ইনসাইড আর্টিকেল

নারীর অনুপ্রেরণা বঙ্গমাতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/08/2018


Thumbnail

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছিলেন – ‘কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/ প্রেরণা দিয়াছে ,শক্তি দিয়াছে, বিজয় লক্ষী নারী।’ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে এই বিজয় লক্ষী নারীটি ছিলেন তাঁর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। জাতির পিতার স্ত্রী হিসেবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রাখার কারণে বেগম মুজিবকে ‘বঙ্গমাতা’ উপাধি দেওয়া হয়। আজ সেই বঙ্গমাতার জন্মদিন।

বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ফুলের মতো গায়ের রঙ দেখে তাঁর ডাক নাম হয় রেণু। ১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিয়ে হয় বেগম মুজিবের। এরপর থেকেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার যোগ্য সহধর্মিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন তিনি। বঙ্গমাতার জীবন ও কর্ম আজও বাঙালি নারীর অনুপ্রেরণায় ভাস্বর হয়ে আছে।

বেগম মুজিব ছিলেন চিরায়ত বাঙালি নারীর মতোই সহজ-সরল ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী। কিন্তু কোমল, মমতাময়ী রূপের বাইরেও বেগম মুজিবের আরেকটি রূপ ছিল। সে রূপ ছিল কঠিন, সাহসী, দৃঢ় এবং ধৈর্যশীল। বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় নিজের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে বেগম মুজিবের অবদানের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন।

জীবনের বিরাট একটি সময় বঙ্গবন্ধু জেলে কাটিয়েছেন। অন্য সন্তানেরা বিষয়টির গাম্ভীর্য বুঝলেও কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল বুঝতে পারতেন না যে, বাবা জেলে বন্দী। শিশু রাসেল বাবাকে জেলে দেখতে আসলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইতো। কিন্তু একবার বঙ্গবন্ধু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন রাসেল আর তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে না। এমনকি তাঁকে বাবা বলেও ডাকছে না। বরং মা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের গলা জড়িয়ে তাঁকেই বাবা, বাবা ডাকছে রাসেল। সত্যিকার অর্থেই বেগম মুজিব স্বামীর অবর্তমানে ছেলেমেয়েদের মা ও বাবা উভয়ের ভূমিকাই পালন করেছেন। বেগম মুজিব এই নিয়ে স্বামীকে কখনো অভিযোগও করেননি। তাই তো ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ এমনকি বঙ্গবন্ধু নিজের আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন স্ত্রীর কিনে দেওয়া খাতাতেই। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেগম মুজিবের সরল জীবন যাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফর করেন। এই সফরের সময় বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব স্বামী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের রহমানের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানের মঞ্চে দেখা গেল, বেগম মুজিব এক হাতে কাতান শাড়ি সামলাচ্ছেন, অন্য হাতে পানের বাটা ধরে আছেন। তাই দেখে বঙ্গবন্ধু মৃদুস্বরে ধমকে উঠলেন, `ওটা আবার নিয়ে আসলা ক্যান?`

এমনই ছিল বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ব্যক্তিত্ব। এক সহজ-সরল বাঙালি নারী ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রনায়কের স্ত্রী হওয়ার পরও কোনো অহংকার তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি।

সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে মানুষ করবার গুরুদায়িত্বটি সামলেছিলেন বঙ্গমাতা। এই কাজের জন্য তাঁর যত প্রশংসা করা হবে তা কম হবে। এছাড়া নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করা, অতিথি আপ্যায়ন করার মতো আদর্শ বাঙালি ঘরণীর কাজগুলোও আজীবন দক্ষ হাতে সামলেছিলেন বেগম মুজিব।

শুধু সংসারই নয়, সংগঠনও তিনি সামলেছেন দুর্দান্ত দক্ষতায়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তিনি নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। দলের প্রয়োজনে নিজ হাতের বালাও খুলে দিয়েছেন বেগম মুজিব। রেখেছিলেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা। সেই উত্তাল সময়ে তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এছাড়া নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাদিও দিতেন বেগম মুজিব।

শুধু নেতাকর্মীরাই নয়, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবের পরামর্শে অনেকবার উপকৃত হয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে। ঠিক তখনই আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে আমন্ত্রন জানান। অনেক ডাকসাইটে নেতাও বঙ্গবন্ধুকে এই বৈঠকে অংশ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এই বৈঠকে অংশ নিতে হলে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোর যেতে হতো। বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিলেন বৈঠকে অংশ না নিতে। বঙ্গবন্ধুও সেই পরামর্শ গ্রহণ করেন। সহধর্মিনীর পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত জনরোষ জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে এবং আইয়ুব ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট নীতিতে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম মুজিবের স্বামী পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল যুদ্ধের ময়দানে। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা গর্ভবতী অবস্থায় গৃহবন্দী। এমন অবস্থায়ও ধৈর্য্যহারা হননি তিনি। যখনই ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িতে কেউ সাহায্যের জন্য এসেছে তিনি তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন।

বেগম মুজিব জীবনে অনেকবার শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে বীরাঙ্গনাদের নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করার কাজও করেছেন তিনি। আর এসব কাজ সরকারি সাহায্য ছাড়াই ব্যক্তিগত উদ্যোগে করতেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী।

আজকের দিনের কিশোরী-তরুণীরা সর্বক্ষণ প্রচারের আলোয় থাকতে ভালোবাসেন। অনেকে আবার ফেসবুক লাইভে এসে দেশে নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ‘তারকা’ হওয়ারও চেষ্টা করেন। কিন্তু দেশের কাজ করার জন্য তারকা হতে হয় না এর একটি জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ ছিলেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী প্রচারের আলোয় কখনোই তেমনভাবে ছিলেন না, আসতেও চাননি কখনো। অথচ আড়ালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে গেছেন প্রেরণা, উৎসাহ ও পরামর্শ।

আমাদের মায়েদের কেমন হওয়া উচিত তার একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। স্বামী জেলে; এমন অবস্থায় তিনি সংসার সামলেছেন, সংগঠন সামলেছেন, স্বামীকে উপদেশ দিয়েছেন। একজন নারী যে একই সঙ্গে অনেক কাজ করতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বেগম মুজিব। বাঙালি নারীদের নিয়ে সেই প্রবাদ – ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ এর সত্যতা প্রমাণ করেছেন তিনি। কঠোরে-কোমলে, বুদ্ধিতে-আবেগে অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব আজও বাঙালি নারীর আদর্শ হিসেবে বারবার আমাদের সামনে প্রতীয়মান হন।


বাংলা ইনসাইডার/এসএইচটি/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭