ইনসাইড পলিটিক্স

আহারে জনগণ!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 05/08/2018


Thumbnail

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে। এই শিক্ষার্থীরা স্কুলের, কলেজের। উত্তরায় বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। ঢাকায় শুরু আন্দোলনের। তারপর তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি খুবই সহজ-সরল এবং ন্যায়সংগত। তারা নিরাপদ সড়ক চায়। নির্বিঘ্নে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে যেতে চায়, আবার স্কুল থেকে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চায়। এই দাবিতে বৃষ্টিতে ভিজে তারা রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। আমার মনে হয় না, শিক্ষার্থীদের এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার মতো কেউ আছেন। আমার মতো সবাই বলবেন, শিক্ষার্থীরা সঠিক দাবি নিয়েই রাজপথে এসেছে। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উৎসাহীর অভাব নেই। তাদের উৎসাহের কারণ শুধু শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি নয়, এই অতি উৎসাহী মহল এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ওপর ভর করে অন্য কিছু হাসিল করতে চায়। সোজা কথায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়ার এক প্রাণান্ত চেষ্টা অনেকের। প্রশ্ন হলো, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে কি সরকার পতন করা যাবে?

আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ১০ বছর টানা ক্ষমতায়। টানা ক্ষমতায় থাকার যেমন স্বস্তি আছে, তেমন অস্বস্তিও আছে। স্বস্তির দিক হলো সময় নিয়ে, দীর্ঘ পরিকল্পনা করে কাজ করা যায়। যেমনটা আওয়ামী লীগ করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন তার বড় উদাহরণ। বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অর্থনীতিতে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও একটা ছন্দ এসেছে। আর অস্বস্তি হলো, টানা ক্ষমতায় থাকলে একটা অতিআত্মবিশ্বাস পেয়ে বসে। নিজেদের বড় ভাবার অহমিকা গ্রাস করে। চারপাশের সবাইকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ভাবার রোগ হয়। কোনো কিছুকে গুরুত্ব না দিয়ে, নিজেদের ভাবনাই একমাত্র সঠিক ভাবনা এমন এক প্রবল জেদ জ্বরে আক্রান্ত হন ক্ষমতাসীনরা। আওয়ামী লীগের একজন ছাড়া সবার দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকাজনিত উপসর্গ দৃশ্যমান। যিনি এই রোগে আক্রান্ত নন, তার নাম শেখ হাসিনা। আমরা গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণাত্মক বক্তব্যগুলো লুফে নিই, হেডলাইন করি। কিন্তু তার অনেক সতর্কতামূলক বক্তব্য আমরা উপেক্ষা করি। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতাদের ঢাকায় গণভবনে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন এক অভূতপূর্ব গুরুত্বপূর্ণ কথা। তার বক্তব্য ছিল এরকম ‘জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণের মন জয় করেই ভোটে জিততে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।’ কিন্তু মনোনয়নযুদ্ধ, নগদ প্রাপ্তি, নানামুখী বাণিজ্যের দুষ্টচক্রে এই মূল্যবান বক্তব্যটা আওয়ামী লীগের কজন হৃদয়ে ধারণ করেছেন তা নিয়ে আমার গভীর সংশয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী ক্ষমতাব্যাধিতে আক্রান্ত। এই ব্যাধিতে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। জনগণ তাদের কাছে হয় উপেক্ষিত। তাই হঠাৎ এমন আন্দোলন দেখে এদের কেউ কেউ আতঙ্কিত, কেউ উদ্বিগ্ন, কেউ শঙ্কিত। জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে এদের করণীয় অজানা। অথচ তারা যদি তাদের দলের সভাপতির কথা শুনে জনগণের সঙ্গে মিশে থাকত, তাহলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতা, এমপি, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগকে দেখা যেত। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। নিরাপদ সড়ক এখন জনগণের প্রাণের দাবি। কে চায় রাস্তায় দুর্ঘটনার নামে এমন হত্যাকাণ্ড দেখতে, কে চায় এমন মৃত্যুর মিছিল দেখতে? তাই জনগণের হৃদয় থেকে উৎসারিত সংগঠন আওয়ামী লীগেরই তো প্রথম উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। আওয়ামী লীগের এমপিরা তার এলাকায় ছাত্র অবস্থানে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি দিতে পারত। যুবলীগ কর্মসূচি শেষে বড় ভাই হিসেবে তাদের ঘরে ফেরার দায়িত্ব নিতে পারত। স্বেচ্ছাসেবক লীগ আন্দোলনে যেন জনমানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ না হয় সেজন্য সড়ক ব্যবস্থাপনা তদারকি করতে পারত। কিন্তু কেউ কিছু করেনি। কোনো এমপি ছাত্রছাত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারেননি আমি তোমাদের অভিভাবক। দু-একজন অবশ্য ব্যতিক্রম। যেমন নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমান। তিনি দেখালেন শেখ হাসিনার আদর্শ আসলে কী? আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে ঘরে ফেরালেন। শামীম ওসমান যে কাজটি করেছেন, তা সব এমপির অবশ্যপালনীয় ছিল। কিন্তু এমপি সাহেবরা অত্যন্ত ব্যস্ত। সরকারের মেয়াদের শেষ প্রান্তে তাদের নিজের পুত্র-কন্যাকে দেখারই সময় নেই, তারা কি দেখবেন এলাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের? জলাতঙ্ক রোগে যেমন মানুষ পানির ভয় পায়, তেমন ক্ষমতারোগে জনগণকে এড়িয়ে যান রাজনীতিবিদরা।

দীর্ঘ ক্ষমতা থাকাজনিত রোগের একটি বড় লক্ষণ হলো— কাণ্ডজ্ঞানহীন বিনোদন, দায়িত্বহীন উচ্চারণ। নিরাপদ সড়কের এই যৌক্তিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা রাজপথে এভাবে হয়তো অবস্থান নিত না, যদি না ওই অবান্তর হাসির উদ্ভব না হতো। অন্য অর্থে বলা যায়, এক হাসিই শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করেছে। যিনি ওই ক্লোজআপ হাসি হেসেছিলেন, এরপর তিনি ক্ষমা চেয়েছেন, নিহত দুই শিক্ষার্থীর বাড়িতেও গেছেন, কিন্তু ততক্ষণে জল বহুদূর গড়িয়েছে। গুলি একবার ছুড়লে তা কি আর ফেরত নেওয়া যায়? সর্বনাশা হাসির ছোবলে আজ জনজীবন বিপর্যস্ত। আহা জনগণ! মন্ত্রী হাসেন জনগণের কপাল পোড়ে। হাসির কারণে সৃষ্ট যৌক্তিক আন্দোলন রাজপথে প্রথম দুই দিন ছিল নেতৃত্বহীন স্বতঃস্ফূর্ত। এ দুই দিনে শিক্ষার্থীরা পাশে পায়নি জনপ্রতিনিধিদের, স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিকে। ফলে এমন একটা আন্দোলনের ঢাউস ফল খেতে কার না লোভ হয়? বিরোধী পক্ষ এবং সুশীলদের দীর্ঘদিনের খায়েশ সরকারকে একটা ল্যাং মেরে কাদায় ফেলা। তাই এতিম আন্দোলনে জনসহানুভূতি দেখে বিএনপি-জামায়াত ও সুশীলদের চোখ-মুখ চিকচিক করে উঠল। তারা তো আর নৌপরিবহনমন্ত্রীর মতো বোকা নন। খুশির উল্লাসে বাঁধভাঙা হাসি চেপে সরকার পতনের খোয়াবে বিভোর হলেন। শুরু হলো বোকা বাক্সে বকবকানির উৎসব। জনগণের নামে শুরু হলো জনঅত্যাচার।

সুশীলসমাজের দুই মুখপত্র দৈনিক (একটি বাংলা, একটি ইংরেজি) যেন পেয়ে গেল মোক্ষম অস্ত্র। আন্দোলনে উসকানি দিতে যা তথ্য-উপাত্ত লাগে তা বড় হরফে মুদ্রিত হতে লাগল। তিন দিন পর বিএনপি মহাসচিব জানালেন ‘আমরাও আছি’। বিএনপির অনেক নেতা তো গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাও দিয়ে দিলেন। জনগণকে থোড়াই কেয়ার। কিন্তু সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং একজন মানবিক রাষ্ট্রনায়ক। তিনি দ্রুত একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। নিহত দুই শিক্ষার্থী পরিবারের জন্য দিলেন আর্থিক অনুদান। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা দরকার। মৃত্যুশোক যে কী করুণ, বীভৎস ও বেদনাদায়ক তা শেখ হাসিনার চেয়ে কজনই বা বেশি বোঝেন। এই আগস্ট মাসেই এক মহাপ্রলয়ে তিনি একজন ছাড়া সব প্রিয়জনকে হারিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ব্যাপারে জনমনে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট। তিনি যা বলেন তা করেন। কথা দিলে তিনি কথা রাখেন। এজন্য তার প্রতি জনগণের আস্থা প্রবল। এমনকি তার প্রবল প্রতিপক্ষও তার নিষ্ঠা, কর্মতৎপরতা এবং দায়িত্বশীলতা নিয়ে আড়ালে-আবডালে বিস্ময় প্রকাশ করেন। কাজেই তিনি দ্রুত একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণের পর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের স্বস্তি এলো। শিক্ষার্থীরা এবার ঘরে ফিরবে। জনজীবন স্বাভাবিক চলবে। আবার কর্মচাঞ্চল্যে ভাসবে দেশ। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১০ বছরে আন্দোলন, ভাঙচুর, হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের সংস্কৃতি থেকে দেশকে মুক্তি দিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪-এর পর সহিংসতার রাজনীতি বনবাসে গেছে। হরতাল-অবরোধ মানুষ ভুলে গেছে। মানুষ এখন কাজ করতে চায়। তাই শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার জন্য উন্মুক্ত কর্মমুখর মানুষ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে। কে বা কারা নয় দফা অথবা সাত দফা দাবিও তৈরি করে ফেলেছে। ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে কোমলমতি শিশুদের আবেগকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অতঃপর ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব তুলে নিল। রাজপথে দাঁড়িয়ে তারা গাড়ির লাইসেন্স চেক করা শুরু করল। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, এই পথ ভুল পথ। এটা যৌক্তিক নয়। এই আন্দোলনে নাম ফলাতে অনেক সেলিব্রেটি বুঝে না বুঝে ‘অভিভূত’ হচ্ছেন, কেউ বা স্যালুট জানাচ্ছেন। কেউ বলছেন তারা আমাদের শিক্ষা দিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আবেগকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, একজন অভিভাবক হিসেবে আমি বলতে চাই, রাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন কিংবা গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের কাজ নয়। কাল যদি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেন, আমরা এখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেখব— তখন কী ফল দাঁড়াবে? কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয় যদি বলে, গণমাধ্যমে কী রিপোর্ট হয়, তার সোর্স কী এসব আমরা পরীক্ষা করব, তাহলে সেটি যে রকম ভয়াবহ ঘটনা হবে, এটিও তেমন এক ভয়াবহ তৎপরতা। আমি অবাক হয়ে যাই, যারা সুশাসনের কথা বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা বলে মুখে ফেনা ছড়ান, তারাই কোমলমতি শিশুদের এই পাকামিতে আশকারা দিচ্ছেন। ‘পুলিশবাহিনী’ একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের লাইসেন্স তল্লাশির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হচ্ছে। আমি খুশি হতাম যদি শিক্ষার্থীরা পুলিশবাহিনীকে দিয়ে কাজটা করাত। নিজে সরেজমিন ঘুরে দেখলাম, শিক্ষার্থীদের এসব পরীক্ষার জন্য তালিম দিচ্ছেন কিছু অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তি। এরা শিক্ষার্থী নন, এরা অভিভাবকও নন— এরা কারা? এরা হলো তারা, যারা সরকারকে ফেলে দিতে চায়। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে পরিবহন সংকটে জনগণের অবস্থা যে বেহাল তার খবর কে নেবে?

আমরা আজকাল প্রায়ই দেখি জঙ্গিরা শিশুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। শিশুদের সামনে রেখে, তাদের গায়ে বোমা লাগিয়ে জঙ্গিরা কুিসত, হিংস্র অপকর্ম করে। বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের নামে এমনকি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে একটি মহল। এই প্রশ্ন আমার মতো অনেকের। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্ত গণরায়ের মাধ্যমে এই সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। একটি নির্বাচিত সরকারকে হটানোর মাত্র দুটি স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রীতি রয়েছে। একটি হলো নির্বাচন, অন্যটি হলো জাতীয় সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব পাস। কিন্তু এ দুই পদ্ধতির বাইরে অন্য কোনো পদ্ধতিতে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা এক ঘৃণ্য রাষ্ট্রদ্রোহ। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, গত ১০ বছরে এই সরকারকে হটাতে তৃতীয় পক্ষের ওপর সওয়ার হওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রথম আমরা এটা দেখলাম, হেফাজতের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচির মাধ্যমে। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তো মিষ্টি বিতরণ করল এই আনন্দে যে সরকারের পতন ঘটছে। বেগম খালেদা জিয়া মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থানকারীদের ‘মেহমান’ হিসেবে সম্বোধন করে তাদের জন্য খাবার-দাবার নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়চিত্তের পদক্ষেপ বিএনপির স্বপ্নভঙ্গ ঘটায়। এরপর আসে হলি আর্টিজানের ঘটনা। অনেকে আশায় বুক বেঁধেছিল এবার হয়তো সরকারের পতন হবে। কিন্তু তাদের আশার গুড়ে বালি। সরকার টিকে গেল। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দিয়ে একটি সিভিল সোসাইটি ক্যু এর চেষ্টাও ভেস্তে গেছে। কিছু সুশীলের হৃদয় ভেঙে বিচারপতি সিনহা এখন দূরদেশে। আওয়ামী লীগেকে হটানোর আরেক চেষ্টার নাম ছিল কোটা আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রতিও আছে বিএনপি, জামায়াত ও সুশীলদের ত্রিমাত্রিক প্রেম। এই আন্দোলন যখন পথহারা হলো তখন এলো শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই আন্দোলন নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও সুশীলসমাজের বক্তব্যগুলো অভিন্ন, একই সূত্রে গাঁথা। তারা এই আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছে। এই চেষ্টায় তারা নিজেরাই বোধশূন্যহীন দানবে পরিণত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। পাঠকের বিবেচনার জন্য মাত্র একটি উদাহরণ বিনীতভাবে উপস্থাপন করছি। কদিন আগে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই সর্বাত্মক অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে প্রচুর মাদক ব্যবসায়ী মারা গেছে। এ সময় আমাদের সুশীলসমাজ রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিল। তারা বলেছিল, ‘এভাবে বিনা বিচারে কাউকে হত্যার অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি। একজন খুনিরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে।’ বাংলাদেশে সর্ববিষয়ে পণ্ডিত কিছু ব্যক্তির ‘মানবাধিকার গেল’ চিৎকারে কাকের তারস্বরও ম্লান হয়ে গিয়েছিল। এখন পাঠক লক্ষ্য করুন, কোমলমতি শিশুদের হাতে যে নয় দফা দাবিনামা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, (যেগুলো অধিকাংশ শিক্ষার্থী বলতে পারবে না) তার প্রথম দাবিই হলো বাসের চালকের অবিলম্বে মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ কোনো বিচার-আচার দরকার নেই। এক্ষুনি ওই চালককে ফাঁসি দিতে হবে। এটা কি তাহলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হবে না? তাহলে যারা এতদিন বলল, খুনিরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে, তারা নয় দফাকে অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি করে কোন নৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান থেকে? এই প্রশ্নটি বিবেকবান প্রতিটি মানুষের কাছে।

অর্থাৎ আসল উদ্দেশ্য নিরাপদ সড়ক নয়, আসল উদ্দেশ্য দেশে একটি অস্থির অবস্থা তৈরি করা। যে অস্থির অবস্থা সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করবে। এজন্য যখন যেখানে সুবিধা সেদিকেই ঝুঁকছে একশ্রেণির মানুষ। তারা মাদকবিরোধী অভিযানে সরকারকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করছে। আবার ড্রাইভারকে বিচার ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড দিতে বলছে।

আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে অস্থির এসব কিছু মানুষ। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারত। শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে চাইলেই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করা যায়। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে না গিয়ে বিএনপি-জামায়াত অন্যের ঘাড়ে চড়ে ফায়দা হাসিলের যে চেষ্টা করছে, তাতে তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকটভাবে উন্মোচিত হচ্ছে, প্রকাশ হচ্ছে তাদের জনবিচ্ছিন্নতা। তবে বিএনপি-জামায়াতের জন্য আমার কোনো দুঃখবোধ নেই। কারণ, বিএনপির রাজনীতির মূলকথাই হলো যে কোনো প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়া। তাই তারা অন্যের আন্দোলনের ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু আমার দুঃখ এবং করুণা হয় দেশের শিক্ষিত কয়েকজন মতলববাজ সুশীল বুদ্ধিজীবীর জন্য। যারা সমাজের বিবেক হিসেবে পরিচিত। তারা যখন শিশুদের জিম্মি করে তাদের মনোবাসনা পূরণ করতে চান, তখন লজ্জায় আমি সংকুচিত হয়ে যাই। যে জঙ্গিরা শিশুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের সঙ্গে আজ যারা এই আন্দোলনকে উসকে দেওয়ার জন্য নানা উত্তেজক বক্তব্য দিচ্ছেন নানা টকশোয়, কাগজে লিখছেন জ্বালাময়ী ভাষায়— পার্থক্য কী? দুই পক্ষই কি মানবতার, শান্তির শত্রু নয়? অনেকেই যে কথাটা প্রায়ই ভুলে যান, যে কথাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলেন তা হলো, ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’। জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণ ছাড়া শুধু ষড়যন্ত্র করে সরকার পতন ঘটানো যাবে না, যায় না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের রাজনৈতিক দল ও সমাজের জ্ঞানপাপীদের জনগণের ওপর আস্থাটাই নেই। জনগণের নামে যারা আমরা কথা বলছি, তারা সবাই জনগণকে জিম্মি করছি, জনগণকে দুর্ভোগে ফেলছি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কিংবা সরকার পতনের ষড়যন্ত্র যা কিছুর ভোগান্তির একমাত্র শিকার আমরা জনগণ। সব দেখে-শুনে তাই বলতে ইচ্ছা করে— ‘আহারে জনগণ!’


বাংলা ইনসাইডার/ডিকে

(লেখাটি আজকের বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭