ইনসাইড আর্টিকেল

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী: শতবর্ষ পুরোনো নির্যাতনের আখ্যান

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/08/2018


Thumbnail

সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সংকট মানবাধিকার ইস্যুতে পুরো বিশ্বের সামনে একটি গুরুতর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন শুরু হওয়া ও এর জের ধরে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর এই সংকটের দিকে সবাই নতুন করে নজর দেয়। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের নির্যাতনের ইতিহাস শতাব্দী পুরনো। রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্তিতে চলুন একটু ফিরে দেখি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইতিহাস।

মিয়ানমারের পুরনো নাম বার্মা। দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার এই দেশটির একটি রাজ্য হলো রাখাইন। এই রাজ্যের সাবেক নাম আবার আরাকান। আরাকান রাজ্যটি খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। আরাকানই রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিবাস।

১৮২৮ সালে মিয়ানমার (তখনো বার্মা নামেই পরিচিত ছিল) ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। সে সময় থেকেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বাড়তে থাকে নির্যাতনের মাত্রা। ১৯৩০ সালে ২০০ জন রোহিঙ্গাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নানাভাবে উগ্র বৌদ্ধত্ববাদীদের হাতে নির্যাতিত হতে থাকে অসংখ্য রোহিঙ্গা। ধারণা করা হয় ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে আরাকান বা রাখাইনে রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ছিল। অথচ ১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারি থেকে দেখা যায় আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংখ্যা নেমে এসেছে ৫৮ হাজার ২৫৫ জনে। এ থেকেই রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নির্যাতনের স্টিম রোলারের তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

বার্মার শাসক থাকাকালীন ব্রিটিশরা দেশটির ১৩৯ জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করেছিল কিন্তু তার মধ্যে তাঁরা রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভূক্ত করেনি। পরবর্তীতে বার্মা সরকারও যখন ১৩৫ টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তখন তারাও রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করার পন্থা হিসেবে ওই তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেয়।

নানা পথ পরিক্রমার পর ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্ত্বশাসন লাভ করে। এর পরপরই উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় নতুন উদ্যমে। স্বায়ত্ত্বশাসন প্রাপ্তির পরের বছরই দুই শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়। নির্যাতন করা হয় আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে। এরপর ১৯৪২ সালে বার্মা দখল করে জাপান। সে সময় জাপানি সেনাদের সহায়তায় স্থানীয় মগরা প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে। এই গণহত্যা ‘৪২ এর গণহত্যা নামে কুখ্যাত। এই নির্যাতনের ফলে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা ভারত ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

মিয়ানমার ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে। এর নয় বছর পর ১৯৫৭ সালে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আরাকান রাজ্যে ৭টি আসনে জয়লাভ করে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এতে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়।

এরপর ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করে। ১৯৬২ সালে থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সামরিক জান্তার পরিচালিত ১৪টি অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। সে বছরই শাসক আলে নে উইন সংখ্যালঘুদের সব সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে আর ১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় নির্যাতন জারি রেখে ১৯৭৪ সালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয় মিয়ানমার সরকার, একই সঙ্গে চালায় উচ্ছেদ অভিযান।

সামরিক জান্তা ১৯৮১ সালে আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখে রাখাইন। আরাকান যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রাজ্য না, বরং রাখাইন বৌদ্ধদের রাজ্য তা প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা থেকেই মূলত এই কাজটি করা হয়। এরপর সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের ওপর ১৯৯২ সালে দুইবার সামরিক অভিযান চালায় যার ফলশ্রুতিতে  ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে অস্বীকার করার প্রয়াস থেকে ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ মিয়ানমার সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

গত বছর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা করে ১২ জন নিরপত্তা কর্মীকে হত্যা করে। এর জের ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে। ওই অপারেশনে তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হন, অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হন। সে বছর রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে সীমান্ত পারি দিয়ে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। পরবর্তীতে এই শরণার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়ে যায়। আগে থেকেই ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। ফলে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্যও বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার আশু সমাধান জরুরি।


বাংলা ইনসাইডার/এসএইচটি/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭