নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 15/08/2018
আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। এই দিনেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোক দিবসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।
এই শোকাবহ দিনে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য মমতাজউদ্দীন আহমদ এর ‘আমার নায়কের কথা লিখব’ শিরোনামে একটি লেখা দেওয়া হলো। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে।
আমার নায়কের কথা লিখব
মমতাজউদ্দীন আহমদ
আমার সর্বাঙ্গ প্রবল জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমার যত ভাবনা সবই চিত্তের প্রদাহকে আগুনের কঠিন তাপ দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে চাইছি।
আমার মায়ের মতো মমতাময়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্ণ হয়ে এল। চারদিকে বিজয়ের মেলা। সবখানে প্রাণের আনন্দ। যেখানেই দেখো সেখানেই বিজয়ের উৎসব। আর এখানে আমি প্রবল জ্বরে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হই। এবার আমি বিজয়কে আমার হৃদয়ের সবখানে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। এ বিজয়ে একটি নাট্য রচনা করতে চেয়েছিলাম। নাটকটির দৃশ্যভাগ করা আছে। সংলাপ স্রোতের মতো উচ্ছ্বসিত হযে আছে। নাটকের প্রধানতম পাত্র আমার চিত্তের কলমের মুখে খই ফোটার মতো খলবল করছে।
বিজয়ের দিনে নাটকটি শুরু করে বিজয়ে প্রসার করতে চেয়েছিলাম। নাটকের নায়ক দু’দশক ধরে আমার সমস্ত অনুভূতির সঙ্গে হেসে-খেলে, অভিমানে-সজলতায় স্থির হয়ে উঠেছি। আমার সঙ্গে নায়কের বার বার সংলাপ বিনিময় হয়েছে। আমার সমস্ত প্রশ্নকে সহজ বিশ্বাস মুক্ত করে আমার সর্বপ্রকার বিভ্রান্তি দূর করে দিয়েছে।
আয়োজন নিষ্পন্ন করেছিলাম। বিশ্বাস ও ভালোবাসাকে নিরঙ্কুশ করেছিলাম। লেখার পূর্বরাতে আমার সর্বাঙ্গ প্রবল জ্বরে তাড়নায় অস্থির হয়ে গেছে। জ্বর যদি না যায় আমার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যাবে। নাটকটি লেখা হবে না। জনপদ বিস্তৃত অঞ্চলে আমার নায়ককে নিয়ে ভাম্যমাণ অধিকারীর মতো ঘুরতে চেয়েছিলাম। এখন আমার দেহ নিস্পন্দ হয়ে গেলে জনপদে ঘোরার বাসনা চিরকালের মতো বাতিল হয়ে যাবে।
এমন পূর্ণ সময়ে এমন বিশাল আয়োজনের কালে এমন মুখরিত মহাউৎসবে তবে আমি প্রবল জ্বরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যাই কেন?
মাইকেল মধুসূদন তাঁর মহাকাব্যের ষষ্ঠ সর্গ রচনার আগে জ্বরে অধীর হয়ে পড়েছিলেন। ষষ্ঠ সর্গে রচনা করতে চেয়েছিলেন প্রিয় মেঘনাদকে। নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে আগুনের সামনে মেঘনাদ তপস্যায় বসেছিল। সে পূজা যদি শেষ হতো তাহলে দেবতা বা দেবতার আশ্রয়ধন্য লক্ষ্ণণের সাধ্য ছিল না মেঘনাদকে আক্রমণ করে। কিন্তু তথাকথিত দেবতার কৌশলের জন্য এবং দেশপ্রেমহীন বিশ্বাসঘাতক বিভীষণের প্রতারণা সম্বল করে লক্ষণ আক্রমণ করলো মেঘনাদকে। নিরস্ত্র কিন্তু মানবীয় শক্তির সম্পদে শক্তিমান মেঘনাদ প্রতারণার কারণে নির্লজ্জ দেবশক্তির হাতে পরাভূত হলো। যজ্ঞাগার রক্তে ভেসে গেলো। মেঘনাদ পড়ে থাকলো নিজেরই রক্তের স্রোতে। মহৎ এক বীর, মহান এক দেশপ্রেমিক নিস্পন্দ হয়ে গেলো।
মধুসূদন প্রিয় নায়ক মেঘনাদের এমন পরিণাম রচনা করার অস্থির আতঙ্কে উদ্বেল ছিলেন। তাঁর হৃদয় জুড়ে প্রিয়জন হারাবার ভয়ঙ্কর হাহাকার চিল। মধুসূদন বলেছিলেন, ষষ্ঠ সর্গ রচনার আগে প্রবল জ্বলের আক্রমণে হয় আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো, আর বেঁচে উঠলে আমাকেই আমার প্রিয় মেঘনাদের নৃশংস হত্যার কাব্য রচনা করে দিতে হবে।
আমার নায়কও মারা গেছে। মেঘনাদের মতোই রক্তের স্রোতের ওপর আমার নায়ক শুয়েছিল। কতিপয় বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারী তথাকথিত সৈন্যদের সাহায্য নিয়ে তাকে হত্যা করেছে। আমার নায়ক কোনো পাপাচারী দুর্বৃত্ত অথবা সারমেয় স্বরূপ তথাকথিত কোনো সেনার কাছে জীবনভিক্ষা করেনি। আশ্চর্য রকম বিস্ময় নিয়ে আমার প্রিয় নায়ক তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মনুষ্য সমাজে এত হীন প্রবৃত্তিসম্পন্ন নরকীট থাকতে পারে তা সে বিশ্বাস করেনি।
একি এ দৈবলীলা? একি মানুষের নিয়তি? নাকি এ কেবল ইতিহাসের বার বার একই বৃত্তে পরিক্রমণ?
আমি লিখতে চেয়েছি মানবভাগ্যের আর এক উপাখ্যান, লিখতে চাই প্রজ্জ্বলিত আগুনের হাহাকার।, লিখতে চাই, পার্শ্বচরদের বিশ্বাসঘাতকতার গভীর দুঃশাসনীয় ষড়যন্ত্র। এবারই এই বিজয় মেলায় আমার নায়ক অমৃত সংলাপ ও অপরিমেয় সম্ভার নিয়ে জনপদে জনপদে গাঙ্গেয়-বদ্বীপ ও সমতট গৌড় বঙ্গের স্বরূপ বজ্রকণ্ঠে তুলে ধরতে চেয়েছিল।
আর আমি প্রবল জ্বরে আগুনের প্রদাহে জ্বরে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছি। এখন কেমন করে রক্তস্নাত এক মৃত্যুর কথা বলবো। আমি মৃত্যুর কথা বলতে চাই নে। জীবনের কথা, প্রমত্ত যৌবনের কথা এবং কচি-কচি সবুজ পত্রপুস্পে প্রজাপতির নৃত্যের কথা বলতে চাই আমি। আমার যে নায়ক, সে কখনোই মৃত্যুর কথা বলেনি। আমার নায়ক যে কোনোদিন পরাভব ও ভয়ের কথা বলেনি।
তাহলে আমি সর্বভীতির উর্ধ্বে আমার অসীম সাহসী ও যৌবন মুখরিত নায়ককে মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে আহ্বান করবো কেন?
আমার মা বাংলাকে যে মুক্ত করেছে, আমার বিজয়কে যে সমাসীন করেছে, সেই অবিনশ্বর নায়ক, তাঁকে অকম্পিত হৃদয়ে স্থাপন করে বসে আছি। একদিন আমার হৃদপিণ্ড থেমে যাবে। সে স্পন্দন আমার সন্তানের মধ্যে যাবে। প্রজন্মের পর প্রজন্মে আমার নায়ক নির্ভয় কণ্ঠে বিজয়ের কথা বলবে। বিজয় শত সহস্য বছরে ছড়িয়ে থাকবে।
যদি বেঁচে উঠি, তাহলে অবিনশ্বর সেই নায়কের শক্তির কথা লিখবো।
আমার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এক অপরিমেয় শক্তির আধার।
[রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ২৩৩ থেকে ২৩৫)]
বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭