলের শেষের দিকের বৃষ্টিতে আবারও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক কর্মপরিকল্পনা ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনের ঘোষণা অর্থহীন। বর্তমান আইনি কাঠামোয় খাল ও স্টর্ম ড্রেন দেখভাল করার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার আর রাস্তার দুই পাশের সারফেস ড্রেন দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন এবং জনগণ তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেই জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান সম্ভব।

উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২৩০ কি.মি., দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০০০ কি.মি. এবং ওয়াসার বক্স কালর্ভাটসহ ৩৭০ কি. মি. ড্রেনেজ লাইন নিয়মিত পরিষ্কার এবং খালগুলো দখলমুক্ত করে নিয়মিত পরিষ্কারের পর্যাপ্ত উদ্যোগ না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় রাজধানীর রাস্তাগুলো। রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো পলিথিন, প্লাস্টিক বোতলসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকে।  শত শত কোটি টাকা খরচ করে এসব আবর্জনা পরিষ্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন করলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। বর্তমান সময়েও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম চলছে। এরপরও স্বস্তিতে নেই নগরবাসী।

প্রতি বছর জলাবদ্ধতায় সেবা সংস্থাগুলো নিজেদের ব্যর্থতার দায় একে-অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, রাজধানীতে মাত্র দুই শতাংশ জলাভূমি রয়েছে, যেখানে থাকার কথা ১২ শতাংশ, নিন্মাঞ্চল ভূমিদস্যুদের দখলে, ৬৫টি খাল ও চারটি নদী ছিল, এখন সেগুলো নেই; এসব কারণে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন কিছুটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাঁর পরিসংখ্যান নিয়ে মতভেদ থাকলেও জলাভূমি, নিন্মাঞ্চল, খাল ও নদী ভরাট ও দখলের বিষয়টি কম-বেশি প্রায় সকলেরই জানা। একই সাথে ঢাকা ওয়াসা যে ২৬টি খাল দেখভাল করার কথা সেগুলো দখলমুক্ত ও পরিষ্কার করে প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম নগরবাসীর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ১৯৮৯ সালে ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনে মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাশাপাশি একাজে যুক্ত হয় সিটি করপোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। ওয়াসা পানি সরবরাহের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পানি নিষ্কাশনে নজর দেওয়ার সময় নেই। আর এর ফলে ভুগছে নগরবাসী।

গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন জলাবদ্ধতা-যানজট নিরসন তাঁর দায়িত্ব নয়; জলাবদ্ধতা সমাধান করবে ঢাকা ওয়াসা; যানজটের সমাধান করবে অন্য সংস্থা। কিন্তু নগরবাসীর প্রশ্ন- ডিএসসিসির য নিয়ন্ত্রণাধীন ১০০০ কি.মি. ড্রেনেজ লাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার করা হচ্ছে কি? রাজধানীর জলাবদ্ধতা লাঘবে ২৬টি খালের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে ওয়াসা এবং ২ হাজার ৬ শত কি.মি. ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা উদ্যোগ নিবে এটাই নগরবাসীর প্রত্যাশা।

বৃষ্টির পানি ড্রেনের মাধ্যমে স্ট্রম স্যুয়ারেজে যাবে, সেখান থেকে খালে, খাল থেকে নদীতে পড়বে। দীর্ঘ এই পথের প্রতিটি অংশ নির্বিঘ্ন হতে হবে। কোথাও এটি বাধাপ্রাপ্ত হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলো পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। খালগুলো উদ্ধারের পর এগুলো পরিষ্কার করে দুই পাড় বাঁধাই করতে হবে। যাতে আবার বেদখল না হয়। পাশাপাশি এগুলো নিয়মিত তদারকি, পরিচর্যা ও পরিষ্কার করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ রূপ নিবে। নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা-যানজট থেকে মুক্তি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। বাস্তবে ভোগান্তি কমছে না, বরং প্রতি বছর বাড়ছে।

উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা নিজেদের দায় স্বীকার না করে একে অপরকে দোষারোপ করছে। আবার সমন্বয়হীনতার কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি সংস্থা ও জনগণের নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালনের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা, যানজটসহ বিভিন্ন সমস্যা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আর যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটুকু সমন্বয়ের মাধ্যম সমাধান করতে হবে।

ঢাকা মহানগরী পৃথিবীর দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলোর অন্যতম। নানা সংকটে এ মহানগর বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বাসস্থান, যাতায়াত, বিনোদন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ মৌলিক ও প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে যানজট ও জলাবদ্ধতা। মহানগরীর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থতা, অদূরদর্শিতা, দায়িত্বহীনতা এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবসহ নানা কারণে নগর জীবনের সমস্যাগুলো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকাকে বসবাসযোগ্য একটি পরিকল্পিত মহানগরী হিসেবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব রাজউকের। এছাড়া ওয়াসা, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, বিআরটিএ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে এবং সংস্থাগুলো তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হওয়ায় এ মহানগরী বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে দ্রুত জীবনযাএার মানের অবনতি ঘটছে এবং নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

করণীয়:

জলাবদ্ধতা নিরসনে সঠিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

সিএস অনুযায়ী খালের সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা।

খালগুলো দখলমুক্ত ও খনন করে প্রবাহ নিশ্চিত করা এবং দুই পাড় বাঁধাই করা।

ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা।

সংস্থাসমূহ একে অপরকে দোষারোপ না করে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা।

খাল ও ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করা।

প্রতিটি সংস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ সিস্টেমকে একক কর্তৃত্বে নিয়ে আসা।

জনগণকে সচেতন করা এবং তাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করা।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পবা এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর

 

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭