ইনসাইড আর্টিকেল

কর্নেল গাদ্দাফি: এক বিলাসী বেদুইন রাজা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 02/09/2018


Thumbnail

একটি দেশের নেতৃত্বে যিনি থাকেন, তিনি দায়িত্ববান এবং ন্যায়পরায়ণ হবেন এমনটাই ভেবে থাকেন সবাই। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের নেতৃত্বে এমন অনেকেই এসেছেন যারা ছিলেন উদ্ভট বা পাগলাটে স্বভাবের। কেউ কেউ আবার তাদের নিষ্ঠুরতা ও খামখেয়ালীপনার কারণে ইতিহাসে বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত হয়ে আছেন। এরকম কিছু ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রপ্রধানের কথাই জানাবো আমরা। আজ থাকলো লিবিয়ার লৌহমানব হিসেবে খ্যাত কর্নেল গাদ্দাফির ইতিহাস...

কর্নেল মুয়াম্মর আল গাদ্দাফি একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনেতা নাকি ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসক ছিলেন, এ নিয়ে তর্ক করে থাকেন অনেকেই। কিন্তু তিনি যে উদ্ভট বা পাগলাটে নেতা ছিলেন এ বিষয়ে সকলেই একমত হবেন।

লিবিয়ার একগুঁয়ে রাষ্ট্রনায়ক গাদ্দাফি প্রায়ই তাঁর বক্তব্যে পশ্চিমাদের হুমকি ধামকি দিতেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ‘কিতাবুল আখজার’ তথা ‘দ্য গ্রীন বুক’ প্রকাশ করেন। ইসলামের শরিয়াহ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নীতিমালাকে ভিত্তি করে লেখা এই বইটিকেই তিনি লিবিয়ার সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেশটির স্কুলগুলোতে এই বই পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়। টেলিভিশনে প্রায় প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্কুলের মতো ব্লাক বোর্ডের সামনে চক হাতে নিয়ে রাজনৈতিক দর্শনের উপরে লেকচারও দিতেন। এজন্য তাঁকে শিক্ষক রাজাও বলতো তাঁর অনুসারীরা।

সবুজ রঙের প্রতি গাদ্দাফির বিশেষ দুর্বলতা ছিল বলে মনে করা হয়। তাঁর শাসনামলে লিবিয়ার জাতীয় পতাকাও ছিল সম্পূর্ন সবুজ রঙের। অধিকাংশ সময়ই তিনি স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক আলখেল্লা, মাথায় ফেজহীন লাল টার্কিশ টুপি ও গায়ে সাদা কম্বল জড়িয়ে রাখতেন। তবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সামরিক পোশাক ও ব্যাজ পড়তেন। অনেকে তাকে ফ্যাশন আইকনও বলতেন।

নিজেকে ইসলাম ধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে দাবী করা গাদ্দাফি নামাজে ইমামতি করতেন। নামাজ শেষে ধর্মীয় উপদেশ দিতেন। আবার তিনিই শতাধিক নারী দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন।

দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তিনি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন না। তার পদের নাম ছিল পিপলস কমিটির চেয়ারম্যান। আট সন্তানের জনক গাদ্দাফি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন তাঁবুতে। গুপ্ত হত্যার আশংকায় তিনি বারবার অবস্থান পরিবর্তন করতেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালীন সময়ে তিনি ওয়াশিংটনেও তাঁবুতে রাত যাপন করেছিলেন।

নাটকবাজ নেতা হিসেবে পরিচিত গাদ্দাফি সৌদি সফরকালে কাবা শরিফের গিলাফ ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! রাসূল (স) এর স্মৃতিধন্য এই ভূমিকে তুমি মার্কিন দালালদের হাত থেকে রক্ষা করো।’ এই ঘটনার পর লিবীয়দের হজ পালনে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল সৌদি সরকার।

১৯৮৬ সালে মার্কিন বিমান হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন গাদ্দাফি। কথিত আছে, আরও বহুবার দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র ভন্ডুল করে নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

জালাময়ী বক্তব্য দিতে অভ্যস্ত গাদ্দাফি মার্কিনিদের কাফের বলে অভিহিত করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন অমুসলিমরা কখনোই মুসলিমদের ভালো চায় না। অমুসলিমদের সঙ্গ ত্যাগ করা উচিৎ। কিন্তু তিনিই আবার অমুসলিম রাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন।

গাদ্দাফির পুরো নাম মোয়াম্মর মোহাম্মদ আবু মিনিয়ার আল গাদ্দাফি। ১৯৪২ সালের ৭ জুন লিবিয়ার সির্তে একটি বেদুইন পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় মাদ্রাসায় ঐতিহ্যগত ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক রক্তপাতহীন সামরিক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন তিনি।  সেসময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র সাতাশ বছর ।

গাদ্দাফি ১৯৭৭ সালে লিবিয়াকে ‘গ্রেট সোশালিস্ট পপুলার লিবিয়ান জামাহিরিয়া’ তথা জনতার রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছিলেন। যদিও তিনি তা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন। কারণ স্বৈরশাসনের অধীনে থেকে কোন রাষ্ট্রই জনতার রাষ্ট্র হতে পারে না। 

স্কুল জীবন থেকেই মিশরের নেতা জামাল আবদেল নাসেরের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন গাদ্দাফি। নাসেরের আরব সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের একজন অনুসারীও ছিলেন তিনি। তার শাসন ক্ষমতায় বসার পিছনে নাসেরের বিশাল ভূমিকা ছিল। গুরুকে অসম্মান করা হবে ভেবে তিনি কখনোই কর্নেল এর ওপরের কোন পদমর্যাদা গ্রহণ করেননি। লিবিয়ায় সাধারণত কারো ভাস্কর্য তৈরি করা হতো না। কিন্তু বেনগাজি শহরে কর্নেল নাসের-এর একটি বিশালাকার ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

গাদ্দাফির কয়েকজন পুত্রের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হতো প্রায়ই। বলা হয়ে থাকে, গাদ্দাফি তাঁর নিজের পরিবারের দুর্নীতি দমন করতে না পারলেও দেশটির জনগণকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। সত্তরের দশকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবীতে ত্রিপোলি ও বেনগাজীতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন গড়ে তোলে। গাদ্দাফির নির্দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও দেশটির আবু সালেম কারাগারে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২শ বিদ্রোহীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। 

১৯৮৬ সালে বার্লিনের নাইটক্লাবে বোমা হামলায় দুই মার্কিন সেনাসদস্য নিহত হয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এই হামলার জন্য গাদ্দাফিকে দায়ী করেন এবং ‘উম্মত্ত কুকুর’ বলে অভিহিত করেন তাকে। শুরুতে হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন গাদ্দাফি। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৩ সালে গাদ্দাফি প্রশাসন এই বোমা হামলার দায় স্বীকার করে নেয়। একই সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ১ কোটি ডলার করে ক্ষতিপূরণও দেয় দেশটি। তবে ২০০৯ সালে হামলায় অভিযুক্ত লিবীয় গোয়েন্দা কারামুক্তি পেয়ে দেশে ফিরলে গাদ্দাফি তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।

১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লাকারবির আকাশে প্যানাম এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমানে হামলার জন্য গাদ্দাফিকে দায়ী করা হয়। ওই হামলায় ২৮৯ জন যাত্রী নিহত হয়েছিল।

২০০৯ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন গাদ্দাফি। বক্তব্য দেওয়ার জন্য ১৫ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলেও একটানা দেড় ঘণ্টা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে হাসির পাত্র হয়েছিলেন তিনি। ওই সম্মেলনে জাতিসংঘ প্রদত্ত নীতিমালার অনুলিপি ছিঁড়ে ফেলেন গাদ্দাফি। এছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদার সঙ্গেও তুলনা করতেন গাদ্দাফি।

২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে ইতালি যান গাদ্দাফি। সম্পর্কন্নোয়নের শর্ত হিসেবে দেশটির দুইশ নারীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিতর্কিত হন তিনি।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিভিন্নভাবে  সহযোগিতা ও সমর্থন দান করেছিলেন এই গাদ্দাফি। লিবিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের কয়েকজনকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।

৪২ বছর লিবিয়ার নেতৃত্বে থেকে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন গাদ্দাফি। তাঁর শাসনামলে দেশটির মানুষের সুখ সমৃদ্ধির অভাব না থাকলেও মত প্রকাশের অধিকার ছিলো না মোটেই। এই বাক স্বাধীনতাহীন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লিবিয়ার মানুষ শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়নি। ২০১১ সালে দেশজুড়ে গণতন্ত্রের দাবীতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২০ অক্টোবর সির্ত শহরের বিশাল এক পাইপের ভিতর আত্ম গোপনে থাকা অবস্থায় বিদ্রোহীরা হত্যা করে তাকে। মৃত্যু পূর্ববর্তী ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে জন্মস্থান সির্তে সমাহিত করা হয়।

বাংলা ইনসাইডার/এএইচসি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭