ইনসাইড পলিটিক্স

১৫ আগস্টের বিতর্কিতরা এখনো আ. লীগে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/08/2018


Thumbnail

বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক এক অধ্যায় ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকের দল। দীর্ঘ সময় পরে হলেও ১৫ আগস্টের সেই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকা সেনাসদস্যদের বিচার হয়েছে বাংলার মাটিতে। ঘাতকদের কারও ফাঁসি হয়েছে, কারও হয়েছে যাবজ্জীবন। কয়েকজনের শাস্তি কার্যকর হয়েছে। ঘাতকদের কয়েকজন আছেন বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে। এদের দেশে এনে শাস্তি কার্যকরের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু একটি প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে হত্যাকারীদের বিচারেই কি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে?

বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন এমন বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার যে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র এবং এর সঙ্গে যুক্ত থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে অনেকেই জড়িত ছিলেন। কেউ ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। কেউ আবার পরোক্ষভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে থাকা অনেকেই আবার ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগেই ঢুকে বসে আছেন।

এখন আওয়ামী লীগের মধ্যেই দাবি উঠেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের বিচার করতে হবে। বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের। একই সঙ্গে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে যারা লাভবান হয়েছে। সুযোগ থাকা সত্বেও যাঁরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেনি তাঁদেরও বিচারের দাবি উঠেছে। বিচার করতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে গঠিত মোশতাকের মন্ত্রিসভায় থাকা ব্যক্তিদের। এদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জোরালো হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি আছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের বিচারের জন্য একটি কমিশন গঠন করার।

ইতিহাসবিদদের মতে, ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর অনেক আওয়ামী লীগ নেতাই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ছিলেন। এদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু যাঁরা বেঁচে আছেন তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

ইতিহাসবিদদের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে তারই ঘনিষ্ঠ সহচরদের মন্ত্রী হওয়ার ঘটনা খন্দকার মোশতাক সরকারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। মোশতাকের ৮১ দিনের শাসনামলে সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ সদস্য। মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হলেন মোহাম্মদউল্লাহ। আর মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর, পরিকল্পনামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মলি্লক, শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান, কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন, এলজিআরডি মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার, নৌপরিবহনমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী সোহরাব হোসেন। প্রতিমন্ত্রীরা হলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, ভূমি ও বিমান প্রতিমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শিল্প প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, পশু ও মৎস্য প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী কারারুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানকারী সদস্যদের ফের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, সে দিন যদি জাতীয় চার নেতার মতো অন্য মন্ত্রীরা মোশতাকের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করতেন তাহলে রাজনীতির ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। কলঙ্কের কালিমা জাতিকে এতকাল বহন করতে হতো না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে ৩৮ বছর লাগত না।

৭৫’র ১৫ আগস্টে সেনাপ্রধান ছিলেন কে এম শফিউল্লাহ। ওই সময় তিনি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। সেনাপ্রধান হিসেবে সন্দেহাতীত ভাবে ব্যর্থ শফিউল্লাহর সমালোচনা করেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতারাই। ইতিহাসবিদদের মতে, দক্ষ সেনাপ্রধান হলে ১৫ আগস্ট আসতই না। অথচ এই কে এম শফিউল্লাই ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপিও হন। বর্তমানে শফিউল্লাহ সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি।

১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন এইচ. টি. ইমাম। ৭৫ পরবর্তী সময়ে তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই মনে করেন অনেকে। খুনি মোশতাককে শপথ পড়ান এইচ. টি. ইমাম। অবশ্য এজন্য তিনি নিজেও ভুগেছেন অনেক। কারাবরণ করতে হয়েছে। ১৫ আগস্ট ও এর পরবর্তী ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেই নিন্দিত এইচ. টি. ইমাম কিছুদিন আগেও সরকারের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট বড় আমলা ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে তাঁর ভূমিকা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। জিয়াউর রহমানের খাল কাটা তত্ত্বের ওপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রিও নিয়েছেন এই মহিউদ্দিন খান আলমগীর। অথচ মহিউদ্দিন খান আলমগীরই পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী হয়েছেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর। বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি মহিউদ্দিন খান আলমগীর একাধিক ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠান বাগিয়ে নিয়েছেন। নানা সময় সরকারের ভাবমূর্তির ১২ টা বাজিয়ে ৭৫ পরবর্তী বিতর্কিত ক্যারিয়ারের মহিউদ্দিন খান আলমগীর আওয়ামী লীগেই বহাল তবিয়তে।

এরা ছাড়াও ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তাঁদের যে ভূমিকা পালন করার ছিল তার ছিটেফোঁটাও পালন করতে পারেননি। অথচ এদের উপরই বঙ্গবন্ধু আস্থা রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগের এই নেতাকর্মীদের বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন দিয়ে বিশ্বাস করতেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর সেই বিশ্বাসের কোনো মূল্য দিতে পারেননি তাঁরা। ইতিহাসবিদদের মতে, বঙ্গবন্ধু যাদের উপর আস্থা রাখতেন, বিশ্বাস করতেন তাদের মধ্যে একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া কেউই বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী সময়ে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি, রাখার প্রচেষ্টাও দেখা যায়নি অনেকের মধ্যে। তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ৭৫ এর ১৫ আগস্টের সময় রক্ষীবাহিনীর দায়িত্বে। অথচ ওই সময় কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারেননি তিনি। অনেকের মতে, গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেলেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল তোফায়েল আহমেদের।

বিশ্লেষকদের মতে, ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগে তিন ধরনের লোক ছিল: প্রথম দলে ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাকের সঙ্গে যাঁরা হাত মিলিয়েছিল। দ্বিতীয় ধরনের আওয়ামী লীগ নেতারা হত্যাকাণ্ডের পর মোশাতককে সমর্থন করেননি, কিন্তু এর কোনো প্রতিবাদও করেনি বা করতে পারেনি। আর তৃতীয় দলে ছিলেন যারা নিজেদের অবস্থান থেকে সুযোগ অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকেই সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। আবার অনেকে বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে গিয়ে যোগ দিয়েছেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। হয়েছিলেন জাতির পিতার হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের দোসর। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের বিচারে সবাইকেই আইনের মুখোমুখি করতে হবে। হত্যাকারীদের বিচারেই শুধু নয়, হত্যার ষড়যন্ত্রকারী, তাদের দোসর সবার বিচারেই শুধুমাত্র কলঙ্গমুক্ত হবে জাতি। 

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭