ইনসাইড আর্টিকেল

শুভ জন্মদিন রুমী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/03/2017


Thumbnail

দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা গর্ভধারিণীকে কষ্ট দিয়ে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ১৯৫১ সালের এই দিনে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন তিনি। ডাক্তার এ কে.খান বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার; তাই তিনি সদ্যোজাত শিশুটির দুই পা ধরে, মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে পিঠে চাপড়ে বলেছিলেন “এটা ১৯৫১ সাল, ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে।”

সেদিনের সেই শিশু ১৯৭১ সালে পরিণত হয় এক টগবগে তরুণে। উদ্যমী, মেধাবী ও প্রাণবন্ত তরুণটির জীবনে ডাক্তারের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের পথেই ছিল। ১৯৬৮ স্টার মার্কস নিয়ে সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে ভর্তি হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতোমধ্যে আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে তার ভর্তি সম্পন্ন হয়। সেপ্টেম্বর ’৭১ থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল ক্লাস। কিন্তু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ধার না ধেরে তরুণটি নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় দেশের জন্য।

তিনি হলেন শাফী ইমাম (রুমী) বীর বিক্রম। শরীফুল আলম ইমাম আহমেদ এবং জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ সন্তান রুমী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। উনার দায়িত্ববোধ, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা, অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, পরিপক্বতা ও নির্ভীক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব আকর্ষণ করতো সবাইকে। ১৯৭১ সালে যখন আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা একেছিল পাকিস্তানি বাহিনী তখন দেশের টানে ঘরে থাকতে পারেন নি রুমি। দেশের আরামের জীবনকে বিদায় জানিয়ে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। দেশকে স্বাধীন করার পেছনে রেখেছিলেন অনন্য ভূমিকা।

১৯৭১ সালের যখন বাংলাদেশের অস্বিত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছিল শঙ্কা ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নেন দেশের জন্য যুদ্ধে যাবেন রুমী। তবে তার আগে যে নিতে হবে মায়ের অনুমতি। মাকে বলেন “আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও, আম্মা?”

কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উজ্জ্বল তারকা রুমী কোনদিনই হারেনি প্রতিপক্ষের কাছে। সেদিন ও মায়ের কাছে বিজয়ী হয়েছিলো রুমী। ছেলের অটল দেশপ্রেমের প্রতিজ্ঞা দেখে মা জাহানারা ইমাম দেশের জন্য উৎসর্গ করেন ছেলেকে।

১৯ এপ্রিল মাকে অবশেষে রাজি করিয়ে ২ মে রুমী সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফেরত আসতে হয় এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন। তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন।

রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ২৫ আগস্ট ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সেখানে একটি পাকিস্তানী সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেঙে, ”লুক লুক, এ জিপ ইজ ফলোয়িং আস” বলে স্টেন গান ব্রাশফায়ার করেন। তার গুলিতে পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে যেয়ে ধাক্কা খায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তার গুলিতে মারা যায়। ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

এই অপারেশনের পরেই মায়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল রুমি। স্টেইনগানের ফুলকিতে ফোসকা পড়ে যাওয়া কাঁধ দেখিয়ে অনুনয়ের সুরে মা জাহানারা ইমামকে বলেছিল, “আম্মা দেখো আমার ঘাড়ে কাধে স্টেন গান থেকে আগুনের ফুলকি ছুটে কি রকম ফোসকা পড়ে গেছে রাস্তায় মিলিটারি ধরলে এইটার জন্যই ফেঁসে যাব।”

সেটাই ছিল পরিবারের সাথে রুমির শেষ দেখা। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তান হানাদার বাহিনী একটি অজ্ঞাত উৎস থেকে তথ্য পেয়ে ক্র‌্যাকপ্লাটুনের কয়েক জন সদস্যকে আটক করে। সেখানে ছিলেন রুমী নিজেও। টর্চার সেলে টানা ‍দু’দিনের অত্যাচার সহ্য করেও রুমী ছিলেন নিশ্চুপ। হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের মুখেও কারও নাম প্রকাশ করেনি তিনি।

সেদিন রুমির সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার বাবা শরীফ ইমাম, ছোট ভাই জামী, বন্ধু হাফিজ, চাচাতো ভাই মাসুমকে। বাবা ও ভাইকে ছেড়ে দেয়া হলেও সেদিনের পর আর দেখা যায়নি রুমী সহ গ্রেফতারকৃত ক্র‌্যাকপ্লাটুনের অন্য যোদ্ধাদের। তবে রুমীর হত্যাকারীদের ইতিহাস ভুলে থাকেনি। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রুমী হত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত আলী আহসান মুজাহিদকে ফাঁসির রায় দেয় আন্তর্জাতিক আদালত। যা কার্যকর করা হয় ২২ নভেম্বর ২০১৫ সালে।

রুমী খুব বেশি সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তবে এই অল্প সময়ে করে গিয়েছিলেন অনেক কিছু। রুমী, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি বাঙালী জাতির অস্তিত্বের সংকটে দেশের জন্য দিয়ে গেছেন প্রাণ। আমাদের জন্য রেখে গেছেন একটি সোনার বাংলা। আজ তার জন্মদিনে এটাই প্রার্থনা- যেখানেই থাকুক রুমী, ভালো থাকুক।

বাংলা ইনসাইডার/আইএস




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭