ইনসাইড আর্টিকেল

পিতা, আমরা তোমার কাছে ঋণী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/08/2018


Thumbnail

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোকের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।

এই শোকাবহ মাসে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য নিয়েছে বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কিছু স্মরণীয় লেখা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ থাকছে লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী এর ‘পিতা, আমরা তোমার কাছে ঋণী’ শিরোনামে একটি লেখা। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে।

পিতা, আমরা তোমার কাছে ঋণী

লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ধর্মের বর্মে ভারত ভাগ করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের অধীনে আমরা প্রথমবার স্বাধীন হয়েছিলাম। কিন্তু আমরা, পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যে প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন হইনি, বরং ব্রিটিশ শাসনাধীন উপনিবেশের গ্যাঁড়াকল থেকে উদ্ধার পেয়ে পাকিস্তানি শাসনাধীন উপনিবেশের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছি, তা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম পাকিস্তানের মনিঅর্ডার ফরম, পোস্টকার্ড, ইনভেলপ, বিভিন্ন প্রকার ফরম, চালান ইত্যাদি শুধু ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় মুদ্রিত, বাংলা ভাষার স্থান কোথাও নেই। ‘সাতচল্লিশের স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলন` নামের একটি কবিতায় আমি বাঙালি জাতির তকালীন অবস্থা যেভাবে প্রকাশ করেছি তা থেকে ৪টি লাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বাঙালি শিক্ষিতদের করুণ অবস্থা পাঠকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

ফরম পুরণ করতে সবাই খেতো হিমশিম,

বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিতেও ধরে গেল ঝিম।

দৌড়তে হতো ফরম নিয়ে উর্দু-ভাষীর কাছে,

রাতারাতি পিএইচডি`রাও মুগ্ধ হয়ে গেছে।

পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল একটি কলোনিরূপে রূপান্তরিত করার জন্য পশ্চিমা শাসকরা প্রথমেই বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত হানতে সচেষ্ট হয় এবং তার প্রথম বহি:প্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মাধ্যমে। রাষ্ট্রভাষার দাবি রাষ্ট্রভাষার অন্দোলনে পরিণত হয় ১৯৪৯ সালের। ২৫ এপ্রিল সেই আন্দোলন জনসাধারণের পূর্ণসমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে তীব্র আকার ধারণ করে। ভাষা আন্দোলনের কথিত অপরাধে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৪ জনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। দু:খজনক হলেও সত্য যে, ব্যক্তিগত মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের ছাড়িয়ে নেন, কিন্তু শেখ মুজিব ছিল আদর্শ ও নীতিতে অটল। তাই ভাষা আন্দোলনের চরম মুহর্তেও (২১ ফেব্রুয়ারি ‘৫২) তিনি ছাড়া পাননি। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৮/৯ বছরের ইতিহাসে সব ছাত্রনেতা ও কমীরই যে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা নয়। সরকার নেতৃস্থানীয় বহু ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীকে বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আন্দোলনকে নেতত্বহীন করে দমিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল তা যেমন সত্য, শেখ মুজিব, গাজীউল হক প্রমুখের আপসহীন নেতৃত্বে বহু ছাত্রনেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যার বিনিময়ে অবশেষে ১৯৫৬ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়, এটাও তেমনি ঐতিহাসিক সত্য।

প্রতিবন্ধকরূপে গণ্য করে তাঁকে বছরের পর বছর জেল-জুলুম ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়। তাঁর দলের বহু নেতা-কর্মীকেও কারাগার নিক্ষেপ করা হয়। বাঙালি বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারাবাহিকতাই ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বাঙালির মুক্তিসনদ ৬-দফা ফর্মুলা পেশ করেন। প্রকৃত ৬-দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। সর্বস্তরের বাঙালিরাই ৬-দফা ফর্মুলাকে লুফে নিল, কিন্তু আৎকে উঠল আইয়ুব খান ও অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা। আইয়ুব খান এটাকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করার ফর্মুলা, এ অভিযোগে দেশরক্ষা আইনের অধীনে শেখ মুজিব ও তার সহকর্মিদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন। শেখ মুজিব ও তাঁর দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মিদের অসংখ্যবার গ্রেফতার, অত্যাচার, নির্যাতন করেও সরকার ৬-দফার আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি, বরং আন্দোলন উত্তরোত্তর তীব্র আকার ধারণ করে। বাধ্য হয়ে আইয়ুব জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা অর্পণ করে পর্দার অন্তরালে গমন করে। আন্দোলনের গতিকে মন্থর করার অভিপ্রায়ে ইয়াহিয়া খান লোকসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা প্রদান করে। এই ৬-দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমা শাসকদের সব জরিপ রিপোর্টকে ভুল প্রমাণ করে বাঙালিরা এককভাবে আওয়ামী লীগকে গরিষ্ঠ সংখ্যক আসনে নির্বাচিত করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করার অধিকার প্রদান করে। প্রমাদ গোনে সামরিক শাসকরা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়। গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বাঙালিদের দমন করবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ৯ মাসের যুদ্ধে বাঙালিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়। পৃথিবীর বুকে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

১৯৬৯-এর দুর্বার গণআন্দোলনের মাধ্যমে (ছাত্র জনতার সংমিশ্রণে) শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে বাধ্য করে। পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় সেদিন ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবকে `বঙ্গবন্ধু` উপাধিতে ভূষিত করে। সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের জনযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর এ জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে `জাতির পিতা` রূপে বরণ করে নেয়। কারণ, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বলে- `এই মহামানবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ হতো না।`

পিতা, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের সব দু:সহ নির্যাতন উপেক্ষা করেও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতি হিসেবে আমরা সবাই বাঙালি চেতনাবোধে বিশ্বাসী, এই ধারণা তুমি আমাদের দিয়েছ; পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা তাদের স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে তাদের অপশাসনের মাধ্যমে আমাদের শোষণ করেছে, বঞ্চিত করেছে, এ সত্য তুমিই রাজনৈতিকভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরেছ; অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার দৃঢ়তা তুমি আমাদের শিখিয়েছ। আমরা তোমার কাছে ঋণী। বাঙালি জাতি তোমার কাছে ঋণী। সুদীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি দু:শাসনের বিভিন্ন মেয়াদে ১৪ বছর জেল-জুলুম সহ্য করে ৬-দফা ফর্মুলার দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তুমি পুরো বাঙালি জাতিকে তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একই প্লাটফরমে আনতে সক্ষম হয়েছিল, যার পরিণতি ১৯৭০-এর নির্বাচনে অচিন্তনীয় বিজয়।

এই নির্বাচনের পথ ধরেই ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় লাভ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এক অসাধ্য সাধন। আমরা সারা বাঙালি জাতি তার কাছে ঋণী। এটা ঐতিহাসিক সত্য, এ সত্যের মরণ নেই। তাই আসুন, দলমত নির্বিশেষে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা উদাত্তকণ্ঠে বলি— পিতা আমরা তোমার কাছে চিরঋণী। পরিশেষে ভারতের বিখ্যাত কবি ও লেখক অন্নদা শংকরের ভাষায় বলে এ পর্বের ইতি টানছি :

‘যতোদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান,

ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

২। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের অন্ধকারপুরী থেকে স্বাধীন বাংলার মাটিতে তোমার আগমন। বিমান থেকে অবতরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালক, তোমারই হাতে তৈরি অকুতোভয় মুক্তি সৈনিক স্বাধীন বাংলাদেশের। প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে তোমার কোলাকুলি, সে এক অভূতপূর্ব সুন্দর দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। ভেবেছিলাম তোমার নেতৃত্বে সব সাথীযোদ্ধাদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে আমরা তোমার মনের মতো করেই গড়ে নিতে পারব। কিন্তু…….! এখানটায় আমার লেখা কবিতা ‘বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা থেকে উদ্ধৃতিসহ পাঠকদের বোঝাতে চাই:

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অতি কঠিন কাজ/ গঠনোন্নয়নে দেওয়া তিলোত্তমা সাজ/দৃপ্তপদে বঙ্গবন্ধু গ্রিবা উঁচু করে/তুলে নিলেন কঠিন সে কাজনিজ স্কন্ধ পরে। নিজ দেশের পূণ্য সে যে দেশের মাটি/সাধ ছিল তাঁরা গড়ে নেবেন অতি করে খাঁটি।/ কিন্তু কিছু হায়েনা ক্রীত বঙ্গ অর্বাচীনে/হত্যা করলো মুজিবকে আগস্টের এই দিনে।

রেডিওতে ভেসে আসছিল মেজর ডালিমের স্বর, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন...। বিশ্বাস হচ্ছিল না। যথাসম্ভব দ্রুত তৈরি হয়ে অফিসে গেলাম । বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর সবার মুখে। গেলাম সেনাপ্রধানের অফিসে। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ, উপ-প্রধান মোর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, ব্রিগেড অধিনায়ক কর্নেল সাফায়াত জামিল এবং আরো অনেককেই দেখতে পেলাম। পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে বৈঠক বসল। এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য দ্বারা বিদ্রোহিদের দমন করার জন্যে অনুমতি চাওয়া হল। জবাবে উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অজুহাতে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কাল্পনিক ভয় দেখিয়ে সবাইকে নিরুৎসাহিত করতে সক্ষম হল। মনটা দমে গেল। দমে গেল এজন্যে যে, আমি তখন ছিলাম সেনাসদরে একজন কো-পরিচালক। আমার অধীনে কোনো যোদ্ধাবাহিনী (Fighting Force) ছিল না। একাত্তরে ছিল এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার পর আর কোনো আদেশের অপেক্ষায় থাকিনি। ২৫ মার্চ রাত্রে ঢাকার গণহত্যার দু:সংবাদ শোনার পর পরই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন ১৫ আগস্ট `৭৫ আমি নিরুপায়। যারা তাকে নিরাপত্তা দিতে পারতো, অন্তত পরবর্তীতে বিদ্রোহিদের দমন করে সরকার ও সংবিধানকে রক্ষা করতে পারত, তারা বিভ্রান্ত। অস্থির মনে ফিরে গেলাম নিজ অফিসে। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের চিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। তাতে অস্থিরতা শুধু বাড়ল, চিন্তা শক্তি যেন সব অগোছালো হয়ে গেল। ঠিক করলাম বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যাব। যত বাধাই থাকুক, একবার হলেও তাকে দেখতে চাই। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। জিপ নিয়ে ছুটলাম শহর পানে। বেলা তখন আনুমানিক ১০/১১টা হবে। পৌছে গেলাম বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে। প্রাচীর ঘেরা বাড়ির লনে কাঠের অতিসাধারণ একটা কফিন ছাড়া আর কিছুই আমার নজরে পড়েনি। দ্রুতপদে কাফনের কাছে গিয়ে দেখলাম ঢাকনাটা আলতোভাবে লাগানো। আমি ঢাকনাটা সরিয়ে ফেললাম। শবদেহ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। মুখের কাপড় সরিয়ে নিলাম। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, শতাব্দীর মহামানব, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কফিনের ভেতর চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। অমন মহামানবের শবদেহ এত অবহেলায় পড়ে থাকতে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। নিজেকে বড় অসহায় মনে হল। একাত্তরেও নিজেকে কখনোই এত অসহায় মনে হয়নি। তাহলে? চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললাম। হঠাৎ গাড়ির শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সে অবস্থায় গভীর শ্রদ্ধাভরে আমি সামরিক স্যালুট প্রদান করলাম। মুখের কাপড় যথাস্থানে লাগিয়ে শেষ স্যালুট প্রদান করে ফিরে এলাম।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ও স্বাধীনতা উত্তর বিভাগীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে যখন সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধু, তুমি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে যথাযথ অনুসন্ধানের পর আমাকে সরাসরি লে: কর্নেল র‌্যাংকে প্রমোশন দিয়ে আমার ইস্তফার আবেদন নাকচ করেছিলে। ইস্তফাপত্রে তুমি ইংরেজিতে দু`টি ছত্র লিখেছিলে—‘Allegations against Major Osman found baseless. His promotion is granted.’

সেদিন ১৫ আগস্ট তাই নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল। মনে হল আমি এতিম হয়ে গেছি। দুই বৎসর বয়সে মাকে হারিয়েও এতিম হয়েছিলাম কি না বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেদিন ৩২ নম্বরের সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল আমি সত্যি এতিম হয়ে গেছি। তারপর ৩রা নভেম্বর `৭৫ কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা করা হল। ৭ নভেম্বর সকাল ৮ ঘটিকায় পাকিস্তান ফেরৎ সৈনিকরা আমাকে হত্যা করার জন্য আমার বাড়ি আক্রমণ করল। আমাকে না পেয়ে তারা ব্রাশফায়ারে হত্যা করল আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নাজিয়া ওসমানকে। আমার দুই শিশু কন্যাকে অবশ্য তারা রেহাই দিয়েছিল। ১৯৭১-এর যুদ্ধক্ষেত্রে বোমার মাঝেও যাকে দেখেছি অবিচল, শক্রর অবস্থান থেকে মাত্র ৫০০ গজ ব্যবধানেও যিনি বিদেশি কূটনীতিকদের মুক্ত এলাকা দেখাতে ভয় পাননি, ঐতিহাসিক ১৭ এপ্রিল ৭১ বাংলাদেশ মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যিনি করেছেন সারা বাংলার নারী জাতির প্রতিনিধিত্ব, তাকে সেদিন প্রাণ দিতে হল নিজ ঘরে নিজ দেশেরই সৈনিকদের গুলিতে, সে কী মর্মান্তিক, কী হৃদয়বিদারক তা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। তারপর জিয়াউর রহমান অকালীন অবসর দিয়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করলেন। সব হারিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে পিতা কেমন করে যেন আজো আমি বেঁচে আছি। কিন্তু তোমার কাছে আমার বা এ জাতির ঋণের বোঝা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি, একটুও লাঘব করতে পারিনি, তার জন্যে ক্ষমা করো।


[রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ২৩৬ থেকে ২৪০)]

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭