ইনসাইড থট

মোবাইল টেলিফোনের ফাঁকিবাজি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 26/08/2018


Thumbnail

বাংলাদেশের মোবাইল টেলিফোন গ্রাহকরা পৃথিবীর ২/৩টা দেশ বাদে সর্বনিম্ন কল রেট ভোগ করছিল আর টেলি ডেনসিটিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। কিন্তু সারা দেশের ১৫ কোটি ৭ লাখ মোবাইল ফোন গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় নেওয়া বিটিআরসির’র সিদ্ধান্তে একটা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী দেশের টেলিফোন গ্রাহদের মাঝে সফলভাবে বিভ্রান্তি ছড়াতে সক্ষম হয়েছে। গ্রামীণ ফোনের ৬ লাখ ৯৬ হাজার বাংলাদেশি গ্রাহকের বিরাট অংশই মনে করছেন, তাঁদের ঠকানো হয়েছে, বিটিআরসির ঘোষিত এই নতুন কলরেটের ফলে। আসলেই কি তাই। একটু হিসাব নিকাশ করে, তত্ত্ব তালাশ করতে দোষের কী?       

অনেকেই বলেছেন, গ্রামীণ ফোনের ৬ কোটি ৯৬ লাখ গ্রাহক আর বাকি অপারেটরদের আছে ৮ কোটি ২১ লাখ গ্রাহক। গ্রামীণের গ্রাহক বেশি  হওয়ায় তাদের অন নেট মানে গ্রামীণ থেকে গ্রামীণ ফোনে কল করলে বিশেষ প্যাকেজের আওতায় ০.২৫ পয়সা কল চার্জ নিতো। আসলে কী তাই! আসলে কোনো সময়ই ০.২৫ পয়সা কল রেট ছিল না, ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে অপারেটর ভেদে তা ছিল ০.৩৫ থেকে ০.৩৯ পয়সা। ০.২৫ পয়সা অন নেট কল রেট ছিল ভ্যাট ট্যাক্স বাদে, এটা একটা আইওয়াশ বা মার্কেটিং প্রপাগান্ডা মাত্র। বাস্তবে অন নেটে কল রেট বেড়েছে ০.০৫ পয়সা মাত্র, কিন্তু অফ নেটে মানে অন্য অপারেটরের কাছে কলের ক্ষেত্রে কল রেট কমেছে ০.৪৫ থেকে ০.৫০ পয়সা। আর সেই সুবিধা পাবেন ৮ কোটি ২১ লাখ গ্রাহক, কিন্তু আপাতদৃষ্টে ৬ লাখ ৯৬ হাজার গ্রাহক ০.০৫ পয়সা করে অন নেটের কলে লুজার হবেন। এখান থেকেই বুঝা যায় যে সারা দেশের মোট মোবাইল টেলিফোন গ্রাহকের বেশির ভাগই লাভবান হবেন, এই কথা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। কিন্তু কেন এই কথা হচ্ছে! বিটিআরসি ২ বছরের বেশি সময় ধরে আলাপ আলোচনা করে এই কল রেট নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সব অপারেটরের সম্মতিতে। কারণ মোবাইল অপারেটরদের কল রেটের ডাইলুটেড প্রাইস ছিল ০.৫৭ পয়সা, অপারেটররা বলেছিল ০.৫০ পয়সা করতে, বিটিআরসি করেছে ০.৪৫ পয়সা অন নেট কলরেট। যদিও সারা দুনিয়ায় অফ নেট অন নেট প্রথা কোথাও চালু নেই, কিন্তু বাংলাদেশে আছে, যা ভালো সিস্টেম না।   

সার বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও  এমএনপি মানে মোবাইল নেটওয়ার্ক  পোর্টিবিলিটি চালু করা হয়েছে মোবাইল গ্রাহকের স্বার্থে। এর ফলে যে অপারেটর ভালো সার্ভিস দেবেন, মানে যাদের কম কল ড্রপ হবে আর নেটের সার্ভিস ভালো হবে, তাদের নেটওয়ার্ক মোবাইল গ্রাহকরা ব্যবহার করতে পারবেন তাদের বর্তমান টেলিফোন নাম্বার পরিবর্তন করা ছড়াই। আর এই কারণেই সব কল অপারেটরের কলের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনাটা জরুরি ছিল। ঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে আর কল ড্রপের ঘাপলা দিয়ে দেশের গরীব টেলিফোন গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় টেলিফোন অপারেটররা। কারণ গ্রাহকদের বিরাট একটা অংশই উচ্চ শিক্ষিত নয়, তারা টেলিফোনে আসা ম্যাসেজ পড়ে বুঝতে পারেন না। তাই তারা টেলিফোন অপারেটরদের দারা প্রতারিত হন, প্রতিনিয়ত, কারণ এই ব্যাপারে সব অপারেটর একাট্টা। সেটা নিয়েই এবার আলোচনা করা যাক।   

মনে করি, আমাকে ৯৯ টাকায় (আসলে ভ্যাট ট্যাক্স ধরলে অনেক বেশি) ৩০০ মিনিটের একটা প্যাকেজ দিয়েছে অপারেটর। মানে আমি ৩০০ মিনিট কথা বলতে পারবো মনে করি তথাকথিত ০.২৫ (আসলে প্রায় ০.৩৫ পয়সা) পয়সা রেটে। আমার মনে আছে আমি ৩০০ মিনিট কথা বলতে পারবো কম রেটে। তাই আমি কল করেই যাচ্ছি, খেয়াল নেই। যখন আমার ৩০০ মিনিট পার হয়ে যাবে তখন কলের জন্য প্রতি মিনিট ১.২০ পয়সা হারে কেটে নেওয়া হবে, যা ঘটে অধিকাংশ গ্রাহকের ক্ষেত্রেই তাই তো মোবাইল অপারেটরদের কল রেটের গড় ডাইলুটেড প্রাইস ছিল ০.৫৭ পয়সা প্রতি মিনিট। এটা ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ডের টাকা শোধ দেবার সময় পার হবার পরে যে উচ্চ মাত্রায় ইন্টারেস্ট রেট চার্জ করে তার মতো। এটাই হচ্ছে গ্রাহকদের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি, টেলিফোন অপারেটরদের। তাই এমএনপি আনা হয়েছে টেলিফোন গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায়। গ্রাহকদের এটা বুঝতে হবে, জানতে হবে।    

এবার আসি মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট কানেকশনের ফাঁকিবাজি নিয়ে। আমরা সবাই নেট চালাতে এমবি (মেগাবাইট) কিনি (চালু কথায় বলে)। মনে করি ৭ দিনের জন্য আমরা কেউ ১৯৯ টাকা দিয়ে ৬ গিগাবাইট একটা ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনলাম। এটা অটো রিনিউয়ালের অপশন দেওয়া না থাকলেও আপনি যদি কোন কারণে আপনার ফোনের ডাটা অপশন বন্ধ করতে ভুলে যান (এমন ভুল হয়েই থাকে) তবে ফোনের ৬ গিগাবাইট ইন্টারনেট প্যাকেজ শেষ হবার পরেই আপনার মোবাইল থেকে ভ্যাট ট্যাক্সসহ প্রতি এমবি ১.২২ পয়সা হারে কেটে নেবে যতক্ষণ না আপনার মোবাইলের ব্যালান্স শেষ হয়। হঠাৎ দেখলেন আপনার মোবাইলে ব্যালান্স নাই, যতই চিৎকার করেন, কোনো কাজ হবে না। তারা আপনার টাকা ফেরত দেবে না, সে যে অপারেটরই হোক না কেন! বাংলাদেশের সব অপারেটর তাদের নেটওয়ার্ক চালাতে (ভয়েস কলসহ) এই ব্যান্ডউইথ কেনে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) কোম্পানির কাছ থকে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডাররাও আইআইজি’র কাছ থেকে ব্যান্ডউইথ কেনেন। এই কেনা বেচায় সরকার ট্যাক্স পায়। বাংলাদেশে ৩২টি আইআইজি লাইসেন্স দেওয়া থাকলেও মাত্র ৮ টি কোম্পানি  অপারেশনে আছে। এই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে টেলিফোন অপারেটরগণ ভয়েস কলের পাশাপাশি গুগল আর ফেসবুক, ইত্যাদি থেকে পপুলার কন্টেন্টগুলো সরাসরি কিনে নিয়ে সেই কন্টেন্ট বা ডাটাগুলো তাদের ক্যাশ ইন সার্ভারে রেখে দেয়। ফলে আপনি গুগলে বা ফেসবুকে কিছু সার্চ দিলে প্রথমেই আপনার ফোনের নেট তার অপারেটরের ক্যাশ ইন সার্ভার যায়। সেখান থেকে যদি তা পেয়ে যায় তাহলে অপারেটরের ব্যান্ডউইথ বেঁচে যায়, সরকার মানে আপনার দেশ রেভিনিউ থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ অপারেটর অতিরিক্ত ব্যান্ডউইথের জন্য আইআইজি’র কাছে আর যায় না। আপনি আপনার মোবাইল থেকে অডিও কোনো কিছু সার্চ দিলে দেখবেন, সেটা পেতে আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, কারণ মোবাইল অপারেটরেরা তাদের ক্যাশ ইন সার্ভারে এসব অডিও কন্টেন্ট কম রাখে, রাখে ভিডিও, ইউটিউবের কনটেন্টে যাতে অনেক এমবি খরচ হয়, মোবাইল অপারেটরদের লাভ বেশি হয়। শুনে অবাক হবার কিছু নেই যে, বাংলাদেশের এক মোবাইল অপারেটর একাই সরকারের পাওনা আর ভ্যাট দিয়ে মোট ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তসরুপ করেছে।          

ভয়েস কল আর ডাটা সার্ভিস হচ্ছে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের মেইন সার্ভিস। এর বাইরে আছে ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভিএএস)। নতুন সিম কার্ড কেনার সময় ভিএএস এর সব ফাঁদ পাতা হয়। যা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আপনার ফোনের ওয়েকাম টিউন, রিং টোন, স্বাস্থ্য সেবা, বাস-ট্রেনের টিকেটিং, অনলাইনে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, মিউজিক শোনা, ব্রেকিং নিউজ পাওয়া, ইত্যাদি নানা ধরণের অনেক ভিএএস চালু আছে আমাদের দেশে, মোবাইল অপারেটরদের সহযোগিতায়। এগুলো যত না সার্ভিস তার চেয়ে বেশি হচ্ছে গরীব আর অল্প শিক্ষিত মোবাইল গ্রাহককে আর্থিক শোষণের ফাঁদ। বুঝে বা না বুঝে আপনি একবার তাদের ফাঁদে পা দিলেই, ভিএএস সার্ভিস প্রভাইডার ভেদে মাসে মাসে কম করে হলেও ৩০ টাকা করে কেটে নেবে আপনার মোবাইল অপারেটর। অনেক সময় এসএমএস বা ফেসবুকের কোন পেজ ওপেন করলেই আপনি তাদের গ্রাহক হয়ে গেলেন, মাসে মাসে আপনার টাকা কাটা শুরু। আপনি হয় তা জানেন না, কিন্তু টাকা কাটা যায়। যে অপারেটরের নেটওয়ার্ক যত বড় তার এই ধরনের অনৈতিক ‘চুরি’ তত বেশি। এটা এসএমএস করে বন্ধ করতেও লাগবে ২ টাকা। অপারেটর আর ভিএএস সার্ভিস প্রভাইডারদের মধ্যে থাকা চুক্তিতে এটা করে মোবাইল অপারেটররা।       

মনে করুন আপনি যে কোনো মোবাইল অপারেটরের কাস্টোমার কেয়ারে কথা বলতে গেলেন, কিংবা কোন ব্যাংকের ৫ ডিজিটের সর্ট কোড নাম্বারে কল করে কথা বলেছেন কি কখনো জরুরি প্রয়োজনে। সেখানে কল ড্রপের ফাঁদ পাতা আছে কি না বুঝতে পারবেন না। ওদের কাস্টোমার কেয়ারে কল ঢোকার প্রোগ্রামটা এমন করেই করে রাখেন যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনার কাছ থেকে ২/৩ মিনিট খেয়ে নেবে আর তার জন্য মিনিট প্রতি ভ্যাট, ট্যাক্স ছাড়াই দুই (২) টাকা করে কাটবে। বিদেশে কল করতে গেলে প্রায়শ: প্রথম কল ঢুকবে না, কিন্তু টাকা কাটবে। আবার কল ঢুকার আগেই টাকা কাটা শুরু হবে, কেউ পরীক্ষা করলে এর সত্যতা পাবেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের গানের প্রতিযোগিতায় আপনারা যে এসএমএস পাঠান তার রেট কত খোঁজ নিলে চমকে উঠবেন।   

একটা সত্য ঘটনা দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাই। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী খুব অসুস্থ। তাঁদের ৪ ছেলেই থাকেন গ্রামের বাইরে, শহরে, তাঁরা থাকেন গ্রামে। উদ্বিগ্ন বাবা মা কোনো ম্যাসেজ এলেই তা খুলে দেখার চেষ্টা করেন, ছেলেরা কোন ম্যাসেজ দিলো কি না। গত রমজানের ঈদে তাঁদের ছোট ছেলে আইটি ইঞ্জিনিয়ার বাড়িতে গেলে তার মা তাকে বলেন যে, খুব তাড়াতাড়ি তাঁর মোবাইলের টাকা শেষ হয়ে যায়, কথা না বললেও। আইটি ইঞ্জিনিয়ার ফোন চেক করে দেখে তার বাবা মায়ের মোবাইলে ১৭ টি করে ভিএএস চালু আছে। সে তাড়াতাড়ি সেগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা করে। এটাকে আমরা কি সেবা বলবো না কি অন্য কিছু, আপনার উপর বিবেচনার ভার রইলো।    

লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

Email: arefinbhai59@gmail.com

তথ্যঋণ: বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইটি বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য।
 

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭