ইনসাইড থট

‘মফিজ’ এবং সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 04/09/2018


Thumbnail

আমাদের বাংলাদেশে ডান আর বাম রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার গাটছাড়ায় গড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সিণ্ডিকেট সড়কে মৃত্যুর মিছিল আর গরীবের তথা গণমানুষের রক্তচোষা ফাঁদের অপর নাম সড়কের গণপরিবহন। তাই সড়কের গণপরিবহনের দশা দেখে ইদানিং আমার শুধু গাইবান্ধার মফিজের কথা মনে পড়ে। সেই মহান মফিজ যাকে অধিকাংশ মানুষ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। আমার মতো অনেকেই আছেন যারা জানেন না, উত্তরবঙ্গের মানুষদের কেন মফিজ বলা হয়। তাই বিভিন্ন মিডিয়ে ঘেঁটে এই মফিজের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করি।

গাইবান্ধা জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত অত্যন্ত সৎ ড্রাইভার ছিলেন মফিজ। তাঁর শেষ জীবনের সঞ্চয় এবং বাবার দেওয়া সামান্য জমি বিক্রয় করে ঢাকা রুটের একটা পুরাতন বাস ক্রয় করে ঢাকা- গাইবান্ধা রুটে বাসটি চালু করলেন। গরীব দরদী মফিজ সাহেব দিনমজুর লোকদের স্বল্প ভাড়ায় ঢাকা নিয়ে যেতেন।

এক সময় বয়সের ভারে মফিজ সাহেব অন্য ড্রাইভার দিয়ে বাস চালনো শুরু করলেন। কিন্তু দিনমজুর শ্রেনীর লোকেরা ভাড়া সাশ্রয়ের জন্য তাঁর বাড়িতে ধর্না দেওয়া শুরু করল। তাদের উপকারের জন্য সাদা কাগজে মফিজ লিখে সুপারভাইজারকে দিতে বলতেন এবং বাসের ছাদে নামমাত্র ভাড়ায় ঢাকা যাতায়াতের সুবিধা করে দেয়ার ব্যবস্হা করতেন। বাসের সুপারভাইজার মফিজ স্বাক্ষরযুক্ত কাগজ সংগ্রহ করে কম ভাড়া আদায় করতেন।

তাই বাসের ছাদে উচ্চস্বরে সুপার ভাইজার বলতেন কয়জন ‘মফিজ’ আছো ছাদে? অথাৎ কয়টা মফিজের স্লিপ আছে? আর এ ভাবে গরীবের উপকারী বন্ধু মফিজ শব্দটি চালু হয়। আজ আমরা ঠাট্রাকরে অনেকে ‘মফিজ’ শব্দটি উচ্চারণ করি। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলেন ‘মফিজ’ হওয়ার যোগ্যতা কি আপনার আমার আছে?

গণপরিবহনে চেড়েন আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষ। উচ্চবিত্তেরা খুব কম গনপরিবহনে চড়েন, খুব বিপদে পড়ে, অথবা উপায় না থাকলে। তাই সরকার গণপরিবহন চলাচলের উপযোগী অবকাঠামো তৈরী করে স্থলে আর জলে। বাংলাদেশে ডান আর বাম রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার সিণ্ডিকেটে সড়কে চলা গণপরিবহনের দখল নিয়েছে। চলছে পরিসেবার নামে গরীব শোষণ, আর চালাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিন দেশের কোন না কোন এলাকায় পরোক্ষভাবে হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষকে। সরকার বিআরটিসি’র বাস দিয়ে গরীব মানুষের কিছু পরিসেবা দিতে চাইলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিক সিণ্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এখন বাকী আছে রেল যোগাযোগ। জমি হুকিম দখলের মতো জটিল প্রক্রিয়া আর অনেক বেশী বিনিয়োগ করতে হয় বলে উল্লেখিত সিণ্ডিকেট এই রেল যোগাযোগ খাতকে এখনো জিম্মি করতে পারেনি।

এবার দেখে নেওয়া যাক সরকার কতটুকু ‘মফিজ’ হবার চেষ্টা চরিত্র করছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েতে ৯৭ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৫৩টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। দেশের আপামর জনসাধারণকে স্বল্প খরচে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য পরিবহনসেবা প্রদানের উদ্দেশে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সরকার বাংলাদেশ রেলওয়েকে আধুনিক, যুগোপযোগী, সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও যাত্রীর সেবামূলক গণপরিবহন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ সেক্টরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকা- টঙ্গী সেকশনে ৩য় ও ৪র্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে বিশাল এ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এই অর্থ দিয়ে ১ হাজার ১৬৫টি আধুনিক ইঞ্জিন ও ওয়াগন বা বগি কেনা হবে। এর মধ্যে ৪০টি ব্রডগেজ ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন), ৭৫টি মিটার গেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান, ৪০০টি মিটার গেজ ও ৩০০টি ব্রডগেজ কাভার্ড ভ্যান এবং ১৮০টি মিটারগেজ ও ১২০টি ব্রডগেজ বগি ওপেন ওয়াগন সংগ্রহ করা হবে।

পাশাপাশি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাগেজ ভ্যানের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ এবং ক্যাপিটাল ও মেনটেইন্যান্স স্পেয়ার্সও সংগ্রহ করা হবে।ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ রুটে নতুন করে ৯০ কিলোমিটার ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অনেক দিন বন্ধ থাকার পর আলোর পথ দেখছে এ উদ্যোগটি। ফলে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ রুটে ১১২ কিলোমিটার দূরত্ব কমে যাবে। পাশাপাশি ভ্রমণ সময়ও প্রায় তিন ঘণ্টা কমে যাবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের বগুড়া থেকে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন (সিরাজগঞ্জ) পর্যন্ত সরাসরি নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ৯০ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে মেইন লাইন ৭৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার এবং লুপ লাইন ১১ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। যা উত্তরাঞ্চলে খাদ্য পরিবহনেও খুব উপকার দেবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা হয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দূরত্ব কমে যাবে। তখন আর ঢাকা থেকে পাবনা ঈশ্বরদী হয়ে উত্তরবঙ্গের কোনো জেলায় যেতে হবে না। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে বগুড়া হয়ে সরাসরি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যাবে। এতে শুধু দূরত্বই কমবে না, কমে যাবে ৩ ঘণ্টা ভ্রমণ সময়ও।

জাপানের কথা বাদই দিলাম আমাদের পাশের দেশ ভারতে রেল যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত। আমাদের দেশেও একাধিক প্রাইভেট কোম্পানি মোটা অঙ্কের টাকা ভাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেন চালাতে চায়। তার বিনিময়ে তারা বাংলাদেশে রেলওয়েকে রেল লাইনের ন্যায্য ভাড়া দেবে। সময়টাও করবে বাংলাদেশে রেলওয়ের সময়সুচীর সাথে মিল রেখে যাতে বাংলাদেশে রেলওয়ের লোকসান না হয়। আর লোকসান হবেই বা কেন। তারা একই লাইন ভাড়া দিয়ে বাড়তি আয় করবে, যা এখন শুধু শুধু পড়ে আছে। বাংলাদেশে রেলওয়ের পাশাপাশি বেসরকারী রেলওয়ে সেবা এলে যাত্রী সেবার মান বাড়বে, গরীব মানুষের কম ভাড়ায় পরিবহন আর তাঁদের মালামাল পরিবহন সেবা দেবার সুযোগ পাবে সরকার। বেসরকারী খাতের এমন একাধিক প্রস্তাব এখনো লালফিতায় আটকে আছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়নি বলে অভিযোগ আছে।

যোগাযোগ অবকাঠামো আমাদের দেশের অর্থনীতি কেমন চাঙ্গা করে, কীভাবে উত্তরের ভয়াবহ মঙ্গার মত স্থায়ী ক্ষত দূর করে তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অবকাঠামোই যে সব না, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি সাম্প্রতিক কালের শিশুদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরে। যা এরশাদ সাহেবের আমল থেকেই শুরু সিপিবি’র সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান যখন পরিবহন শ্রমিকদের নেতা ছিলেন, তখন থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সিণ্ডিকেটের ফলে। তাই বাংলাদেশে ডান আর বাম রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার গড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সিণ্ডিকেটএর হাত থেকে দেশের গরীব মানুষকে পরিবহন (মালামালসহ) সেবা দিতে আমাদের রেল যোগাযোগের উন্নয়ন একটা বিকল্প হতে পারে। এফএও’র দারিদ্রেও ম্যাপ অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তারঞ্চলে দারিদ্র মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশী। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, ‘মফিদের’ দেশের ছেলে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও ‘মফিজদের’ এলাকার পুত্রবধু। গাইবান্ধার মহান ‘মফিজ’ হওয়ার সুযোগ তারা নেবেন কি না, তা এখন দেখার বিষয়। এই সুযোগ নিলে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে পারে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন।

উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

arefinbhai59@gmail.com

তথ্যঋণ: বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া, অন্যান্য

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭