ইনসাইড আর্টিকেল

লন্ডনে মুজিব হত্যার সংবাদ কীভাবে পৌঁছাল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/08/2018


Thumbnail

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোকের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।

এই শোকাবহ মাসে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য নিয়েছে বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কিছু স্মরণীয় লেখা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ থাকছে এম আর আখতার মুকুল এর ‘লন্ডনে মুজিব হত্যার সংবাদ কীভাবে পৌঁছাল’ শিরোনামে একটি লেখা। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে। 

লন্ডনে মুজিব হত্যার সংবাদ কীভাবে পৌঁছাল

এম আর আখতার মুকুল

সিংহ রাশিতে জন্ম আমার। তাই সমগ্র জীবনটাই হোচ্ছে শুধু উত্থান-পতন। কখনই এক নাগাড়ে বেশিদিন সুখ আমার সহ্য হয় না। এই লন্ডন মহানগরীতে এর ব্যতিক্রম হলো না। মাত্র বছর খানেক আগেও আমি ছিলাম বাংলাদেশ হাই কমিশনের একজন কূটনীতিবিদ। তখন আমার বাসা ছিল লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা `হ্যামস্টেড`-এ। কার্যোপলক্ষ্যে প্রতিনিয়তই আমার যাতায়াত ছিল ব্রিটিশ ফরেন অফিস, কমনওয়েলথ সচিবালয়, বুশ হাউস-এর বি বি সি, আর ফ্রিট স্ট্রিট-এর সংবাদপত্র অফিসগুলোতে। সন্ধ্যার পর পার্টি ও নৈশভোজের আমন্ত্রণ না থাকালে প্লে-বয় কিংবা ভিক্টোরিয়া ক্লাবে আমার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। মাঝে-মধ্যে নাটক দেখার বাতিক ছিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ‘উইক-এন্ড’ কাটাবার জন্য সপরিবারে গাড়িতে চলে যেতাম লন্ডনের বাইরে।

হঠাৎ করেই আমার জীবনের ছন্দ পতন হল। স্বল্পকালের ব্যবধানে এখন আমি পূর্ব লন্ডনের সর্ড-উইচ হাই স্ট্রিট-এর এক বিরাট চামড়ার কারখানার একজন সাধারণ শ্রমিক। ফ্যাক্টরির নাম একজি ফ্যাশানস। মালিক হচ্ছেন সিলেটের জনৈক বঙ্গ সন্তান। এখানে আমার কাজ প্রতিদিন সকালে পাঁচ তলা থেকে কাঁধে করে। চামড়ার গাড়ি চার তলায় নামিয়ে সেগুলোকে অর্ডার মোতাবেক কাটিং করা । কখনও ‘বোমা জ্যাকেট` কখনও বা মেয়েদের ওভারকোট। কাজে কোনো ফাঁকি দিলে নিজেরই আর্থিক ক্ষতি। কারণ এখানে কাজ হচ্ছে পিস ওয়ার্ক পদ্ধতিতে । অর্থাৎ যে শ্রমিক যত বেশি কাজ করবে, তার তত বেশি কামাই হবে। এক কথায় বলতে গেলে ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ । তাহলে তো গোড়া থেকেই কথাগুলো গুছিয়ে বলতে হয়।

সেদিনের তারিখটা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। আমি তখন লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশনে প্রেস কাউন্সিলারের দায়িত্বে। সকালে গার্ডিয়ান কাগজে একটি ডবল কলাম বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠলাম। বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘বাংলাদেশের ডিকটেটরকে সরিয়ে (‘রিমুভ`) ফেলতে সাহায্য করুন। বিজ্ঞাপনদাতা হিসাবে যে সংস্থায় নাম ছাপা হয়েছে, সেই নামের কোনো সংস্থ অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। সকাল থেকেই মনটা খুব অস্থির হয়ে রইল।

কিন্তু হাই কমিশনে কারো সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করতে সাহস হলো না। প্রথমেই হাই কমিশনার শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবদুস সুলতানের কথা। এ সময় স্থানীয় বিখ্যাত ‘রিজেন্ট পার্কে মূলত সৌদি সরকারের টাকায় একটি মসজিদ তৈরি হচ্ছিল। লন্ডনে মুসলিম দেশগুলোর সমস্ত রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনাররা এই মসজিদ কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের হাই কমিশনারও এই কমিটিতে ছিলেন একজন সিনিয়র মেম্বার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে অন্যান্যদের মতো তারও উৎসাহের ভাটা পড়ল। ফলে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আমাকেই মসজিদ কমিটির পরবর্তী বৈঠকগুলোতে যোগ দিতে হল। কিন্তু প্রথম দিনের বৈঠকে যাওয়ার আগে মাননীয় হাই কমিশনার আমাকে এ মর্মে ব্রিফিং দিলেন যে, ‘বেশি কিছু মাতবেন না। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মিয়া মমতাজ দৌলতানা যে লাইনে কথা বলবেন, আপনিও সেই মোতাবেক কথা বলবেন এবং ভোট দিবেন।’

আমি কিন্তু এ ধরনের ব্রিফিং-এ হতবাক হয়নি। মুহূর্তে আমার মনে পড়ল অখণ্ড পাকিস্তানি জামানার কথা। দুর্দান্ত প্রতাপশালী স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল (অব)। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের সময় মরহুম আবুল হাশিমের পরামর্শে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ধকল এড়িয়ে পুরনো মুসলিম লীগ দলটাকেই দখল করে বসেন। পদ্ধতিটা ছিল খুবই অভিনব। পশ্চিম পাকিস্তানের হোমড়া-চোমড়া মুসলিম লীগাররা ছাড়াও চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, ময়মনসিংহের মোনেম খা, রংপুরের আবুল কাশেম, খুলনার খান এ. সবুর প্রমুখের মতো পাকিস্তানের যেসব মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সামরিক জান্তাকে সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করেছিল, আইয়ুব খান তাদের দিয়ে করাচির ক্লিফটন বিচ-এ মুসলিম লীগের এক বিরাট কনভেনশন আহবান করিয়ে নিজেই পার্টি দখল করে বসলেন। এ থেকেই আইয়ুব খানের মুসলিম লীগের নামকরণ হল ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’।

পাকিস্তান মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অনতিবিলম্বে পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করে দলকে পুনর্গঠিত করলেন। সংবাদপত্রের ভাষায় এই পুর্নগঠিত উপ-দলের নামকরণ হল ‘কাউন্সিল মুসলিম লীগ`। এই কাউন্সিল লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল পাঞ্জাবি নেতা মিয়া মমতাজ। দৌলতানা আর অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ময়মনসিংহের সৈয়দ আবদুস সুলতান। সৈয়দ সাহেব আইয়ুব-বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সময় মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিলেন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ টিকিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সীমান্ত অতিক্রম করলেন।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ভদ্রলোক আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না । ময়মনসিংহ জেলার আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতিতে সৈয়দ সাহেবের স্থান হল না। সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনোরঞ্জন ধর, জিল্লুর রহমান, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, ডা. আজিজুর রহমান মল্লিক এবং আবদুল মোমেন প্রমুখের পর `নব্য আওয়ামী লীগের’ সৈয়দ আবদুস সুলতানকে ময়মনসিংহ জেলার (সদর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ) কোটায় মন্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করার প্রশ্নই উঠল না।

নিয়তির পরিহাসই বলতে হয়। আলোচ্য ঘটনা প্রবাহের জের হিসাবে লন্ডনে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনার হলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান। আবার কিছুদিনের ব্যবধানে খণ্ডিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন সেই-ই মিয়া মমতাজ দৌলতানা। এখন দু’জন হচ্ছেন দুই দেশের নাগরিক। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক?

তাই গার্ডিয়ান` পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে মাননীয় হাই কমিশনারের সঙ্গে কোনো আলাপই করলাম না। এরপর ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব ফারুক চৌধুরীর কথা। সিলেটের এক খান্দানি বংশের সন্তান ফারুক সাহেব উচ্চ শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। যদিও ১৯৭২ সালে লন্ডনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পেটে অপারেশনের সময় এই চৌধুরী সাহেব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কষ্টের কথা চিন্তা করে হাসপাতালের করিডোরে নিজেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।` তবুও একথা উল্লেখ করতে হয় যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভদ্রলোক ঢাকায় পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বহাল তবিয়তেই কাজ করে গেছেন। তাই বলতে বাধা নেই যে, আমি জনাব ফারুক চৌধুরীকে একজন সহকর্মীরূপে পছন্দ করলেও কোনো সময় একান্ত আপনজন হিসাবে গ্রহণ করতে পারিনি।

সবশেষে হাই কমিশনের গোয়েন্দা প্রধান জনাব নূরুল মোমেন খান মিহির । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি যখন বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক, তখন জনাব খান জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার । (এন এস আই) প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নেতৃবন্দের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। আবার দুজনে একই সঙ্গে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকশিনে। তখন আমাদের মধ্যে চমৎকার সমঝোতা। সপ্তাহের প্রতি সন্ধ্যায় অবসর মুহূর্তে আমরা দুজন একই সঙ্গে। একেবারে মানিকজোড়। সমস্ত রাত্রির প্রাইভেট পার্টি থেকে শুরু করে ম্যাকলিয়ড রোডের ভিক্টোরিয়া ক্লাব পর্যন্ত দুজনার একই সঙ্গে যাতায়াত। খান সাহেবের নতুন গাড়ি ‘অডি-৮০’ আর আমার নতুন জাপানি ‘ডাটসন-১৬০০` নিয়ে আম সমস্ত লন্ডন একেবারে চষে ফেললাম। কখনো উত্তর লন্ডনে শেফিক তালেয়ার বাসায় আডডায়। কখনো কর্পোরেশনের সীমানা ছাড়িয়ে মেথুয়েন রোডে গাফফার চৌধুরীর বাড়িতে, আবার কখনো বা পশ্চিম লন্ডনের শেফার্ড বুশ-এ গাউস ‘এলাহাবাদ রেস্টুরেন্টে’।

এসবের পরেও একটি `কিন্তু` থেকে গেল। ১৯৭৫ সালের মাঝামারি, বাংলাদেশে `বাকশাল` গঠনের প্রাক্কালে দুজনের চিন্তারাজ্যে বেশ কিছুটা ফারাক হয়ে গেল। ‘বাকশাল` গঠনের ব্যাপারে আমার মনে তখনো নানা প্রশ্ন। মানসিক দ্বন্দ্বে আমি জর্জরিত। বাকশালের বিপক্ষে কিছু না বললেও, প্রকাশ্যে বাকশাল কে সমর্থনের জন্য সেচ্ছায় এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হলাম । তাই, সত্যি কথা বলতে হলে, ১৪ আগস্ট সকালে অফিসে যেয়েও ‘গার্ডিয়ান` পত্রিকায় এই বিশেষ বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে নুরুল মোমেন খান-এর সঙ্গে কোনো আলাপই করলাম না।

একমাত্র হাই কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও হিসাব রক্ষণ বিভাগের প্রধান এবং আমার একান্ত সুহৃদ লুৎফুল মতিন-এর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনায় আগ্রহী হলাম। ভদ্রলোক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি মিশন থেকে ডিফেক্ট করে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। এ সময় তাঁর সহকর্মী ছিলেন পি আই এ-র ইস্তাম্বুল অফিস থেকে ‘ডিফেক্ট` করা। জনসংযোগ অফিসার মহিউদ্দীন আহম্মদ চৌধুরী।

সে যাই হোক। আলোচ্য দিন সকালে লুৎফুল মতিনকে তার অফিসে পেলাম। । কার্যোপলক্ষ্যে তিনি জেনেভার বাইরে গিয়েছিলেন। তাই আর আলাপ আলোচনা হল না।

দুপুরে আমরা হাইকমিশন থেকে দল বেঁধে কাছেই লাঞ্চ করতে গেলাম। দলের সদস্যরা হচ্ছেন ডেপুটি হাই কমিশনার ফারুক চৌধুরী, সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, জুলফিকার আলী ভুট্টোর এককালীন প্রাইভেট সেক্রেটারি ও প্রাক্তন কুটনীতিবিদ কায়সার রশীদ চৌধুরী, কায়সার-তনয়া জিনাত, নুরুল মোমেন খান এবং আমি।

খেতে বসে অনেক আলাপ হল। কিন্তু আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কথায় কথায় একজন সরাসরি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আচ্ছা, আপনারা কেউ বলতে পারেন বঙ্গবন্ধু আর কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন?’

হঠাৎ করে জবাবটা দিলেন জিয়াউল হক টুলু।

‘বঙ্গবন্ধুর নীতির জন্য আমরা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় মোটামুটি সন্তুষ্ট। আমার তো মনে হয় বঙ্গবন্ধু সরকার আরও বছর দশের জন্য ক্ষমতায় থাকবে।’

এবার গাফফার চৌধুরী ঠোঁট-কাটা কথা বললেন, ‘এভাবে বাংলাদেশ চলতে পারে না। শেখ মনি আরও শক্তিশালী হলে আগামি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বছর সরকার টিকতে পারে কিনা সন্দেহ।’

গাফফারের এ ধরনের জবাবে বুকটা আমার ধক করে উঠল। তা`হলে কি সাম থিং রং সাম হোয়ের? এবার সবাই আমাকে ধরে বসল। আমার মুখ থেকে সেচ একটা জবাব বের করবেই।` এরকম এক সমাবেশে কোনো কথা না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এদের চাপাচাপিতে আকস্মিকভাবে একটা হেঁয়ালি ধরনের জবাব দিলাম।

‘তা`হলে শোনেন। প্রায় ৭ হাজার মাইল দূরে বসে আমার জবাব সঠিক হবে কিনা জানি না। সঠিক না হলেই খুশি হব। আমার তো মনে হয়, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’

প্রাসঙ্গিক বিধায় এখানে গাফফার সম্পর্কিত একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হচ্ছে। লন্ডনে পরিচিত মহলে তখন একথা প্রায় সবারই জানা ছিল যে, বেকার অবস্থায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে চৌধুরী সাহেবের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ঢাকার সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকাগুলোর লন্ডনস্থ সংবাদদাতার চাকুরির জন্য গফফার চৌধুরী প্রার্থী হলেন। এ ব্যাপারে সুরাহার লক্ষ্যে হপ্তা কয়েক আগে বাংলাদেশ বিমানে একটা ফ্রি রিটার্ন টিকিটের ব্যবস্থা করে আমিই চৌধুরী সাহেবকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু হিসাবে একটু ভুল ছিল। গাফফার চৌধুরীর মতে শেখ মনির মাধ্যমে চাকুরির সুপারিশ না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে বিপত্তির সৃষ্টি হল। চাকুরিটা হয়েও হল না।

গাফফার চৌধুরীও তাঁর বরিশাইল্যা জেদ’ ছাড়লেন না। ঢাকায় স্বল্পকালীন অবস্থানকালে একটা চাকুরির জন্য শেখ মনির সঙ্গে দেখা তো দূরের কথা, যোগাযোগ পর্যন্ত করলেন না। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবার তিনি লন্ডনের পথে রওয়ানা হলেন। আসার দিনে আওয়ামী লীগের মুখপত্র দৈনিক জনপদ-এর প্রথম পাতায় বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে বাকশাল`-কে নিয়ে লেখা গাফফার চৌধুরীর সেই বিখ্যাত সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল- ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু’।

লন্ডনে ফিরে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনায় নতুন বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশে এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও বুরোক্রেটদের কারসাজিতে গোপনে আরও একটা ‘বিপ্লব` হয়ে গেছে। এজন্যই ‘কোলাবরেটার’ আর রাজাকাররা এখন শুধু ক্ষমা প্রাপ্তই নয়, সমাজজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অবশ্য গাফফারবিরোধিতা ছাড়াও আফসোস-এর সুর দারুণভাবে বিদ্যমান।

লন্ডনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোররাত সাড়ে ৩টা। নীরব-নিঝুম। বাংলাদেশের ঘড়িতে এখন সকাল সাড়ে ৯টা। লন্ডনে এর শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। টয়লেট থেকে বেরিয়ে আবার বিছানায় সুযোগ পেলাম না। বিশ্রী শব্দ করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, ‘হ্যালো, হ্যালো। কে? মুকুল সাহেব? আমি কায়সার বলছি। কায়সার রশিদ চৌধুরী।’

‘তা` কায়সার ভাই এত রাতে? সকালে ফোন করলেও তো` পারতেন, কোনো জরুরি খবর আছে নাকি?’

‘হ্যা খুবই জরুরি কথা। আর ঘুমাতে যাবেন না। আমি এক্ষুণি আসছি।’

‘হ্যালো, হ্যালো-----’

ফোনের লাইনটা খুট করে কেটে গেল। আমি একাকী বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলাম।

মিনিট দশেক পরেই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই কায়সার ভাই হুড়মুড় ঘরে ঢুকলেন।

‘মুকুল সাহেব, এখন মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করার সময়। ঢাকার খবর ভালো না।

‘কায়সার ভাই, যা জানেন সবকিছু খুলেই বলুন। কসম খোদার বলছি, আমি খুব একটা উত্তেজিত হব না। বাংলাদেশে কি মিলিটারি ক্যু হয়েছে? বন্ধবন্ধু বেঁচে আছেন তো?’

‘মুকুল সাহেব, গতকাল দুপুরে ‘পাব’-এ লাঞ্চ খাওয়ার সময় আপনি আর গাফফার যা ভবিষ্যৎ বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেটাই হয়েছে। ব্রিটিশ ফরেন অফিসের খবর হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ‘ওরা’ হত্যা করেছে। তবে মিলিটারি ক্যু হয়েছে কিনা জানি না।’

আমি পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। শুধু চোখের সামনে বারবার করে ভেসে উঠল ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত সৌম্য চেহারার মুজিব ভাই-এর। অমায়িক হাসিমাখা মুখখানা। মনে পড়ল লন্ডনে পোস্টিং হওয়ার পর ১৯৭০ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার ধানমণ্ডিতে বত্রিশ নম্বরের দোতলায় বঙ্গবন্ধু সঙ্গে আমার একান্তে শেষ সাক্ষাৎকারের কথা। সেদিন দরজা বন্ধ করে শেখ হাসিনার ঘরে দু’জনের মাঝে অনেক কথা হল। ‘তাহলে শেষ পর্যন্ত তুইও আমারে ছাইড়া ছইল্যা যাইতাছস?’

‘মুজিব ভাই, আমি দেশে থাকতে পারলাম না বইল্যা মাফ কইরা দিয়েন। বেয়াদবি নিবেন না। আসলে আপনি কিন্তু আবার `বাস মিস’ করছেন। আমার তো আর ধানমণ্ডি গুলশানে বাড়ি নাই। ব্যাংক ব্যালেন্সও নাই। আমি হইতাছি ছা-পোষা মানুষ। আমি বাঁচতে চাই।’

একটা পশমি আলোয়ান গায়ে বঙ্গবন্ধু বিছানায় কাত হয়ে শুয়েছিলেন। আমাকে ডেকে মাথার কাছে বসালেন। এরপর তার হাতের আঙুলগুলো ফুটিয়ে দিতে বললেন। সবে মাত্র গোটা দুয়েক আল ফুটিয়েছি, এমন সময় বলে উঠলেন `আমার হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা, কর্মী আর অফিসারদের মধ্যে একমাত্র তুই-ই এধরনের কথাবার্তা সাহস কইর‌্যা বলছস। আমি কিন্তু সবকিছুই আন্দাজ করতে পারি। শুধু মুখ ফুইট্যা বলি না।’

মিনিট খানিক দু`জনেই চুপচাপ। এর পরে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আমার হাতটা টেনে গেঞ্জির নিচে তার বুকের উপর নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘বলতে পারস কয়টা গুলি আমার এই বুকটা ছেদা কইর‌্যা ফেলাইব? ভালো কইর‌্যা বুকটা একটু হাতাইয়্যা দে।

এরপর দুজনেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আবার ঘরে কবরের নিস্তব্ধতা।

একটু পরেই মুজিব ভাই উঠে নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, বউ পোলাপান সব সঙ্গে লইয়া লন্ডন যাইবি। তোর পরিবারের কেউ যেন বাংলাদেশে না থাকে বুঝছো। ফরেন অফিসেও তোর শত্রু রইছে।’

বিদায়ের সময় মুজিব ভাইকে কদমবুচি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বুকে ঝড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাংলাদেশে যখন ফেরত আইবি, তখন আমারে আর পাইবি না। আমার কবর যেখানেই থাকক জিয়ারত কইরা একটা সাদা ফুল দিয়া আসিস।

‘তবে তোরে আইজ আরও একটা কথা কইয়া দেই। তুই তো` ১৯৪৬ সাল থাইক্যা আমারে দেখতাছোস। সে-ই ক্যালকাটা পলিটিকস। আমি আছিলাম শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য। ছাত্র রাজনীতিতে দিনাজপুর জেলা থাইক্যা দবিরুল ইসলাম আর তুই ছিলি আমাগো অন্ধ সাপোর্টার। হেই জন্য নুরুল আমিনের টাইম-এ দিনাজপুরে জেলও খাটোস এক বছর। পঞ্চাশ সালের রায়ট-এর বচ্ছর ঢাকায় আইলি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য। তারপর মানিক ভাই-এর ইত্তেফাকের জনের টাইম থাইক্যা তুই হইলি ফুল টাইম সাংবাদিক। পাকিস্তানের চব্বিশটা বছরই তুই আমার রাজনীতির সব কিছুই দেখছো। এরপর একাত্তর থাইক্যা তুই হইলি আমার বাংলাদেশ সরকারের অফিসার । যা আইজ তোরে একটা ভবিষ্যত বাণী কইয়া দিলাম। আমি যখন এই দুনিয়ায় থাকুম না, তুই তখন আমার সম্বন্ধে বই লিখবি। বুঝছোস, এইসব বই বেইচ্যা তোর হইবো রুজি-রোজগার। পোলাপান খাওয়াইতে পারবি।’

দরজার ছিটকানি খুলে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে আবার পিছনে ডাক এলো। তাঁর স্নেহমাখা হাসি। বললেন, ‘আমার মুকুল, তুই আর ফুটলি না। আর কথা শুইন্যা রাখ। আমার ফ্যামেলির সঙ্গে তাঁর স্পেশাল সম্পর্কের কথা, ভুলিস না। এই বাড়ির তিন-তিনটা `জেনারেশনের লগে তোর হইতাছে ভাই এর সম্পর্ক। ১৯৪৬ সাল থাইক্যা তুই আমারে চিনি। আমি তোর মুজিব ভাই আর রেণু তোর ভাবী। আবার কামাল-জামাল-রাসেল আর হাসিনা-রেহানা তোরে ‘মুকুল ভাই’ কইয়া ডাকে।

‘সব চাইতে বড় ডাকটা তুই শোনছোস? আমার নাতি মানে হাসিনার পোলা ‘জয়`ও কিন্তু তোরে ‘মগল ভাই’ কইয়া ডাকে। এই জন্যই তুই হইতাছোস এই বাড়ির হগলের ভাই’।

কথা ক`টা বলেই মুজিব ভাই তার স্বভাবসুলভ শিশুর মতো সরল হট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। আমি তখন দরজার কাছে থকে দাঁড়ানো। তিনি এবার নিভে যাওয়া পাইপটা আবার ধরিয়ে এক গাদা ধূয়া ছেড়ে হঠাৎ গুরু গম্ভীর গলায় বললেন, ‘করি কি? মনে হইতাছে, মস্কো আমারে এখনও ঠিক মতো বিশ্বাস করে। আবার লাহোরের ইসলামি সম্মেলনে গেছিলাম বইল্যা দিল্লির `সাউথ ব্লক’ গোস্বা। আর নিক্সন-কিসিঞ্জারের আমলে ওয়াশিংটনের পলিসি তো বুঝতেই পারতাছোস। একেবারে এক ঠ্যাং-এ খাড়া। আমাগো মতো `ন্যাশনালিস্ট’গো বিপদ তো এইখানেই। আমি ঠিকই বুঝতে পারতাছি। চিলির পর বাংলাদেশ। আলেন্দের পর এবার আমার পালা। আমিও শ্যাষ দেইখ্যা ছাড়ুম। পারুম কিনা জানি না।’

‘আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মনটা আমার কোন সে সুদূরে চলে গেল। হঠাৎ নেতার কথায় সম্বিৎ ফিরে এল। তিনি ধরা গলায় বললেন, ‘আমি যখন থাকুম না, যদি সম্ভব হয় ভাই হিসাবে এগো একটি খোঁজ-খবর নিস।’ সপরিবারে প্রেসিডেন্ট মুজিবকে হত্যার স্বল্প দিনের ব্যবধানে ঢাকা থেকে আমার জনৈক সাংবাদিক বন্ধু কার্যোপলক্ষে লন্ডনে এসে হাজির হলেন। বিবিসি এক্সটানাল সার্ভিসেস-এর বাংলা বিভাগে দেখা। খন্দকার মোশতাক তখন ক্ষমতায় টলটলায়মান। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানার জন্য। অস্থির হয়ে উঠলাম। বিবিসি`র নুরুল ইসলাম-এর সঙ্গে আমরাও বিকালের নাস্তা খাওয়ার জন্য বেসমেন্ট-এর রেস্টুরেন্টে গেলাম। তিনজনে অনেক আলাপ হল। একটু পরে রেকর্ডিং-এর জন্য নূরুল ইসলাম উঠে গেলেও আমাদের কথাবার্তা অব্যাহত রইল। কথায় কথায় নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক সাংবাদিক বন্ধু গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গোরস্থানে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের সংগৃহীত কাহিনী বললেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল থেকেই কারফিউ। বিকাল নাগাদ টুঙ্গিপাড়ার আকাশে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে হেলিকপ্টার এল। এর আগেও অনেকবার টুঙ্গিপাড়ার লোকজন হেলিকপ্টার নামতে দেখেছে। প্রতিবারই হাজার হাজার লোক টুঙ্গিপাড়ার কৃতী সন্তান শেখ মুজিবকে একনজর দেখার জন্য দৌড়ে গেছে।

কিন্তু এবার? কারফিউ-এর ভয়ে কেউই আর ঘর থেকে বেরুতে সাহসী হল না। বাংলাদেশ বেতারে তখন পাকিস্তানি উর্দু সিনেমার গান আর মাঝে মাঝে সরকারি নির্দেশ ঘোষণা হচ্ছে।

হেলিকপ্টার থেকে ধীরে ধীরে বাংলার অগ্নিপুরুষ ও বর্তমান বিশ্বের। অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে তার জন্মভূমিতে নামানো হলো। কিন্তু তিনি আর জীবিত নেই। এবার টুঙ্গিপাড়ায় নামল একটা বস্তাবন্দি লাশ।

[রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ৯৩ থেকে ১০১)]


বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭