ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের শেষ সপ্তাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 07/08/2018


Thumbnail

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোকের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।

এই শোকাবহ মাসে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য নিয়েছে বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কিছু স্মরণীয় লেখা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ থাকছে রহীম শাহ সম্পাদিত শাহরিয়ার ইকবাল এর ‘বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের শেষ সপ্তাহ’ শিরোনামে একটি লেখা। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে।

বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের শেষ সপ্তাহ

শাহরিয়ার ইকবাল

পৃথিবীতে মাঝে মাঝে এমন একেক জন ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়, যাঁদের দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বে সম্রাট অশোক, সম্রাট আকবর, কন্সটেইনটাইন, কামাল আতাতুর্ক, আহমদ শোয়েকার্ন, গামাল নাসের, লেনিন, মাও সেতুং, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কোনো না কোনো ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগান্ত সৃষ্টিকারী নেতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমরা আজকের আলোচনা, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই মহৎ হৃদয়ের মানুষটি বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তিনি বাঙালি জাতিকে তাঁর পরিচয় দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি জাতীয় পতাকা ও একটি সংবিধান উপহারের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি বন্দীশিবির থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের পুনর্গঠনে যখন তিনি ব্যস্ত, ঠিক সে সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতক কর্তৃক সপরিবারে নিহত হন।

প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতিরূপে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শাসনযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। জাতীয় জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল অনিবার্য। বাংলাদেশের জনজীবনের তিনি ছিলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালি জাতির অপরিসীম নির্ভরশীলতার পরিচয় বহন করে। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির সরকারি অবস্থান কেন্দ্র গণভবনে প্রতিদিন ভিড় জমাত বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শত শত মানুষ। কেউ তাঁর কাছে যেত সাহায্যের জন্য। কেউবা সামান্য অনুগ্রহ লাভের আশায়। মন্ত্রীরা যেতেন পরামর্শের জন্য, আমলারা নির্দেশ গ্রহণের জন্য। কখনো আবার বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎপ্রার্থী হতেন স্বীয় দেশের সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের কোনো শুভেচ্ছাবাণী নিয়ে। কখনো আবার বিদেশী মন্ত্রীরা আসতেন পরামর্শের জন্য।

একবার মধ্যরাতে রাষ্ট্রাচারের (প্রটোকলের) সকল নিয়ম ভঙ্গ করে মিসর ও আলজেরিয়ায় দুই রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার সাদাত ও হুয়ারি বুমেদিন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার জন্য পরামর্শ করা। আরও এসেছিলেন যুগোস্লাভিয়ার মহানায়ক জোসেফ ব্রজ টিটো। উদ্দেশ্য একই। এই নতুন দেশটির নেতা শেখ মুজিবকে একবার নিজ চোখে দেখা ও পরামর্শ করা এবং পরিশেষে সকল প্রকার সহায়তার আশ্বাস প্রদান। এমনি আরও অনেক নেতা এসেছিলেন সে সময়ের বাংলাদেশে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী গাউ হুইটলাম, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ দাউদ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোও লোভ সামলাতে না পেরে একদিন সদলবলে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর অতি সাধের মুসলিম বেঙ্গলের মাটিতে। উল্কার বেগে এসে ভুট্টো সাহেব দেখলেন তাঁর কল্পনার ‘মুসলিম বেঙ্গল’ সত্যি সত্যিই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। যার অবিসংবাদিত নেতা তাঁর সেই চির চেনা মুখ- শেখ মুজিব।

এহেন ব্যক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর তাই গণভবনে ছিল অসংখ্য লোকের ভিড়। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গে অবাধে দেখা করতেন। মানুষের ধারণা হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে রাষ্ট্রাচারের প্রয়োজনে গণভবনে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হলো। গণভবনের পশ্চিম গেটে কিছুটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা হলো। তখনও এসএমসএফ-এর জন্ম হয়নি।

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হত। বঙ্গবন্ধুর কাছে দিনের কোনো একসময় সেই তালিকা উপস্থাপন করা হত। তালিকাটি তাঁর অনুমোদন লাভের পর সাক্ষাৎপ্রার্থীর প্রয়োজনের গুরুত্ব অনুযায়ী সাক্ষাতের তারিখ ও সময় দেওয়া হত। আজ এ কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রত্যেক সাক্ষাৎপ্রার্থীর নাম পড়ে শোনানোর সময় তাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করেও সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিয়ে দিতেন। সমগ্র বাংলাদেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তের মানুষ দর্শনপ্রার্থী হতেন। তিনি তাদের অধিকাংশের নাম জানতেন। এমন স্মৃতিশক্তি পৃথিবীর খুব কম মানুষের থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী তাঁর সামনে আসার পর তিনি তার বাবা মা ভাইয়ের কথা তাকে বলতেন এবং তাকে জানাতেন ৮/৯বছর আগে তিনি তাদের গ্রামে সাংগঠনিক সফরে গিয়েছিলেন এবং সেই গ্রামের কোনো ব্যক্তি তাকে ক্লান্ত অবস্থায় প্রাণের উষ্ণতা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এ কথা শোনার পর অনেক দর্শনপ্রার্থী অভিভূত হয়ে যেতেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন নানা সমস্যা ও সীমিত সম্পদ। কিন্তু তার মাঝেও গণভবনে যে সকল নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতেন। যে সকল কর্মকর্তা সে সময় গণভবনে কর্মরত ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, সর্বজনাব এইচ টি ইমাম, ড. আবদুস সাত্তার, আবদুর রহিম, মনোয়ারুল ইসলাম, কর্নেল জামিল, মশিউর রহমান, ড. ফরাসউদ্দিন, সৈয়দ রেজাউল হায়াৎ, ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ, ড. ফজলুল হাসান ইউসুফ, আবদুল করিম, নূরুল ইসলাম, আবদুল তোয়াব খান, আবদুল মালেক, মকবুল হোসেন, মাহফুজুস সোবহান, সৈয়দ আমিনুর রহমান এবং আরও অনেকে।

বঙ্গবন্ধু সরকারি বাসভবনে বাস করতেন না। তিনি নিজ বাসস্থান হতে গণভবনে আসতেন প্রতিদিন সকাল ৯টায়। সকালে একটি ছোট অথচ সুসজ্জিত হাউজ গার্ডদল তাকে অভ্যর্থনা জানাতো। সে সময় গণভবনের পিছনের প্রশস্ত দরজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী উপরে যেতেন। তারপর সেই দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হত। হাউজ গার্ডদের অভিবাদন গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী দোতলায় তাঁর অফিসে কাজ আরম্ভ করতেন। সে সময় প্রায় প্রতিদিন সকালে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দিন আহমদ। অতঃপর আসতেন ডিআইজি স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এরপর আরম্ভ হত দিনের কাজ। তাঁর জীবনের শেষ সপ্তাহের দৈনিক কর্মসূচি থেকে তাঁর দৈনিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব হবে।

১. বৃহস্পতিবার ৭ আগস্ট ১৯৭৫/২১ শ্রাবণ ১৩৮২, ২৮ রজব ১৩৯৫ সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫.৩০ মিনিটে ও সেইদিন সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩৮ মিনিটে। ঐদিন রাষ্ট্রপতির কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:

সকাল ৯.৩০টা এটিনি সতার, সু্ইজারল্যান্ডের মাননীয় রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পরিচয়পত্র পেশ।

সকাল ১০.৩০ টা মাননীয় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী।

সকাল ১১ টা মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

দুপুর ১২ টা মাননীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।

বিকেল ৫.৩০ টা শ্রী সমর সেন, ভারতের মাননীয় হাইকমিশনার।

সন্ধ্যা ৬.১০ টা জনাব কাজী মোজাম্মেল হক, এমপি।

১.৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি প্রতিদিন গণভবন কমপ্লেক্সের বাসভবনে যেতেন। সেখানে স্নানের পর দুপুরের আহার করতেন। এ সময় ব্যক্তিগত বাসস্থান হতে তাঁর দুপুরের খাবার পাঠানো হত। দুপুরের আহার ছিল অতি সাধারণ। তিনি কই মাছ অধিক পছন্দ করতেন দুপুরে। আহারের পর কিছুটা বিশ্রাম নিতেন। এ সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করতেন। তাদের বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মধ্য দিয়ে তিনি দেশের হালহকিকত সম্পর্কেও একটি স্বচ্ছ ধারণা পেতেন। বিকেল ৪টায় তিনি হাঁটতেন গণভবন প্রাঙ্গনে। এরপর লেকের ধারে যে ঘাট ছিল সেখানে বড় কালো চেয়ারগুলোর একটিতে তিনি বসতেন। এ সময় গণভবন লেকে প্রচুর মাছ ছাড়া হয়েছিল। মাছকে খাবার দেওয়া হতো। কখনো তিনি নিজ হাতে মাছের খাবার ছিটিয়ে দিতেন। সিঁডির কাছে মাছের ভিড় জমত। এরূপ মাছের খেলা দেখতে বঙ্গবন্ধু অদ্ভুত আনন্দ পেতেন। বিকেলে এই লেকেরে ধারে কোনো কোনো সময় মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা আসতেন। এ সময়টায় যেহেতু বঙ্গবন্ধু অনেকটা রিল্যাক্সড মুডে থাকতেন, সেজন্য অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেই অনির্ধারিতভাবে আসতেন তাঁর সঙ্গে নানা রাষ্ট্রীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান ও আবদুর রব সেরনিয়াবাত মাঝে মাঝে এ সময় আসতেন তাঁর সঙ্গে নানা রাষ্ট্রীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু সাধারণত রাত ৯টা পর্যন্ত গণভবনে থাকতেন। অতঃপর কোনো পূর্বনির্দিষ্ট সাক্ষাৎপ্রার্থী না থাকলে ব্যক্তিগত বাসস্থানে যেতেন। সে সময় প্রতি সোমবার বিটিভিতে একটি বাংলা ছায়াছবি দেখানো হত। তখন এ দেশে ভিসিআর আসেনি। সেজন্য সোমবারের বাংলা ছায়াছবিটি দর্শকেরা আগ্রহভরে দেখতেন। গণভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন ঐ ছবিটি দেখার সুযোগ পান সেজন্য বঙ্গবন্ধু সোমবার ৮টার আগেই বাসায় চলে যেতেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েও একটি ছোট নীল রঙের টয়োটা গাড়ি ব্যবহার করতেন জ্বালানি তেলের সাশ্রয়ের জন্য। এই ছোট গাড়িটি বিমানের ট্রান্সপোর্ট পুল হতে সংগ্রহ করা হয়েছিল।

২. ৮ আগস্ট ১৯৭৫/২২ শ্রাবণ ১৩৮২/২৯ রজব ১৩৯৫ ছিল শুক্রবার।

সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ০৫.৩০ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩৮ মিনিটে। দিনের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ :

সকাল ১০-০০টা প্রথম ও দ্বিতীয় কর্মকমিশনের চেয়ারম্যানদ্বয়। সকাল ১০-৩০টা মাননীয় রেলওয়ে প্রতিমন্ত্রী। সকাল ১১-৩০টা মাননীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী। বিকেল ৫-৩০টা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান।

আমার যতদূর মনে পড়ে, সেদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার শেষ বন্দর, নৌ ও জাহাজ চলাচলমন্ত্রী ছিলেন।

উল্লেখ্য, দিনের কর্মসূচিতে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব আসতেন। তারা একান্ত সচিবদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতির কর্মব্যস্ততা সম্পর্কে জেনে নেওয়ার পরই কোনো জরুরি নথি নিয়ে আসতেন। ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ ছিলেন উপসচিব (নথি)। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যে নথিগুলো রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্যে আসত সেগুলো ড. সামাদ রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর ও নির্দেশের জন্য উপস্থাপন করতেন।

৩. শনিবার ৯ আগস্ট ১৯৭৫/২৩ শ্রাবণ ১৩৮২, ৩০ রজব ১৩৯৫। সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ০৫.৩২ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩৫ মিনিটে। এদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন:

সকাল ১০-০০টা ড. স্যামস্টিট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধি।

সকাল ১১-০০টা প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধান।

বিকেল ৬-০০টা জনাব জিল্লুর রহমান, এমপি, বাকশালের সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং অন্যান্য।

সন্ধ্যা ৬-১৫ মি. এটর্নি জেনারেল।

৪. সোমবার ১১ আগস্ট ১৯৭৫/২৫ শ্রাবণ ১৩৮২, ২ শাবান ১৩৯৫। সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ০৫:৩২ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩৬ মিনিটে।

সকাল ১১-৩০টা জনাব গিয়াস উদ্দীন সাক্ষাৎ করেছিলেন।

বিকেল ৬-৩০ জনাব আযহারুল ইসলাম, দ্বিতীয় কর্মকমিশন।

৫. মঙ্গলবার ১২ আগস্ট ১৯৭৫/২৬ শ্রাবণ ১৩৮২, ৩ শাবান ১৩৯৫। সূর্যোদয় হয়েছিল ০৫.৩২ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩৫ মিনিটে। সেদিন সাক্ষাৎপ্রার্থী খুব কম ছিল।

সকাল ১০.০০ টায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী।

বিকেল ৬-০০ টায় এ এফ এ হোসেন, কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট।

৬. বুধবার ১৩ আগস্ট ১৯৭৫/২৭ শ্রাবণ ১৩৮২, ৪ শাবান ১৩৯৫। সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ৫.৩৩ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩১ মিনিটে । দিনের কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপঃ

সকাল ১১-০০টা জনাব এম আর সিদ্দিকী, যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত।

বিকেল ৬-০০ টা জনাব মওদুদ আহমদ বার এ্যাট-ল`।

বিকেল ৬-৩০ টা জনাব এম.এ. রব (চাঁদপুর)

৭. বৃহস্পতিবার ১৪ আগস্ট ১৯৭৫/২৮ শ্রাবণ ১৩৮২, ৫ শাবান ১৩৯৫। সূর্যোদয় হয়েছিল সকাল ০৫.৩৩ মিনিটে ও সূর্যাস্ত হয়েছিল সন্ধ্যা ১৮.৩১ মিনিটে। এদিনের কর্মসূচিতে দেখা যায় তিনি বেশ ব্যস্ত ছিলেন। কর্মসূচিতে ছিল।

সকাল ৯.৪৫ মি. প্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার (দক্ষিণ কোরিয়া) মহামান্য রাষ্ট্রপতি পার্ক চুং হির মাননীয় বিশেষ দূত।

সকাল ১০-০০ টা নৌবাহিনী প্রধান।

সকাল ১০-৩০ টা মাননীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী।

১১-০০টা মাননীয় প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও বিমানবাহিনী প্রধান।

১১-৩০টা জনাব আতাউর রহমান খানের দুই কন্যা।

বিকেল ৫-৪৫ টা মাননীয় উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিকেল ৬-০০ টা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু সকাল ১১টায় আমাকে বলেন যে, জনাব আতাউর রহমান খান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছেন। তিনি কেমন আছেন জানার জন্য তার কন্যাদের যেন আসতে অনুরোধ করা হয়। আমি টেলিফোনে জনাব আতাউর রহমান খানের বাসায় যোগাযোগ করি। তার দুই কন্যা বেলা ১১-৩০টায় রাষ্ট্রপতির কক্ষে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু নিজ কন্যার মতোই তাদের সঙ্গে সস্নেহে কথা বলেন এবং তাদের বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেন । এদিন বঙ্গবন্ধুকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিল। কিন্তু তথাপি তিনি জনাব আতাউর রহমান খানের কন্যাদের সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বলেছিলেন।

এই দিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু যখন লেকের ধারে বসেছিলেন এবং মাছের জন্য খাবার ছড়ানো হচ্ছিল, সে সময় (প্রায় ৪টা) অনির্ধারিতভাবে এসে উপস্থিত হলেন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর । তাকে একটি চেয়ারে বসতে বলেন বঙ্গবন্ধু এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় বালক রাসেল লেকে সাঁতার শিখছিল। কিছুক্ষণ পর রাসেল ভেজা কাপড়ে এসে দাঁড়াল। তার সঙ্গে ছিলেন সাঁতার প্রশিক্ষক একজন নায়েব সুবাদার। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে বলেন যে, ইনি তোমাকে সাঁতার শেখাচ্ছেন, সেজন্য তাকে তোমার কিছু উপকার দেওয়া উচিত। কিছুক্ষণ পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রস্থান করেন এবং শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোকাম্মেল হক আসেন। পরের দিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা । শিক্ষা সচিব বঙ্গবন্ধুকে একটি মানপত্র দেখান। এটি পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর সম্মানে পাঠ করবে। কিছুক্ষণ পর পানিসম্পদ-মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতও এসেছিলেন। পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অভ্যর্থনা দেওয়ার সময় যে সকল বক্তৃতা হবে সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী।

এ সময় রাষ্ট্রপতির অত্যন্ত স্নেহভাজন দুজন কর্মকর্তা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছিলেন। এরা হলেন মনোয়ারুল ইসলাম ও ফরাসউদ্দিন। তাঁদের সম্মানে সেদিন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের কর্মকর্তারা একটি নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু রাত প্রায় ৮টার সময় বাসায় চলে গেলেন। যাওয়ার সময় একান্ত সচিব রেজাউল হায়াৎ ও আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, ১৫ আগস্ট সকালে আমরা যেন তাঁর বাসস্থানে সরাসরি যাই। সেখান থেকে তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে আমাদের। এদিন আমরা গণভবনে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা অনেক রাত পর্যন্ত নৈশভোজের আনন্দ উপভোগ করেছিলাম। আমরা রাত প্রায় ১১টায় গণভবন ত্যাগ করি । পরে শুনেছি, সেদিন রাতে গণভবনের সামনের লেক এভিনিউতে অন্ধকারে বসে মেজর (পরে লে. কর্নেল অব.) আবদুর রশিদ। তিনি ভাবছিলেন কেন এই কর্মকর্তারা গণভবন থেকে বেরুচ্ছে না। আমরা সবাই রাত ১১টায় নিজ নিজ বাসস্থানে যাওয়ার পর কর্নেল (অব.) রশিদ নিশ্চিত হয়ে তার দোসরদের জানিয়েছিলেন গণভবনের কর্মকর্তারা বাসায় ফিরেছে।

আমি এ সময় সোবহানবাগ মসজিদের উল্টো দিকে সরকারি কোয়ার্টারে একটি ফ্লাটে থাকতাম।

১৫ আগস্ট শুক্রবার সকালে প্রায় পৌনে ৫টায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার ফ্লাটের বারান্দায় গিয়ে দেখি রাস্তায় (মিরপুর সড়ক) দুটো সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে মসজিদের সামনে। এ সময় আমি একটি টেলিফোন পাই । অপরপ্রান্ত থেকে কর্নেল জামিল আমাকে জিজ্ঞাসা করেন মসজিদের সামনে তুমি কী দেখছ। আমি বেশ ভীত হয়ে বলি, জামিল ভাই, আমি মসজিদের সামনে ট্যাঙ্ক দেখছি। আমার ভাল মনে হচ্ছে না। আপনি জেনারেল শফিউল্লাহকে বলুন। (কর্নেল) জামিল ভাই তখনই ফোন রেখে দিলেন। এর পাঁচ মিনিট পর আমি ফরাসউদ্দিনের ফোন পাই। তিনি জানতে চান, জামিল ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন কিনা এবং কী কথা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর (কর্নেল) জামিল ভাই তার লাল রঙের প্রিন্স গাড়িটি নিজেই চালিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনে ৩২ নম্বরের দিকে গেছেন। ফোন রাখার পরই আমি আবার বারান্দায় গিয়ে দেখি জামিল ভাইয়ের লাল প্রিন্স গাড়িটি সোবহানবাগ মসজিদের সামনে থামিয়েছেন সবুজ বেরেট পরা একজন অফিসার। পরে জানতে পেরেছিলাম এই অফিসারই সেই মেজর নূর।

[রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ৭২ থেকে ৭৮)]

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭