ইনসাইড আর্টিকেল

কর্মযোগী বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায়: জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 30/07/2018


Thumbnail

২ আগস্ট। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের এদিনে বর্তমান খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলায় বাড়ুলী গ্রামে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যিনি স্যার পিসি রায় নামে সমধিক পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের প্রায় ০৩ মাস পূর্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন (৭মে, ১৮৬১)। বহুভাষাবিদ, সমাজসেবী, সুপন্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী হরিশ্চন্দ্র রায় চৌধুরীর তৃতীয় সন্তান প্রফুল্ল চন্দ্র। অত্যন্ত মেধাবী প্রফুল্ল চন্দ্র ৯ বছর পর্যন্ত নিজ গ্রামে তাঁর পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মিডল ইংলিশ স্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে অন্য ভাইদের সাথে পড়াশুনার জন্য কলিকাতায় গমন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) বি.এ পড়াকালে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি নিয়ে বিলাত গমন এবং এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রী অর্জন করে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় এক বছর বেকার থাকার পরে তিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে মাসিক ২৫০ টাকা বেতনে প্রেসিডেন্সি কলেজে অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। রসায়ন শাস্ত্রের এ অধ্যাপক ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে মারকিউরাস নাইট্রাইট নামক যৌগিক পদার্থ আবিস্কার করেন। নাইট্রাইটস এর উপর বহুবিধ গবেষণা ও সাফল্যের জন্য তাকে মাস্টার্স অব নাইট্রাইটস বলা হত। তৎকালীন ভারতবর্ষে রসায়ন শাস্ত্রের এ জনক শুধু রসায়ন শাস্ত্র বা বিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা নিয়ে জীবন পার করেননি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথা রবির প্রখর আলোকচ্ছটায় যখন ভারতবর্ষ উদ্ভাসিত তখন জোছনার প্রদীপ্ত আলোর ন্যায় স্বীয় প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রফুল্ল চন্দ্র করেছেন বিভিন্ন দিককে আলোকিত। তিনি হয়েছেন প্রবাদ প্রতিম রসায়নবিদ, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী, বিজ্ঞানসেবী, সাহিত্যবোদ্ধা, স্বদেশী আন্দোলনকারী, ধর্ম সংস্কারক, শিল্পদ্যোক্তা, সমবায়ী, ফলিত অর্থনীতিবিদ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মী, আর্তসেবী, মানবদরদী, ইতিহাসবিদ এবং কর্মযোগী। এতবড় একজন বিজ্ঞানী নিজেই বলেছেন ‘I became a chemist by mistake’। প্রথম জীবনে তিনি ইতিহাস পড়ার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পড়তে না পারায় সে খেদ মিটিয়ে লিখেছেন আত্মজীবনী Life and Experience of a Bengali Chemistসহ রসায়নের ইতিহাস। তিনি ইতিহাস সম্পর্কিত বই, প্রবন্ধ এবং ইতিহাস লিখনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্রকে উৎসাহ দিয়ে এ অঞ্চলের কালজয়ী ইতিহাস ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’ লিখনে অবদান রেখেছেন এবং নিজ অর্থে তা মুদ্রণ করেছেন।

বাঙালির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সাহস তো দূরের কথা, কল্পনা করাও যখন ছিল কল্পনাতীত। সে সময় নিজ বেতনের সঞ্চিত ৮০০ টাকা নিয়ে বসতগৃহে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকুরী করা অবস্থায় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে তিনি দেশীয় ও ভেষজ উৎপাদন দিয়ে কেমিক্যাল ও ঔষধ প্রস্তুত শুরু করেন। শুরুর দিকে এটি ছিল একটি সাহসী যুদ্ধ। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এর প্রতিষ্ঠায়। তাঁর ভাষায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠায় আমি কুলির মত কাজ করেছি’। কেমিক্যাল তৈরির জন্য তাঁর ৯১, আপার সার্কুলার রোডের বাসায় টিনের চালের গরুর হাড়ের স্তুপ রেখেছেন শুকানোর জন্য। শকুন-চিল এর কয়েকখানা নিয়ে যাচ্ছে, ছড়াচ্ছে এ পাড়ায় ও পাড়ায়। আর যায় কোথায়? পাড়াশুদ্ধ লোকজন দ্বারা আচার্যের বাড়ী ঘেরাও। একটাই বক্তব্য- পাড়া ছাড়ো। শেষ পর্যন্ত রফা। দূরে টালিগঞ্জের বাঁশবনে তা নিয়ে সালফিউরিক এসিড দিয়ে পুড়িয়ে তৈরি হলো ফসফেট অব সোডার মন্ড। ঔষধ ও কেমিক্যাল তৈরীর উপকরণ। সাজি মাটি দিয়ে সোডা তৈরি করেছেন। এভাবে সেখানে তৈরি হলো ন্যাপথলিন, ফিনাইল, সোডিয়াম বায়োসালফেট, সালফিউরিক এসিড, ক্যাফিনসহ অনেক কেমিক্যাল। গাছ-গাছড়া দিয়ে তৈরি হতে শুরু করল কালমেঘ, বাসক, জোয়ানের আরক এবং আরও নানা ঔষধ। উৎপাদন খরচ কম বলে দামও কম। সেই ছোট কারখানা থেকে দেশের অন্যতম বৃহৎ কেমিক্যাল ও ঔষধ কারখানা হতে সময় লাগেনি। ১৯০১ সালেই আয় হলো ২৩ হাজার ৩৭১ টাকা। ১৯১৫ সালে সে আয় দাঁড়ায় ৫ লক্ষ টাকায়। তিনি এভাবে ক্যালকাটা পটারী ওয়ার্কস, বেঙ্গল এ্যানামেল ওয়ার্কস লিঃ, বেঙ্গল সল্ট কোম্পানী লিঃ প্রতিষ্ঠা করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পাশাপাশি অনেক শিল্প স্থাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এদেশে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য বেঙ্গল ইনিসিয়েটিভ নামক আলোচনা সভার প্রতিষ্ঠা করেন। সাধারণের সম্পত্তি করার জন্য তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র প্রমুখ প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিকের যুগে একজন স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিকের সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ থাকে না। কিন্তু আচার্য ছিলেন ব্যতিক্রম। সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণ করেছেন। শেকসপিয়ারের উপর ধারাবাহিক প্রবন্ধ এবং বই লিখেছেন। একইসঙ্গে সমবায়, কৃষি উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, রসায়ন, ইতিহাস, প্রাণী বিজ্ঞান, সমাজ সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখনী চালিয়েছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তিনিই এতদাঞ্চলে পথ প্রদর্শক। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে বাংলায় বই প্রকাশের জন্য ১৮৯০ সালে তিনি নেচার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরপর ৩ বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে পাটনায় প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞান, গবেষণা, শিল্প উদ্যোগ, ব্যবসা, সমাজ সংস্কার, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বহু বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ রচনা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রসারে ভূমিকা রাখেন। বঙ্গীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রকাশিত সাময়িকী ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় শুরুর থেকে তিন দশকের বেশী সময় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখেছেন। এ পত্রিকায় তাঁর শেষ লেখা যখন বের হয়, তখন আচার্যের বয়স ৭৫। অথচ এ বয়সে তাঁর লেখার বিষয় ছিল ‘অন্ন সমস্যা ও গো-পালন’। অর্থাৎ এ বয়সেও কৃষির উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে তিনি অবদান রাখার প্রয়াস পেয়েছেন।

কৃষির উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করেছেন নিরলসভাবে। ফরিদপুর কৃষি ফার্মের মাধ্যমে ফরিদপুর জেলার কৃষকদের নিয়ে সমীক্ষা করেছেন। ফরিদপুরে গো-খাদ্য তথা ঘাসের সমস্যা সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। উন্নততর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষির ফলন বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এমনকি ঐ সময় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য রাসয়নিক সারের ব্যবহার প্রচলন না থাকা সত্ত্বেও, লাভের কথা চিন্তা না করে তাঁর বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে উর্বীন সার তৈরি করে কৃষকদের মধ্যে তা সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। কৃষিজাত পণ্য বিপণনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকের উন্নয়ন হবে, একথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই সমবায় আন্দোলনে নিবিড়ভাবে আত্মনিয়োগ করেন। সমবায়ের মাধ্যমে মানুষকে আত্মনির্ভর করে তোলাই ছিল তাঁর ধ্যান। উৎপাদন সমবায় ও শিল্প সমবায় গঠনের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রামে রাড়ুলী কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যাংক ফেব্রুয়ারি, ১৯০৯ মাসে নিবন্ধন লাভ করে। তাঁর একমাস পূর্বে অবিভক্ত বাংলায় মেদিনীপুরে প্রথম সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বেঙ্গল কেমিক্যাল কর্মচারী সমবায় সমিতি, বঙ্গবাসী সমবায় ক্যান্টিন এন্ড স্টোর্স, বঙ্গীয় সমবায় সংগঠন সমিতি, বাঁধ নির্মাণ সমবায় সমিতি, জলসেচ সমবায় সমিতি, বিপণন সমবায় সমিতি, স্বাস্থ্য সমবায় সমিতি ইত্যাদি উৎপাদন, উপকরণ এবং বিপনন বিষয়ক অনেক সমিতি গঠনে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। সমবায়ের মাধ্যমে হস্ত শিল্প ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে Indian Industrial Commission এর কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। তৎকালীন মরণঘাতী রোগ কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ এন্টি ম্যালেরিয়াল সোসাইটি গঠন করে তিনি এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত শিক্ষকদের পরিবারকে সাহায্যের জন্য সমবায় মডেলে তিনি ‘টিচার্স বেনেভোলেন্ট ফান্ড’ গঠন করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ অর্গানাইজেসন সোসাইটির সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। সমবায়ের এ শীর্ষ সংগঠন সৃজনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সমবায়ের প্রসারে তিনি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত গমনে ক্লান্তিহীন ছিলেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার দূর্গম অঞ্চলে এক সমবায় ব্যাংক উদ্বোধনের জন্য ৭২ বছর বয়সে সারারাত হাতির পিঠে চেপে গমন করেছেন। সমবায় আন্দোলনের একজন দক্ষ সংগঠক হিসাবে তিনি আজীবন পরিশ্রম করেন।

কৃষি উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে সমবায় সৃজন ও সম্প্রসারণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, দূর্ঘটনা ও মৃত্যুর কারণে এসব দুঃস্থ পরিবারকে রক্ষার জন্য ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন আর্য বীমা কোম্পানী। ১৯৩৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বীমা সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশীয় বীমা কোম্পানী এবং এর গ্রাহকদের সুরক্ষার জন্য বৃটিশ সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন। বীমা আইনে এ বিষয়ে ধারা সংযোজনে সুপারিশ করেছেন।

আচার্যের সক্রিয় রাজনীতি করার সময় ও সুযোগ কোনটাই ছিলনা। অথচ ১৮৮৫ সালে বিলেতে থাকা অবস্থায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে ‘India before and after Mutiny’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে বৃটিশ সরকারের সমালোচনা করেন। ইংরেজ গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় তাঁর সম্পর্কে রিপোর্ট ছিল ‘Revolutionary in the disguise of Scientist’। চরকায় কাটা ধুতি ও চাদর ব্যবহার করতেন। জেল খেটে বের হওয়া কর্মীর কর্মসংস্থানের জন্য আর্থিক সাহায্য করতেন। স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন করেছেন। খাদির প্রসারে সহযোগিতা করেছেন। ফরিদপুরে গান্ধিজীর উপস্থিতিতে কংগ্রেস সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। বৃটিশ রাজের ভারত বিরোধী নীতির সমালোচনা করেন। মঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় আচার্য সম্পর্কে লেখা হয় ‘He is one of the bitterest critics of the British Govt’। তাঁর বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে ‘Science can afford to wait but Swaraj can not’।

শিক্ষক এবং শিক্ষা সম্প্রসারণে আচার্যের তুলনা তিনি নিজে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে National Council of Education এর সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকুরিকালে ‘The Congress of the Universities of the Empire’এ যোগদানের জন্য ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভারতীয়দের আরও শিক্ষার সুযোগ এবং ভারতে আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী পেশ করেন। পরবর্তীকালেও এ কংগ্রেসে যোগদান করে ভারতীয়দের মাঝে শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখেন। নিজ গ্রামে ১৯০৩ সালে পিতার নামে উচ্চ ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি All Bengal Teachers’ Association (ABTA) এর প্রথম সম্মেলনেরও সভাপতি। All India Education Conference আয়োজন করেন। All India College and Universities TeachersÕ Conference এর উদ্যোক্তা ও সভাপতি ছিলেন। নারী শিক্ষা ও ভকেশনাল শিক্ষা সম্প্রসারণে আর্থিক সহযোগিতা করেন। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তিনি Indian Science New Association গঠন করে এর প্রথম সভাপতি হন। বাগেরহাটে কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন, যা ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তার নামে নামকরণ করা হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কুখ্যাত মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের বিরোধিতা করেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁর কোনো তুলনা নেই। রসায়ন শাস্ত্রে তাঁর ক্লাসে অন্য কলেজের ছাত্ররাও বক্তৃতা শুনতে আসত। তিনি ছিলেন প্রাঞ্জলভাষী একজন ছাত্রবৎসল শিক্ষক। অকৃতদার আচার্যের কোন সংসার ছিল না। ছাত্ররাই তাঁর সন্তান। বন্যা বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র সর্বাত্মক সহযোগিতার পাশাপাশি নিজে ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নিতেন এবং জনসাধারণকে অর্থ সাহায্য করতে উৎসাহ দিতেন। আর্তত্রাণে তাঁর এরূপ সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে মহাত্মা গান্ধী তাকে Doctor of Food সম্বোধনে অভিহিত করেন। আর্তের সেবা কাজের জন্য ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

তিনি সমাজের বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতা নিবারণেও নিরলসভাবে কাজ করেন। সমাজ সংস্কারে সমিতি সৃজন করেছেন। প্রকাশ্য জনসভায় মেথরকে জড়িয়ে ধরেছেন। জাতিভেদ, শিশুবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন করেছেন। এজন্য কমিটি করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন, ট্রাস্ট গঠন করেছেন। দিবারাত্র বহুবিধ কাজের সাথে নিরলসভাবে সম্পৃক্ত থেকেও নিরাসক্ত জীবনযাপন করেছেন। তাঁর কোনো ভৃত্য ছিল না। খাবার ছিল অতিসাধারণ। দিনের বেলা ভাত খেতেন না। কারণ দিনে ভাত খেলে ঘুম পাবে এবং কাজের সময় কমে যাবে। নিজের কাজ নিজে করতেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল, লেখা বই এর রয়ালটি এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের বেতন সবমিলিয়ে মাসে তার প্রচুর আয় ছিল। কিন্তু ব্যয় ছিল মাসিক ১৬ টাকা তথা দৈনিক আট আনা। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসরের পর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অনুরোধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এ সময় তিনি বেতন গ্রহণ করেননি। ১৯৩৬ সালে অবসর নেবার সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বেতনবাবদ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে সঞ্চিত অর্থ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর এরূপ দানের ঘটনা অনেক। বাগেরহাট পিসি কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও খাদি সম্প্রসারণ, সমবায় সম্প্রসারণ, বন্যা ত্রাণ, নারী শিক্ষা, সমাজ সংস্কারসহ বহুবিধ উন্নয়নে তাঁর উল্লেখযোগ্য দান আছে। কর্মযোগী জ্ঞানতাপস এ বিজ্ঞানীর ৭০তম জন্ম জয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে। এ আয়োজনের জন্য সংগৃহীত হয় ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু খরচ হয়েছিল মাত্র ১২৭ টাকা। অবশিষ্ট টাকাও দান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মানবদরদী এ বিজ্ঞানীর জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল তৈরি, হ্যান্ড বিল বা অন্যান্য বিষয়ে অনেক সরবরাহকারী টাকা গ্রহণ করেননি। এটাই তাঁর কাজের স্বীকৃতি। বেতনের টাকা দিয়ে তিনি বিজ্ঞান কলেজের জন্য ০৬টি ঘর তৈরি করেন। শর্ত একটি ঘরে তাকে আজীবন থাকতে দিতে হবে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে নাইট উপাধী অর্জনকারী এ বীর বাঙালী তাঁর সর্বস্ব দান করে ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দের আজকের দিনে পরলোক গমন করেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা, কাজ ও অর্জন এখন বহুগুণে সম্প্রসারিত হয়েছে। আসছে ২ আগস্ট বাংলাদেশের এ মহান বিজ্ঞানীর শুভ জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ জানাই।

লেখক: চেয়ারম্যান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক

বাংলা ইনসাইডার/বিপি/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭