ইনসাইড থট

শিক্ষার্থীরা বিদেশ যাচ্ছে কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 03/08/2018


Thumbnail

শুধু কি দেশে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগের অভাবেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া নয়, শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশও। এমনকি পাশের দেশ ভারতও এখন এ দেশের শিক্ষার্থীদের অন্যতম গন্তব্য। সর্বাধুনিক শিক্ষা ও বৈশ্বিক সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় এবং বৃহত্তর পরিবেশে সারা পৃথিবীর মেধাবীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ নিতে শিক্ষার্থীরা বিদেশের দিকে ঝুঁকছেন।

শিক্ষার্থীদের বিদেশ গমনের বিষয়ে তথ্য দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। তাদের ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে ২০১৬ সালে ৬০ হাজার ৩৯০ জন এবং ২০১৫ সালে ৩৩ হাজার ১৩৯ জন বিদেশে গিয়েছেন। এ পরিসংখ্যান দেখে বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, ২০১৭ সালে বিদেশে পড়ালেখার জন্য গিয়েছে লাখো শিক্ষার্থী।

ইউনেস্কো ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর যে সংখ্যা উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে কেবল মালয়েশিয়ায় পড়তে গিয়েছেন ৩৪ হাজার ১৫৫ জন। ভারতে ১ হাজার ৯৯, জাপানে ৮১০, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪৫৫ জন। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের গন্তব্যের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন দেশ। সৌদি আরব (৮৭০ জন), আরব আমিরাতের (৬৩৭) পাশাপাশি তালিকায় এসেছে ফিনল্যান্ড (৫১১), নিউজিল্যান্ড (৩২৬), থাইল্যান্ড (২৮৯), তুরস্ক (২৫৫), কাতার (২৪০), ওমান (১০৩) ও পোল্যান্ডের (৬৬) মতো দেশের নাম।

সংস্থাটি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের প্রবেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব হিসাব উপস্থাপন করেছে। ইউনেস্কোর দেওয়া এসব তথ্য নির্দেশ করছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন তীব্র হচ্ছে। ভিসা তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছেন এক হাজার ২৪৭ জন শিক্ষার্থী। গত বছর এই হার ২২.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫০২ জনে।

শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার এই প্রবণতার সঙ্গে সরকারের পরিকল্পনা খাপ খায় না। সরকারের লক্ষ্য হলো দ্রুততম সময়ে আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। কিন্তু বিপুল শিক্ষার্থীর বিদেশ যাওয়ার উপরোক্ত চিত্র নির্দেশ করে যে, তারা পড়ালেখা করতে গিয়ে যেমন টিউশন ফি হিসেবে বিদেশে অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি পড়ালেখা শেষে অনেকে দেশে ফিরছে না। এভাবে অর্থ ও মেধা উভয়ই পাচার হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি ও ভবিষ্যত। এগোতে পারছে না সরকারের পরিকল্পনা।

এই সংকট মোকাবিলায় তরুণদের দেশে ধরে রাখাটা জরুরী। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নিয়ে তারা হতাশায় ভুগছেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির ডামাডোল এবং স্বল্প আসনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেককে সেখানে পোড়ার ভাবনা থেকে দূরে রাখছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বছর বছর বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে শিক্ষার্থীদের সতর্ক করছে। এ বছরও গত মাসে এরকম এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক শিক্ষার মান নিয়ে ইউজিসি বরাবরই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ফি বছর তাদের দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৬ তে বলা হয়, ৯১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এর মধ্যে ৬০টিতে উপাচার্য, ২০টিতে উপ-উপাচার্য এবং ৪৪টিতে কোষাধ্যক্ষ রয়েছে। বাকিগুলোতে শীর্ষ পদ ফাঁকা রেখেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রতিবেদনে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও শিক্ষাদান কার্যক্রমের মান নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করা হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ও উচ্চমান নিশ্চিত করতে এগুলোর পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক মনোনয়ন দেওয়ার সুপারিশও করে ইউজিসি।

জানা যায়, ২০১৫ সালে দেশের ৮৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গড়ে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা করে সর্বমোট আয় করে প্রায় দুই হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের তুলনায় এটা ছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বেশি। ফি বছরই এভাবে আয় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও উচ্চশিক্ষার মান সেভাবে বাড়ছে না। মঞ্জুরি কমিশন বলছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানই আশানুরূপ নয়।

এই যখন অবস্থা, শিক্ষার্থীরা তখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই জানতে পারছে বিশ্বকে, তুলনা করতে পারছে নিজেদের অবস্থানও। তারা দেখছে, দেশে স্বনামধন্য বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ যত প্রতিষ্ঠান আছে, তার একটিও আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য টাইমস হায়ার এডুকেশন-এর প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটিও নেই, এমনকি এশিয়ার শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও জায়গা পায়নি বাংলাদেশের কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এসব তথ্য নির্দেশ করে যে, কেন তরুণরা বিদেশের দিকে ঝুঁকছে। তারা মনে করছে, মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেশে একেবারেই সীমিত। সেক্ষেত্রে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আধুনিক ক্যাম্পাস ও মানসসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি দেশে ফিরলেও কর্মক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা মিলবে। কারণ বিদেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোর সনদ দেশে ইতিবাচক মূল্যায়ন পায়। এসব ভাবনাই লাখো শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী করছে। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনায় এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের দিক নির্দেশনা রয়েছে। প্রয়োজন তার যথাযথ প্রয়োগ ও আধুনিকায়ন।

লেখক: সাংবাদিক

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭